নিবন্ধন জটিলতায় কোভিড-১৯ টিকাগ্রহণে পিছিয়ে পরিবহন শ্রমিকেরা
নারায়ণগঞ্চ রুটের বাস চালক মোহাম্মদ রাজু (৩০)। দেশে লকডাউন শিথিলের পর নিয়মিত বাস চালাচ্ছেন তিনি। তবে নিবন্ধন করতে না পারার কারণে এখনো করোনাভাইরাসের টিকা নেননি রাজু।
মোহাম্মদ রাজু দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ভ্যাকসিন নিতে অনেক ঝামেলা। রেজিস্ট্রেশন করতে হয়, মোবাইলে মেসেজ আসে তারপর ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। সে কারণে এখনো ভ্যাকসিন নেইনি। ন্যাশনাল আইডি কার্ড নিয়ে টিকা কেন্দ্রের লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম একদিন কিন্তু ভ্যাকসিন পাইনাই। আমাদের জন্য টার্মিনালে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করলে খুব ভালো হয়"।
নিবন্ধন জটিলতার কারণে ভ্যাকসিন নেননি রিকশাচালক আব্দুল গণিও। ৫৫ বছর বয়সী এ রিকশাচালক বলেন, "করোনার টিকা নিতে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। আমার তো স্মার্ট ফোন নাই আর আমি অশিক্ষিত মানুষ, রেজিস্ট্রেশনও করতে পারিনা। তাই এখনো টিকা নেই নাই"।
আব্দুল গণির গ্রামের বাড়ি খুলনায়, সেখানেই তার জাতীয় পরিচয়পত্রসহ সব কাগজ রয়েছে। তিন মাস ধরে তিনি বাড়িতে যান না তাই এনআইডি কার্ড দেখিয়ে ভ্যাকসিন নেয়ার সুযোগও নেই তার।
শুধু বাসচালক রাজু বা রিকশাচালক আব্দুল গণি নয়, নিবন্ধন জটিলতার কারণে এখনো করোনার টিকা নিতে পারেনি অধিকাংশ পরিবহন শ্রমিক। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের তথ্য বলছে, দেশে গণপরিবহনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ৫০ লক্ষ শ্রমিক। তবে এর মধ্যে কত শতাংশ শ্রমিক করোনার টিকা পেয়েছে সে বিষয়ে কোন তথ্য নেই কারো কাছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাস শ্রমিক নেতা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অধিকাংশ পরিবহন শ্রমিকের এনআইডি কার্ড নেই। যাদের এনআইডি আছে তারা আবার ভ্যাকসিন পেতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেনা। সে কারণে খুব কম সংখ্যক শ্রমিক করোনার টিকা নিয়েছে। যারা টিকা পেয়েছে তারা নিজ উদ্যোগে নিয়েছে"।
রাজধানীর হাতিরঝিল রুটের বাস ড্রাইভার ওমর ফারুখ বলেন, "লকডাউনে যেসব পরিবহন শ্রমিক বাড়িতে ছিলেন তারা নিজেদের এলাকায় এনআইডি কার্ড দেখিয়ে ভ্যাকসিন নিয়েছেন। তবে আমি ঢাকায় থাকার কারণে রেজিস্ট্রেশন করতে পারিনি, ভ্যাকসিনও পাইনি"।
ঢাকা জেলার ট্রাক-ট্যাংক-লরি-কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জব্বার বলেন, "আমাদের শ্রমিকেরা তো ভ্যাকসিন পাচ্ছেনা। ভ্যাকসিন নিতে হলে নিবন্ধন করতে হয়, কিন্তু ৯০% শ্রমিক অশিক্ষিত, তারা নিবন্ধন করতে পারেনা। ভ্যাকসিনের নিবন্ধন করতে টাকা দিয়েও অনেকে প্রতারিত হয়েছে। দেশে ট্রাক শ্রমিক রয়েছে প্রায় ১০ লাখ, এর মধ্যে ১% শ্রমিকও এখনো টিকা নিতে পারেনি"।
আব্দুল জব্বার বলেন, "রেজিস্ট্রেশন করতে না পারলে জন্ম নিবন্ধন কার্ড নিয়ে গেছে ওয়ার্ডের ভ্যাকসিন সেন্টারগুলোতে। কিন্তু সমস্যা হলো সেখানে টিকা নিতে গেলে ওয়ার্ড মেম্বাররা পরিবহন শ্রমিকদের বলছে, তারা তো ভোটার নয়। ওয়ার্ডের ভোটার না হওয়ায় রেজিস্ট্রেশন ছাড়া টিকা নিতেও পারছে না শ্রমিকেরা"।
আব্দুল জব্বার বলেন, "পরিবহন শ্রমিকদের করোনার টিকা নিতে আগ্রহ আছে। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন জটিলতার কারণে তারা টিকা নিতে পারছে না। তাই সরকারের প্রতি আমাদের অনুরোধ গার্মেন্টসের মত টার্মিনালগুলোতে ভ্যাকসিন সেন্টার করে আমাদের শ্রমিকদের যেন টিকা দেয়া হয়"।
জুলাই মাস থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনার টিকা পাচ্ছেন গার্মেন্টস শ্রমিকেরা। গার্মেন্টস কারখানায় গিয়ে সিভিল সার্জনদের তত্ত্বাবধানে টিকা দেয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেশের ৫০ হাজারের বেশি গার্মেন্টস শ্রমিক কারখানাতেই টিকা পেয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহনে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি অনেক বেশি। পরিবহন শ্রমিকেরা সারাদিন অনেক মানুষের সঙ্গে মেশে তাই তাদের ও যাত্রীদের সুরক্ষার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিবহন শ্রমিকদের শতভাগ ভ্যাকসিনেটেড করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের টিকা বিষয়ক থিম্যাটিক গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাইমারি হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ডিজিজ কন্ট্রোলের সাবেক পরিচালক ড. এএম জাকির হোসেন বলেন, "এখন যেহেতু গণপরিবহন খুলে দেয়া হয়েছে তাই বাস ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, হেলপার থেকে শুরু করে সিএনজিচালক, রিকশাচালকদের সংক্রমিত হওয়ার ও সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি। সরকার দায়িত্ব নিয়েই গণপরিবহন খুলেছে। তাই সরকারের দায়িত্ব অগ্রগণ্যতার ভিত্তিতে পরিবহন শ্রমিকদের টিকার আওতায় আনা"।
ড. এ এম জাকির হুসেইন বলেন, "নিবন্ধন জটিলতা চাইলেই সমাধান করা যায়। পরিবহন শ্রমিকদের স্পটে এনআইডি কার্ড বা যেকোন গ্রহণযোগ্য পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিকা দিতে যাওয়া উচিত। ইউনিয়নে এবং গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে গিয়ে টিকা দেয়া গেছে, সেরকমভাবে বাস টার্মিনালগুলোতেও গিয়ে টিকার ব্যবস্থা করা উচিত। যেখানে মানুষ বেশি পাওয়া যাবে সেখানে গিয়ে টিকা দেয়া উচিত। মনে রাখতে হবে যে পরিবহন শ্রমিকদের টিকা না দিলে তারা অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে"।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, "আমরা পরিবহন শ্রমিকদের ভ্যাকসিন দিতে চাই। কিভাবে পরিবহন শ্রমিকদের টিকার আওতায় আনা যায় তা নিয়ে আমরা নিজেরাও আলাপ করেছি। ভ্যাকসিন পেতে সুরক্ষা ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এছাড়া এনআইডি বা জন্ম নিবন্ধন কার্ড দেখিয়েও ভ্যাকসিন নেয়া যায়। ভ্যাকসিন পেতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা একটা উপায় বের করে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলতে পারে"।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এবং বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের একটি যৌথ উদ্যোগ