আফগান ভূগোলের ইতিহাস ও রাজনীতি
আফগানিস্তান ছিল প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি। অসংখ্য রাজা ও রাজবংশের জন্ম ও বিকাশ ঘটেছে এখানে, অজস্র রাজ্য ও সাম্রাজ্যের অংশও ছিল তা, বহু সাম্রাজ্যের পতনও ঘটেছে এই ভূখণ্ডেই।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই আফগানিস্তানের ঘটনাবলি বিশ্ব-ইতিহাসকে নিয়মিত নাড়িয়ে দিয়েছে। এর কারণ এর তিনদিকে ছিল তিনটি বৃহৎ সভ্যতা: পশ্চিমে পারস্য, পুবে চীন ও নিচে হিন্দুস্তান; আর আফগানিস্তান নিজেই মধ্য এশিয়ার অংশ ।
ঘটনাবহুল আফগান ইতিহাসে এক নিঃশ্বাসে খানিকটা চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ পারসিক সাম্রাজ্যের একটা প্রদেশ ছিল বর্তমান আফগানিস্তান। আলেকজান্ডার (মৃত্যু ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এই অ্যাকিমিনিড বংশের শেষ পারসিক সম্রাট দ্বিতীয় দারায়ুসকে পরাজিত করলে পারস্যের বাকি প্রদেশগুলোর মতোই আফগানিস্তানও হেলেনিক সভ্যতা নামে পরিচিত গ্রিক সাংস্কৃতিক বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে দীর্ঘদিনের জন্য। আলেকজান্ডার নিজের নামে অনেকগুলো নগরের পত্তন করেছিলেন বিজিত অঞ্চলগুলোতে, কেবল মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াই আজও স্বনামে টিকে আছে। আফগানিস্তানেও ছিল একটি আলেকজান্দ্রিয়া, বর্তমানে তা আই-খানুম নামে পরিচিত। প্রধানত নগরগুলোতে একটা অভিজাত সমরজীবী জনগোষ্ঠী হিসেবেই গ্রিকরা সাম্রাজ্য শাসন করত।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যটি তিনটি বড় খণ্ডে বিভক্ত হয়। এই অংশটি ছিল সেলুসিড সাম্রাজ্যে—আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাসের নামে এই নাম—যাদের অন্যতম রাজধানী ছিল প্রথমে এখনকার ইরাকে অবস্থিত প্রাচীন ব্যাবিলন, পরবর্তীকালে রাজধানী ছিল বর্তমান তুরস্কের অ্যানটিয়খ। এরপর ভারতীয় মৌর্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলোর দখল নিয়ে ব্যর্থ যুদ্ধ (৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) শেষে বর্তমান আফগানিস্তানের বড় অংশটিকে তারা মৌর্য সাম্রাজ্যের হাতে তুলে দেন শান্তির বিনিময়ে, এবং এই শান্তিকে স্থায়ী করতে সেলুকাসের কন্যার বিয়ে হয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে।
মৌর্য ও সেলুসিড—উভয় রাজবংশেরই কালের বিবর্তনে অবক্ষয় ঘটে। এর প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর সেলুসিডদের কাছ থেকে নিজেদের মুক্ত করে ব্যাকট্রিয় গ্রিকরা আফগানিস্তানের বাকি অঞ্চলগুলোকে মৌর্যদের হাত থেকে কেড়ে নেয় সম্রাট অশোকের মৃত্যুর কিছুকাল পর। ব্যাকট্রিয়া আধুনিক আফগানিস্তানের বলখ প্রদেশ। এতেও এক সময় ভাঙন ধরে, ইন্দোগ্রিক নামে পরিচিত আরেকটি ধারা আধুনিক আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের একটা দীর্ঘকাল শাসন করে। এদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে শক নামে পরিচিত একটা বিখ্যাত যাযাবর ইরানি জনগোষ্ঠী, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে। এরপর পার্থিয়ান শাসন।
তারপর এলো আফগানিস্তানের সবচেয়ে বিখ্যাত কুষাণ সাম্রাজ্য, এরা আরেকটি যাযাবর জনগোষ্ঠী, যারা গ্রিক সংস্কৃতি আর ভারতীয় ধর্ম উভয়ের সংমিশ্রণে বিপুল একটা সভ্যতা গড়ে তুলেছিল মধ্য এশিয়া থেকে ভারতের মথুরা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে।
তারপর ইরানের ইতিহাসখ্যাত সাসানীয় রাজবংশের হাতে যায় আফগানিস্তান। এরপর ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে আরবদের হাতে সাসানীয়দের পরাজয় ঘটলে কয়েক শত বছরের মুসলমান বিজয়ের সূত্র ধরে ধীরে ধীরে আফগানিস্তানের নানা অঞ্চল বিজিত হতে থাকে, পারসিক সাফারিদ রাজবংশের আমলে কাবুলও ইসলামি সভ্যতার করায়ত্ত হয়।
এই সময়ের পরও মধ্য এশিয়া থেকে আসা নিত্য-নতুন অসংখ্য তুর্কি ও মোঙ্গল যাযাবর জনগোষ্ঠী কিংবা সমরপতি আফগানিস্তানের নানা অংশ দখল করে রাজবংশ কায়েম করেছেন। সুলতান মাহমুদও জন্মসূত্রে আফগান ছিলেন না, তুর্কি ক্রীতদাস হিসেবে সেনাবাহিনীতে ঢোকেন তার পিতা সবকতেগিন (মৃত্যু ৯৯৭ সাল)। চেঙ্গিস খান (মৃত্যু ১২২৭ সাল) ও তার পরবর্তী মোঙ্গল অধিপতিরা কখনো ভারতে প্রবেশ করতে না পারলেও আফগানিস্তান ভালোভাবেই মোঙ্গল দখলভুক্ত ছিল। হিন্দুস্তানে মোঘল সাম্রাজ্য স্থাপনের আগে ফারগানা ও সমরকন্দে ভাগ্যবিপর্যয়ের শিকার তরুণ বাবুর কাবুল দখল করেছিলেন ১৫০৫ সালে, এরপর অঞ্চলটি দীর্ঘকাল পালাক্রমে ভারতীয় মোঘল ও ইরানি সাফাভি রাজবংশের হাতবদল হতে থাকে।
অবশেষে পারস্যের হাত থেকে স্থায়ীভাবে স্বাধীন হয়ে অষ্টাদশ শতক থেকে আধুনিক আফগানিস্তান আকার নিতে থাকে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে। বলা যেতে পারে আহমদ শাহ দুররানি (মৃত্যু ১৭৫৭) আধুনিক আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা। মারাঠা সাম্রাজ্যের অবসান ঘটানো পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের নায়ক ছিলেন তিনি।
ফলে, আফগানিস্তান অজেয়, এটি ইতিহাসের বিচারে অন্তত অতিকথন। কিন্তু আধুনিক আমলে তিনটি বড় সাম্রাজ্য, বৃটিশ, রুশ ও মার্কিনিদের আফগানিস্তানে সমর-রাজনৈতিক পরাজয় ঘটেছে, এটাও সত্যি। তিনটি পরাজয়েরই ভিন্ন ভিন্ন কারণ ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে, সেগুলো মূল্যায়নে বহু ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে আফগানিস্তানের অজস্রবার বিজিত হবার ইতিহাস ভুলে গিয়ে 'অপরাজেয় আফগান' বাক্যটিকে শিরোধার্য করা। তবে একইসঙ্গে এটাও খুবই সত্যি, সামান্য আবাদযোগ্য জমি আছে দেশটিতে, আফগান জনগোষ্ঠীগুলোকে তাই প্রায়ই নির্ভর করতে হতো পশুপালন, ফৌজি চাকরি এবং বণিকবৃত্তির ওপর। সেটা তাদের একটা স্বাধীনচেতা ও যুদ্ধনৈপুণ্যের সংস্কৃতি প্রদান করেছে প্রাচীন যুগ থেকেই; একইসঙ্গে ভৌগোলিক গঠনও দুর্গমতা তৈরি করেছে।
কিন্তু প্রতিবন্ধকতা যাই হোক, অসংখ্যবার দেশটি আক্রান্ত, লুণ্ঠিত ও অতিক্রান্ত হয়েছে তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই। কারণটি প্রথম বাক্যেই বলা আছে, আফগানিস্তান ছিল তিনটি বৃহৎ সাম্রাজ্যের গ্রন্থি; বিশেষ করে ভারতবর্ষে বাণিজ্য বা লুণ্ঠন বা সাম্রাজ্যবিস্তারে আফগানিস্তানের বিকল্প ছিল না। হিন্দুস্তান দখলের স্বপ্নে বিভোর বাবুর তাই কাবুলকে প্রথম লক্ষ্যবস্তু করেছিলেন।
২.
আফগানিস্তানের অস্থির রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তার এই ভৌগোলিক অবস্থানের। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে আধুনিক কালের আগ পর্যন্ত আফগানিস্তানের বলখ, বামিয়ান, হেরাত, বদখশান ও কাবুল অবস্থিত ছিল প্রাচীন পৃথিবীর প্রধানতম বাণিজ্যপথের শাখা কিংবা প্রশাখার ওপর। রেশম পথ নামে পরিচিত এই্ বাণিজ্য পথের অনেকগুলো প্রবাহ ধরে চীন, ভারতীয় ও মধ্য এশীয় বিপুল সম্পদ পৌঁছে যেত রোম পর্যন্ত। চীনা রেশম ছিল তার প্রধান পণ্য, তাই রেশম পথ নামকরণ। কিন্তু চীন একমাত্র গন্তব্য ছিল না, প্রধান উৎপাদকও ছিল না।
আফগানিস্তান ধরেই অন্য একটা শাখা নিচের দিকে নেমে আসত ভারতে। রেশম ছাড়াও নানা সময়ে আসত ও যেত মধ্য এশীয় স্তেপের সহজলভ্য যুদ্ধের ঘোড়া, আরবের রাজসিক অশ্ব, মূল্যবান তৈজসপত্র, মশলা, কাগজ, শুকনো ফলমূল ও বিলাসদ্রব্য। সশস্ত্র বণিকদলের পাহারায় উটের সারি, গাধা আর খচ্চরের দল সেই মালপত্র টানত দীর্ঘ যাত্রাপথগুলোতে। পথে পথে লেনদেন হতো, মাল নামত, নতুন মাল উঠত। প্রাচীন আমলে রোমের স্বর্ণ এই পথেই চীনে নিঃশেষ হতো, তাদের বাণিজ্যের ছোট একটা অংশ সমুদ্র পথে ভারত-বাণিজ্যে সম্পন্ন হতো।
বিশেষ করে তৎকালীন হিন্দুস্তানের জন্য আফগানিস্তান ইতিহাসের একটা বিরাট সময় জুড়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একদিকে সীমান্তে সর্বদা উৎকণ্ঠিত নজর রাখতে হতো আকস্মিক কোনো সেনাবাহিনী বা রোমাঞ্চপ্রিয় গোত্রপতি বা দস্যুদলের উৎপাত বা সমর অভিযান বিষয়ে; অন্যদিকে, বাণিজ্যের আশাতেও। এখান থেকে বাকি দুনিয়ায় পণ্য যাবার এবং এবং আসবার প্রধান পথ ছিল আফগানিস্তান। এই পথেই মৌর্য আমলে ভারতীয় হাতিরা রপ্তানি হয়ে সুদূর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গ্রিক সমরপতিদের মাঝে যুদ্ধগুলোতে ব্যবহৃত হতে। দিল্লির সুলতানি ও মোঘল আমলে শুধু ভাড়াটে সৈন্য নয়; আফগানিস্তান হয়ে আসতেন জ্ঞানী দার্শনিক, উলামা, দরবেশ, হেরেমের নারী এবং বণিকের দল।
বাণিজ্য পথের শুল্ক আদায় আফগান শাসকদের অন্যতম আয়ের উৎস ছিল। আফগানিস্তানে বণিকদের রক্ষা করা ছিল অন্যতম প্রধান রাজকর্ম। সেলজুক সুলতান মালিক শাহের (মৃত্যু ১০৯২) অনুরোধে রচিত নৃপতির করণীয় বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থ পারসিক 'সিয়াসতনামা'য় বণিকদের সঙ্গে ন্যায়বিচারকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একটা গল্প সেখানে এমন, বণিকের কাছ থেকে ৬০ হাজার দিনার মূল্যের পণ্য নিয়ে তা পরিশোধে গড়িমসি করছিলেন সুলতান মাহমুদ গজনির পুত্র মাসুদ। মাসুদকে সুলতান বাধ্য করেন এই অর্থ পরিশোধে; তার ফলাফল হলো: 'এই সংবাদ যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তখন চীন, মিশর এবং এডেন থেকে বনিকরা দুনিয়ার বাছাই করা সব জিনিসপত্র নিয়ে গজনী অভিমুখে রওয়ানা হলো।'
তাৎপর্যটি অত্যন্ত পরিষ্কার, শুল্ক আদায় অব্যাহত রাখতে হলে বণিকদের ওপর অবিচার করা যাবে না, যেমনটা জনসংখ্যা হ্রাস করতে না চাইলে কৃষকদের ওপর নিপীড়ন করা যাবে না।
বণিকদের চলাচল নিশ্চিত করতেই দস্যুদমনও নৃপতিদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। কিন্তু একদিকে বিরল উর্বর ভূমির এলাকা, আরেক দিকে নৃপতিদের অবহেলা ও বিলাসব্যসন প্রাবল্য প্রায়ই বেকারত্ব তৈরি করত, এবং অজনপ্রিয় দুঃশাসন যে নিয়মিতই দস্যুবৃত্তি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক উত্থান-পতন ঘটাত, তা ওই সিয়াসতনামাতেই যেমন উল্লেখ করা আছে, তেমনি আছে আধুনিক আমলেই বাচ্চা ই সাকাও (মৃত্যু ১৯২৯) কর্তৃক আফগানিস্তানের বাদশা আমানুল্লর উৎখাতের ইতিহাসে। সৈয়দ মুজতবা আলীর 'শবনম' উপন্যাসটি এই পটভূমিতেই রচিত হয়েছিল।
৩.
বাণিজ্যের গ্রন্থিগুলোই প্রাচীন দুনিয়ায় সামরিক ক্ষমতার কেন্দ্র; চিন্তা, ধর্ম ও দর্শনের মিথস্ক্রিয়ারও কেন্দ্র। আফগানিস্তানে প্রাচীন আমল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত জরথ্রুস্তীয়, গ্রিক, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান ও শিখ চিন্তাধারার বিস্তার ঘটেছে। এই পথেই বৌদ্ধ ধর্ম একটি পথে মধ্য এশীয় তুর্কি জনপদগুলোতে হাজির হয়েছিল। সঙ্গত কারণেই এই বাণিজ্যের সূত্রে বহু পুরনো আমল থেকেই আফগানিস্তানে এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠী একটা পুরুষতান্ত্রিক-সমরতান্ত্রিক-গোত্রতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত ছিল বটে, সেটা তো তখনকার বাকি দুনিয়ার বড় অংশেও। কিন্তু দেশটিতে অনেকগুলো নগরকেন্দ্রও গড়ে উঠেছিল; গড়ে উঠেছিল অনেকগুলো শিল্পরীতি। গান্ধার শিল্পকলার জন্ম এই দেশে, অপূর্ব সব ভাস্কর্যের ছড়াছড়িও সেই ইতিহাসেরই সাক্ষ্য দেয়। ভুবনবিখ্যাত শিল্পী ওস্তাদ বিহজাদ তার জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছেন হেরাতে। হেরাত শিল্পরীতি ছিল শিল্পকলার প্রাধান্যশীল একটা ধারা। শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবেও তা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। খলিফা সোলায়মান ইবনে আবদুল মালিক বলখের বংশানুক্রমিক জ্ঞানচর্চার জন্য প্রাচীন বিখ্যাত পরিবারের সন্তান জাফর বার্মাককে উজির করার জন্য কতটা মরিয়া হয়েছিলেন, সেই কাহিনিও মধ্যযুগে পঠিত হতো রাজাদের সঙ্গে জ্ঞানীদের সম্পর্কের গুরুত্ব বোঝাতে।
তবে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ হলেও প্রতিবেশী স্তেপভূমি থেকে নিয়মিত যাযাবর তুর্কি, মোঙ্গল ও আরও নানান জাতির অভিবাসনের স্রোত এর রাজনৈতিক ভারসাম্যকে বারবার টলিয়ে দিয়েছে। মুসলমান আমলে তুর্কি-অতুর্কি দ্বন্দ্ব, কারিগরদের সঙ্গে সমরজীবীদের পৃথকতা, নানান উপদলীয় কোন্দলের ফলশ্রুতিতে একদিকে গোঁড়া ও কঠোর এবং বিপরীতে উদারতা ও সহিষ্ণুতার অজস্র মত-পথ ও তত্ত্ব এই জনপদে বিকশিত হয়েছে। সোজা বাংলায় বললে এই দাঁড়ায়, জগতে সর্বদাই জ্ঞান ও শিল্পকেন্দ্রে পরিণত হয় সেই গ্রন্থিগুলো, বাণিজ্য যে পথ দিয়ে যায়। বিপুল রক্তপাত সত্ত্বেও সর্বদা প্রাণচঞ্চল ছিল তাই এই ভূখণ্ড।
৪.
আফগানিস্তানের ক্রমশ গুরুত্ব হারাবার সূচনা ধরা হয় পঞ্চদশ শতকে নৌবাণিজ্য বৃদ্ধির সময়টিতে। এর পরবর্তী সময়টিতে ইউরোপ, চীন ও ভারতবর্ষের বাণিজ্যের বড় অংশটি সংগঠিত হতে থাকে নৌপথে, এবং ক্রমাগত তা বাড়তেই থাকে। শুরুতে তুরস্ক ও মিসরীয় ফাতেমিরা ভারত মহাসাগরীয় এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত, তারপর ধীরে ধীরে তুর্কিদের পাশে সরিয়ে মাঠে আসে পর্তুগিজ এবং শেষে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তিগুলো। ভারতীয় পণ্যের পাশাপাশি চীনা রেশম ও তৈজসপত্র এবং অন্যান্য সামগ্রীও তখন নৌথেই সরাসরি ইউরোপে যেতে থাকে।
এরপরও আফগানিস্তানের অন্তত ভারতীয় বাণিজ্যের একটা বড় অংশ টিকে ছিল। ধীরে ধীরে বাইরের সম্পদের এই পথে চলাচল কমে গেলে সমৃদ্ধ মধ্য এশীয় নগরগুলো খানিকটা বিকাশরহিত হয়, কিন্তু আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশীয়রা নিজস্ব উৎপন্নের ভারতীয় ও পারসিক বাণিজ্য অনেকটা অটুট ছিল। কিন্তু ভারতের রপ্তানি ও আমদানির প্রধান ভূমিকাটা দখলে নিয়েছিল ফুলে-ফেঁপে ওঠা আন্তর্জাতিক সমুদ্র বাণিজ্য। শেষ ধাক্কাটা আসে মধ্য এশিয়ার বাকি দেশগুলো ধীরে ধীরে ঊনিশ শতকে রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়।
আফগানিস্তানের সঙ্গে সেগুলোর বাণিজ্যিক সংযোগ কমে গিয়েছিল ব্রিটিশ ভারতীয় পণ্য রুশরা বন্ধ করায়। কাজাখ-উজবেক-তুর্কমেন-তাজিকিস্তানের কাঁচামালের একটা অংশ তখন মস্কোমুখে ধাবিতও হলো। রুশ আগ্রাসন ঠিক আফগানিস্তানের দোড়গোড়ায় বন্ধ হয়, দশটি পরিণত হয় রুশ-ব্রিটিশ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আর গোয়েন্দাদের আখড়ায়।
দিল্লির সুলতানি ও মোঘল সেনাবাহিনীতে অশ্বারোহীরাই প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও বন্দুকের ব্যবহার ক্রমশ আধুনিক ও নির্ধারক হয়ে উঠছিল। সামরিক কাজে অশ্বারোহীর ধীরে ধীরে চাহিদা কমতে থাকলেও একদম লুপ্ত হয়নি। এছাড়া শৌখিন বিলাসের চাহিদা তখনও ছিল।
ইতিহাসবিদ সিরাজুল ইসলামের লেখা থেকে জানতে পারি, '১৮৩১ সালে লাহোরের বিখ্যাত ঘোড়া সরবরাহকারী জবরদস্ত খান ঢাকায় এসে উপস্থিত। সঙ্গে এনেছেন এক ডজন উচ্চ জাতের আরব্য ঘোড়া।' ঢাকার নতুন বিত্তবান হয়ে ওঠা নবাব পরিবারের আভিজাত্যের চাহিদা মেটাতে এই আগমন ঘটলেও লাহোরি ওই ব্যবসায়ী আসলে রেশম পথের আফগান বাণিজ্যেরই ধারাবাহিকতার লুপ্তাবশেষ। ব্রিটিশ আমলে সেনাবাহিনী ও অন্যান্য প্রয়োজন তখনো যেটুকু ছিল, তা মেটাতে ঘোড়া প্রধানত আমদানি করা হতো ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া থেকে, নৌপথেই। ফলে ভারতবর্ষের সঙ্গে আফগানিস্তানের ফল, রত্নপাথর ইত্যাদির কিছু ব্যবসা টিকে থাকলেও প্রধান বাণিজ্য অশ্বের চাহিদা একদম বন্ধপ্রায় হয়ে যায়।
৫.
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন মধ্য এশীয় দেশগুলোকে মুক্ত করায় প্রাচীন আমলের মাত্রায় না হলেও আফগানিস্তানের ভৌগোলিক গুরুত্ব অনেকটাই পুনরুদ্ধারের একটা আংশিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কেননা স্থলবেষ্টিত মধ্য এশীয়ার দেশগুলো সোভিয়েত পতনের পর আর পুরোপুরি মস্কোমুখী নয়, তাদের বিপুল উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সম্ভাবনাটা অনেক বেশি বাস্তবায়িত হতে পারত আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান-ইরান-ভারতমুখী বাণিজ্যে। সেটা হতে পারেনি গত ৩০ বছর ধরে দেশটিতে স্থায়ী অশান্তির কারণে, কিন্তু সেই প্রয়োজনীয়তা বা সুযোগ কোনোটাই ফুরোয়নি। আফগান যুদ্ধের অবসান গোটা অঞ্চলেও বিরাট ভারসাম্যের বদল আনবে, এমন সম্ভাবনা বিপুল।
ইরানের চাবাহার বন্দর (যার পেছনে বাজি ছিল ভারতের; চীনও দেশটিতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে) এবং পাকিস্তানের গদওর বন্দরকে কেন্দ্র করে আফগানিস্তান হয়ে উঠতে সক্ষম মধ্য এশিয়ার বিপুল খনিজ, তুলা, পশম, তেলবীজসহ নানান কাঁচামালের যাত্রাপথ। চীনের নতুন উত্থান ও নতুন রেশম পথের বিস্তার সেই সম্ভাবনাকে আরও গভীর করেছে। মধ্যযুগের একটা পর্বে ইতিহাসের যে বাঁকবদল আফগানিস্তানকে পাশে সরিয়ে দিয়েছিল, আরেকটি মোড় পরিবর্তন আফগানিস্তানকে আবারও দুনিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য গ্রন্থিতে পরিণত করার বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে।
তুর্কমেনস্তানের জ্বালানির জন্য ভারতের আকুতি দীর্ঘদিনের। সেই প্রস্তাবিত জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে তাকে সম্পর্ক ভালো করতে হবে। মধ্য এশীয় বাণিজ্যে স্থলপথে ভারতকে প্রবেশ করার সুযোগ দিয়ে পাকিস্তান নিজে বিপুলভাবে লাভবান হতে পারে।
চীনের নেতৃত্বে নতুন রেশম পথের আলোচনা আফগানিস্তানের বৈশ্বিক একটি গ্রন্থি হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে আরও গভীর করে তুলেছে। চীনের ওপর নানা বিধিনিষেধ সত্ত্বেও গত কয়েক বছরে ভারতে চীনের রপ্তানি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। মধ্য এশীয় বাণিজ্য এই রপ্তানিকে আরও বর্ধিত করতে পারে। কেননা, মধ্য এশিয়াতে যে বিপুল বিনিয়োগের চাহিদা আছে, সেটা মেটাবার মতো সামর্থ রাষ্ট্র আপাতত কেবল চীনই। এই বাণিজ্যপথের পুরোটা সুফল নিতে চাইলে চীনকে আবার চাপ দিতে হবে পাকিস্তানের ওপর; কেননা, শান্তি ছাড়া এই বাণিজ্য সম্ভাবনার পুরোটা বাস্তবায়িত হবে না, যার সবচেয়ে বড় আর্থিক লাভটা চীনই পাবে।
যদিও এগুলো এখনো সবই সম্ভাবনামাত্র। কেননা, এই অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিবেশের কারণেই নগদ আর্থিক লাভালাভের চাইতেও আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, ভারসাম্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যেমন, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রভাব, ভারতের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও আঞ্চলিক আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা এগুলোও অনেক বড় নিয়ামক; সঙ্গে মার্কিন, চীন ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তিগুলোর ভূমিকাও উল্লেখ্য।
সকল ক্ষেত্রেই যেটা ঘটে থাকে, আবারও বাণিজ্য পথের সমৃদ্ধি আফগান সংস্কৃতিতেও তেমনি প্রাণসঞ্চার করে ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে তাকে প্রণোদনা যোগাতে সক্ষম; সক্ষম সেখানে জনগণের মাঝে আত্মসচেতন ও নিজের পায়ে দাঁড়ানো মনোবৃত্তির বিকাশ ঘটাতে। এই সব কিছু আসলে নির্ভর করছে আফগানিস্তানে একটা গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হবার ওপর। এই সম্ভাবনার পূর্ণবিকাশে বাধা বহু, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর বহু ক্ষুদ্র স্বার্থ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপরায়ণতা আফগানিস্তানে শান্তিকে আটকে রেখেছে। অথচ এই শান্তির বাস্তবায়নে তারা সকলেই বহুভাবে উপকৃত হতে সক্ষম।
-
লেখক: প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিক