বিষটোঁপে মারছে শিকারিরা, কমে যাচ্ছে অতিথি পাখি
শীতপ্রধান অঞ্চল থেকে আসা অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর ভোলার উপকূলীয় চরাঞ্চলগুলো। হেমন্ত শেষে শীতের হিমেল হাওয়া শুরুর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের জীবন বাঁচাতে ভিনদেশি এসব পাখির দল ঝাঁক বেঁধে হাজির হয় এ অঞ্চলে। রঙ-বেরংয়ের এসব পাখির কিচির মিচির শব্দে খন্ডকালিন সময়ের জন্য প্রাণ ফিরে পায় জনবিছিন্ন চরগুলো। চরকুকরী মুকরি ও ঢালচরের ম্যানগ্রোভ বাগান পেরিয়ে দক্ষিণে গেলে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির আসা যাওয়া কেড়ে নিবে যে কোনো মানুষের মন। দ্বীপজেলা ভোলার চারদিকে ঘিরে থাকা মেঘনা-তেঁতুলিয়া বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা ডুবোচর গুলো বিচরণের ক্ষেত্র হিসেবে বেঁছে নিয়েছে অতিথি পাখির দল। নভেম্বরে আসা শুরু হয় তাদের। গ্রীষ্মের তাপ শুরু হলে এসব পাখির দল ফিরে যায় পুরনো ঠিকানায়।
তবে অসাধু শিকারিদের অপতৎপরতার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে ভোলার উপকূলীয় এলাকার অতিথি পাখির বিচরণ ভূমিগুলো। নদীর মধ্যবর্তী চারণভূমিতে ফাঁদ ও বিষটোঁপ দিয়ে নির্বিচারে চলছে পাখি নিধন। এসব পাখির মাংস গোপনে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন হোটেল ও হাটবাজারে। আর বিষ দিয়ে মারা পাখির মাংস খেয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ। এতে পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি ভবিষ্যতে পাখি আসা নিয়ে শঙ্কিত পরিবেশকর্মীরা। তবে অসাধু শিকারিদের কবল থেকে পাখি রক্ষায় বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর তৎপরতা চোখেই পড়ে না।
তবে পাখির বিচরণক্ষেত্র ও নিরাপদ প্রজননে বাধা এবং খাদ্যস্থল মানুষের দখলে চলে যাওয়ায় দিন দিন অতিথি পাখির সংখ্যা কমছে। এ কারণে শঙ্কিত বিশেষজ্ঞরা। তাই ভোলাকে পাখির জন্য সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণার দাবি করেছেন তারা।
শীত মৌসুমে বাংলাদেশে আসা অতিথি পাখির অর্ধেক আসে ভোলা উপকুলে। উপকূলীয় ডুবোচর, নালা, খাল-বিলে জড়ো হওয়া ভিনদেশি পাখিরা। অতিথিপরায়ণ বাঙালি আদর করেই এদের অতিথি পাখি নামে ডাকে। পাখি নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্য মতে, ভোলা উপকূলে ৬৫ জাতের প্রায় ২৩ হাজার পাখির দেখা মিলে। শীতের তীব্রতার উপর নির্ভর করে অথিথি পাখির সংখ্যাও বেশি কম হয়।
প্রায় বিপন্ন চামচ ঠুঁটো বাটান নামের জলচর ও মদনটাক নামের বিপন্ন পাখিও গত মৌসুমে দেখা গেছে। এবার জলচর পরিযায়ী পাখির সংখ্যা ও প্রজাতি বৃদ্ধি পেলেও এদের প্রজনন, খাদ্যস্থল ও বিচরণক্ষেত্র নিয়ে শঙ্কিত শুমারি দল।
জোয়ারে ডুবে যায়, ভাটায় জেগে ওঠে এমন চরগুলোতেই অতিথি পাখিদের মুক্ত বিচরণ ভূমি। ভোলার দক্ষিণে বঙ্গপোসাগরের কোলঘেঁষা চরকুকরী মুকরি, চর শাহজালাল, চরশাজাহান, চর পিয়াল, আইলউদ্দিন চর, চরনিজাম, দমার চর, ডেগরারচরসহ শতাধিক এমন ডুবোচর রয়েছে। যা শুধু শীতে পানি কমে গেলে জেগে ওঠে। ওইসব চর থেকেই পাখিরা তাদের খাবার সংগ্রহ করে। বড় বিপদে পড়লে আশ্রয় নেয় পার্শ্ববর্তী ম্যানগ্রোভ বনে। প্রতি বছরের মতো এবারও নভেম্বর মাস থেকেই ভোলার চরাঞ্চলে লক্ষ লক্ষ জলচর পাখির সমাবেশ ঘটেছে।
এদিকে পাখির প্রধান আশ্রয়স্থল উপকূলের অনেক চরাঞ্চলে মানুষের বসবাস শুরু হওয়ায় নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারছে না। একটি বিশেষ শ্রেণির শিকারিরা কারেন্ট জালের ফাঁদের পর আর বিষ প্রয়োগ করে অতিথি পাখি নিধন করছে। বিষ প্রয়োগ করে মারা পাখিগুর মাংস হোটেল-রেঁস্তোরায় বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। চরফ্যাশনের চর নুরুল আমি, লালমোহন উপজেলার গাইমরা, সদর উপজেলা ভেলুমিয়া দক্ষিণ মাথা, বাঘমারার চর, দৌলতখানের মদনপুরের চরে বিষ দিয়ে সবচেয়ে বেশি পাখি নিধন করা হয়। জেলা শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরের মেঘনার মধ্যবর্তী মদনপুর ও মধুুপুর চরে প্রতি বছরের মতো এবারও পাখি নিধনের খবর পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ নেচার কনজারভেশন কমিটির (এনসিসি’র) জেলা সমন্বয়কারী জসিম জনি জানান, ভোলা অঞ্চলে যেসব পাখি বেশি দেখা যায় সেগুলো হলো, কমন শেল ডাক, রাডি শেল ডাক, লেসার উইস্টলিংক ডাক, মেলাড, পসার্ড, পিন টেইল ডাক, কটন টিল, কমন পসাড, টাপটেড ডাক, কমনস্যাং পাইপার, উড স্যাং পাইপার, গ্রিন স্যাং পাইপার, কারলিউ, উইমরেল, স্ন্যাইপ, গডওয়াল, বার-হেডেড গুস, সুভেলার, স্পুন-বিল স্যাং পাইপার, স্কিমার, আইবিচ, পভার, লেপউইং, গার্ল প্রমূখ জলচর অতিথি পাখি। দেশে যে পরিমাণ অতিথি পাখি আসে তার প্রায় অর্ধেকই ভোলার চরাঞ্চলে অবস্থান করে। পাখির মুক্ত বিচরণ এলাকাগুলোতে মানুষ বসবাস শুরু করায় পাখি আসা কমে যাচ্ছে বলে জানান এনসিসি’র আঞ্চলিক সমন্বয়কারী।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভোলার উপকুলীয় এলাকায় অতিথি পাখি নিরাপদে আছে দাবি করে চরকুকরী মুকরি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন জানান, কুকরীর সৌন্দর্য্যরে একটি বড় অংশ শীতের অতিথি পাখি। এখানে দেশি বিদেশি যেসব পর্যটক আসছে তারা এসব পাখি দেখে মুগ্ধ হয়। তাই পাখি শিকার থেকে বিরত থাকার জন্য এলাকা মাইকিংসহ প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে। সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। এছাড়া সৌখিন শিকারিদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
ভোলা অঞ্চলে আসা অতিথি পাখিরা নিরাপদে আছে দাবি করে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) তৌফিকুল ইসলাম জানান, অতিথি পাখির শিকার বন্ধ করা ও অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে এলাকাভিত্তিক টহল দল গঠন করেছে বন বিভাগ। ওইসব টহলদল নিয়মিত টহলের মাধ্যমে পাখিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। এছাড়া পাখি বিচরভ’মিগুলো যাতে মানুষের সমাগম না হয় সে দিকেও লক্ষ্য রাখছে বন বিভাগ।