আফগানিস্তান কি ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছে?
কাবুলের পতন এখন সময়ের ব্যাপার। প্রায় বিশ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগামী মাস অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সকল মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করার চূড়ান্ত ঘোষণা কার্যকর করার পথে। তালেবানরা গ্রামাঞ্চলের প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ১৮টি প্রাদেশিক রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবানরা। খবরে প্রকাশ, তারা এখন রাজধানী কাবুল থেকে মাত্র ৩০ মাইল দূরে।
দীর্ঘদিনের যুদ্ধের এতো দ্রুত এই পরিণতি হবে তা হয়তো মার্কিন প্রশাসন ধারণা করে নি। আফগান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যাবৎ নানা দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছিল। সেনা কর্মকর্তারা সৈন্যদের অর্থ আত্মসাৎ করছিলেন। অস্ত্র কালোবাজারে বিক্রি করছিলেন। তালেবানদের কাছেও অস্ত্র বিক্রি করছে এরকম অসংখ্য অভিযোগ আফগান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। ফলে দেশের মানুষ তালেবানদের উপর আস্তে আস্তে আস্থা রাখতে শুরু করে। তালেবানদের মৌলিক ত্রুটি জনগণের সামনে উত্থাপিত হলেও বেশ কিছু বিষয়ে তালেবানরা মানুষের মন জয় করতে পেরেছে যার মধ্যে অন্যতম, দুর্নীতি থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করা। তালেবানদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, নারীদের প্রতি সহিংসতা।
১৯৯৬-২০০১ তালেবান প্রশাসন যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তালেবানরা নারীদের প্রতি যে সমস্ত অভিযোগ ও শাস্তি প্রয়োগ করেছে তা সাধারণভাবে আজকের পৃথিবীতে স্বীকৃত নয়। নারী শিক্ষা, নারীর কর্মক্ষমতা, উপার্জনে নারীর নিযুক্তি সবকিছুতেই তালেবান ব্যবস্থায় অস্বীকৃতি জানানো হয়। নারীর স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। একারণেই আজকে সেখানকার নারীরা উদ্বিগ্ন। বেশকিছু শহরে তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরাসরি অংশ নিচ্ছেন নারী নেতৃত্ব। অন্তত তিনটি প্রদেশের গভর্নর নারী যারা সরাসরি তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।
প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক, তালেবানরা চীনাদের সমর্থন পাচ্ছে। গত ২০ বছর তালেবানদের অস্ত্র মূলত চীন এবং রাশিয়া সরবরাহ করতো বলে সন্দেহ করা হয়। মার্কিনীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চীন এবং রাশিয়ার সমর্থন থাকবে এটা ধরে নেওয়া যায়। তালেবান নেতারা চীনকে ইতিমধ্যে 'বন্ধু' হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে চীন বিনিয়োগ করবে বলে তালেবান নেতারা আশা করেন। তালেবানরা চীনকে আশ্বস্ত করেছে চীনের জিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলিম যোদ্ধাদের কোন রকম সহযোগিতা করবে না।
গত মাসে ৯ সদস্যের তালেবানদের এক প্রতিনিধি দল চীন সফর করেছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী য়োং ইর সাথে বৈঠক করেছে। বৈঠকে আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়া, নিরাপত্তা ও দুই দেশের ভবিষৎ রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হয়। যদিও কাবুল পতনের প্রাক্কালে চীন ভাড়া করা বিমানে তার দেশের নাগরিকদের ফেরত এনেছে।
আফগান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, উপমহাদেশের অন্য তিনটি দেশে ব্যাপক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আছে। পাকিস্তান ইতোমধ্যেই তালেবানদের দ্বারা নানাভাবে নিগৃহীত।
তালেবানদের নানা কর্মকাণ্ড তালেবান-পাকিস্তান একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। ২০০৭ সালে পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর কন্যা বেনজীর ভুট্টোকে তালেবানী পাকিস্তানীরা হত্যা করে। আজ পর্যন্ত সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার পাকিস্তানের অনুষ্ঠিত হয়নি। পাকিস্তানের সীমানা পেরিয়ে ভারতীয় অংশে তালেবানদের অবস্থান অতীতে দেখা গেছে। এখনও যে তার প্রভাব বিস্তার করবে না, সে কথা বলা যায় না।
আফগানিস্তানে শান্তি প্রক্রিয়া অসমাপ্ত রেখে মার্কিনীদের বিদায়ের ঘোষণার সাথে সাথে ভারত কাবুলে তার দুতাবাসের কর্মীদের দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে আসে। ভারতীয় নাগরিকদের সেখান থেকে ফিরে আসার নির্দেশনা দেয়। তালেবানরা স্পষ্টতই চীন- ভারত বৈরী সম্পর্ককে কাজে লাগাতে চায়। আফগানিস্তানের পুনর্গঠন, খনিজ সম্পদের ব্যবহার, ব্যবসা -বাণিজ্য সর্বপরি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে তালেবানরা চীনের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা চায়। গতকাল তালেবানরা ভারতকে কড়া হুশিয়ারী দিয়ে বলেছে, আফগানের উদ্দেশ্যে সৈন্য প্রেরণ করলে, 'ফল ভালো হবে না'।
আফগানে তালেবানদের সাফল্যে বাংলাদেশের হেফাজতীরা উল্লসিত তা অনুমান করা যায়। ইউটিউব চ্যানেলগুলোতে তাদের বক্তৃতা বিবৃতি দেখলে বোঝা যায়। দীর্ঘদিন যাবত তারা নির্বিগ্নে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী দর্শন প্রচার করে আসছে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়, শিক্ষাপাঠ্যক্রমে এবং শিক্ষা উপকরণে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে গত এক দশকে। শিক্ষার সকল স্তরে কন্যা ও নারী শিক্ষার্থীর পোশাকের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ইসলামে নারীদের পর্দা নিয়ে বিতর্ক পৃথিবীব্যাপী।
পারস্পারিক কুশল বিনিময়ের ভাষাতেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, লোকাচার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ঐতিহ্য আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এগুলোর চর্চা এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না। শহর, শহরতলী এমন কি গ্রামে ছেলেরা চাঁদা তুলতো কোন খেলা বা কোন নাটক করবে বলে। আর এখন, চাঁদা তোলে এলাকায় ওয়াজ মহফিলের জন্য। এদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভুতিকে কাজে লাগিয়ে খুবই সন্তর্পণে একটি ভিন্ন ভাবাদর্শ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এই ভাবাদর্শ ভীষণ কর্তৃত্ববাদী। এরা অন্য ধর্মকে কেবল ঘৃণা করতে শেখায়। ভিন্নমত, প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে এরা নির্মম। নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার ঘোর বিরোধী। আমাদের দেশের রাজনৈতিক বিভাজন ওদের পথ সুগম করে দিচ্ছে। সময় এখনো শেষ হয়ে যায় নি। সকল দলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা আগামী দিনে কী ধরনের দেশ রেখে যেতে চাই।