বৈদেশিক সহায়তার পাইপলাইন ৫১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে
ভারতীয় ঋণে খুলনা থেকে মোংলা পোর্ট পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ভারতীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিলম্বে কাজ শুরু করা, মাঝপথে নকশা পরিবর্তন, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা এবং ঠিকাদার কর্তৃক নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের জটিলতায় এক দশকেও প্রকল্পের কাজ শেষ করা যায়নি।
এ প্রকল্পে ভারতের ৩৮৯ মিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। বাস্তবায়ন ধীর গতির কারণে এখনও প্রায় ৪০ শতাংশ ঋণ ব্যবহার করা যায়নি। এর মধ্যে অব্যবহৃত ঋণের ওপর বাংলাদেশকে ফিও দিতে হচ্ছে।
এ ধরণের অব্যবহৃত ঋণের কারণে পাইপলাইনে বৈদেশিক সহায়তা আটকে যাচ্ছে। সদ্য সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছর পাইপলাইনের আকার দাঁড়ায় ৫১ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে পাইপলাইনের আকার প্রথমবারের মতো অর্ধশত বিলিয়ন ছাড়িয়েছে।
এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের শুরুতে পাইপলাইনের আকার ছিল ৪৮.৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে ওপেনিং পাইপলাইনের মাত্র ১৪% অর্থ ছাড় হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওপেনিং পাইপলাইনে ২০% বা তার বেশি অর্থ ছাড় 'গুড পারফরমেন্স' হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্ত বাংলাদেশ এযাবতকালে কখনো ওপেনিং পাইলাইনের ২০% অর্থ ছাড় করতে পারেনি।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে প্রতি অর্থবছর উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতি বাড়ছে। আবার সেই অনুযায়ী বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়ছে না। এ কারণে অনেক প্রকল্প এক দশক ধরে বাস্তবায়ন হচ্ছে।
তারা বলেন, সাধারণ উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ হয় তিন থেকে পাঁচ বছর। কিন্ত বাস্তবায়ন সক্ষমতার অভাবে সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনা মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। জনবল নিয়োগ বিলম্ব, ভূমি অধিগ্রহণ ও দরপত্র জটিলতা, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিলম্বের কারণেও প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি থাকে না। আবার উন্নয়ন সহযোগীদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেও বাস্তবায়ন বাঁধাগ্রস্ত হয়। বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নয়ন সহযোগীদের সম্মতি নিতে হয়। অনেক সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের সদর দপ্তরের সম্মতির প্রয়োজন হয়। এসব কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি কম থাকে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
আবার যথাযথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প নেওয়ার কারণেও মাঝপথে প্রকল্প সংশোধন করতে হয়। এতে বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ হয়।
এদিকে কোভিড পরিস্থিতির কারণেও ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন সময় সরকার লকডাউনও আরোপ করেছে।
কোভিড পরিস্থিতিতে পদ্মা রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, দোহাজারী-কক্সবাজার-রামু-ঘুণদুম পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, পায়রা সমুদ্র বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ ও মেট্রো রেল (এমআরটি-৬) প্রকল্পসহ বৈদেশিক অর্থায়নের সব প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে। এ সময়ে অনেক বিদেশী পরমর্শক ও বিশেষজ্ঞ প্রকল্প এলাকায় আসতে পারেনি। কাজ চলছে থেমে থেমে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইআরডির এক কর্মকর্তা জানান, গত কয়েক বছরে সরকার বৈদেশিক ঋণে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ঋণ চুক্তি সই হওয়ার পর পরই ঋণের অর্থ পাইপলাইনে যোগ হয়ে যায়। পাঁচ বছর মেয়াদী এসব প্রকল্পের অর্থ একবছরে ব্যয় করা হয়। এ কারণেও পাইপলাইনের আকার বেড়েছে।
এছাড়া সম্পতি বছরগুলোতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সক্ষমতা বেড়েছে। এ কারণে আগের অর্থবছরের মতো ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থছাড় হচ্ছে।
তবে গত অর্থবছরের ছাড় হওয়া অর্থের মধ্যে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারই ছিল বাজেট সহায়তা। যার প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই। তবে কোভিড পরিস্থিতি না থাকলে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের অর্থছাড় আরও বাড়ানোর সম্ভাবনা ছিল বলে মনে করছে ইআরডি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক, আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'বর্তমান সরকারের আমলে উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে। কোনো কোনো অর্থবছরে ছয়, সাত বিলিয়ন ডলারও প্রতিশ্রুতি বেড়েছিল। অন্যদিকে প্রতিবছর ছয়, সাত বিলিয়ন ডলার করে অর্থছাড় হচ্ছে। গত অর্থবছরে ৭ বিলিয়ন ডলার ছাড় হলেও এর মধ্যে বাজেট সহায়তার অর্থ রয়েছে'।
তিনি আরও বলেন, 'প্রতিশ্রুতি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নে আরো কৌশলী হওয়া দরকার। বাস্তবায়ন কাজে মনিটরিংও জোরদার করতে হবে। তাহলে দ্রুত পাইপলাইনে আটকে থাকা অর্থ ব্যবহার করা সম্ভব হবে। এতে অর্থনীতিতে গতিশীলতা বাড়বে'।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, 'কোভিড পরিস্থিতিতে উন্নয়ন সহযোগীরা ফাস্ট ট্র্যাকিং পদ্ধতিতে কাজ করছে। অর্থায়নের ক্ষেত্রে অনেক সময় কান্ট্রি ডিরেক্টরদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীদের সদর দপ্তরের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করতে হয়নি। এ কারণে কোভিড ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত অনেক প্রকল্পে দ্রুত প্রতিশ্রুতি এসেছে। ফলে বেড়েছে পাইপলাইনের আকার'।
'কিন্ত এখন দেখতে হবে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থ ছাড় বেড়েছে কিনা। এখন প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড়ের মধ্যে বিশাল ঘাটতি রয়ে গেছে। বাজেটে সহায়তার অর্থ ছাড়ে কোনো সমস্যা না হলেও প্রকল্প সহায়তার অর্থ ছাড়ে অনেক ভোগান্তি পড়তে হয়। এ কারণে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, ক্রয় সংক্রান্ত কাজসহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম নিতে হবে। তা না হলে পাইপলাইনের অর্থ দ্রুত ছাড় করা সম্ভব না'।