আমেরিকা কেন আফগানিস্তান ছাড়ল? চীনের জন্য নতুন মঞ্চ সাজানো হলো?
গত শতাব্দীর আফগান শাসক মোল্লা ওমরের অনুসারীরাই কি আফগান ক্ষমতা দখল করল? বিশ্বের সকলের কাছেই আজকে সেই প্রশ্ন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক গোপন পরামর্শের ভিত্তিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালীন সিআইএ'র কর্মকর্তারা লাগাতার তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপে মিলিত হয়েছেন। ভবিষ্যতের আফগান শাসনের বিষয়াদি নিয়ে তালেবানরা মার্কিন প্রতিনিধিদের কি বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তারা সেই পুরনো তালেবান নয়? তাদের ২০ বছরে অনেকখানি পরিবর্তন সাধিত হয়েছে! যার আঙ্গিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর মধ্যে আফগানিস্তানে তাদের ভূমিকা নিয়ে নানা আলোচনা চলে। মার্কিন সেনাবাহিনী পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল তাদের ব্যর্থতার চিত্র। মার্কিন সেনাবাহিনী বুঝতে পেরেছিল, আফগানিস্তানে তারা যে সংস্কার শুরু করেছে, তা বাস্তবায়ন তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, প্রায় তিন কোটি দেশের জনসংখ্যার দেশ ধর্মীয় দর্শন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। নানা গোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় প্রভাব এত প্রকট যে, এর বাইরে একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থায় গড়ে তোলা একেবারেই অসম্ভব।
মার্কিন সেনাবাহিনী আফগানিস্তানের অবস্থা বুঝতে পেরেই প্রশাসনকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'সাফল্য' আফগানিস্তানে শূন্য। যেমনটি হয়েছিল ভিয়েতনামে। মার্কিন প্রশাসন দুই দশকে যে আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার খরচের তথ্য প্রকাশ করেছে, সেটা ভুল তথ্য। কারণ এই আড়াই ট্রিলিয়ন ডলারের বড় অংশ বিভিন্ন অস্ত্র উৎপাদনকারী ও ঠিকাদারদের হাত ঘুরে আবার যুক্তরাষ্ট্রেই ফেরত গিয়েছে। 'মানবসম্পদ উন্নয়নের' নামেও মোটা অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে ফিরত গিয়েছে। এই ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে আফগানিস্তানের কোনো অবকাঠামো, রাস্তাঘাট কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে কোনো খরচ করা হয়নি। এর পুরো টাকাটাই খরচ করা হয়েছে মূলত সামরিক খাতে। যার সুবিধাভোগী হচ্ছে মার্কিন অস্ত্র উৎপাদক ব্যবসায়ী সমিতি।
বরং ভারত এক্ষেত্রে তার সামর্থ্যের বাইরে আফগান সমাজকে সহায়তা করার চেষ্টা করেছে। আফগানিস্তানের পার্লামেন্ট ভবন নির্মাণসহ বেশকিছু অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থায়ন করেছিল দেশটি।
মার্কিন প্রশাসন জানে আফগানিস্তানে তাদের পরাজয় মানে আমেরিকার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেওয়া। চীন দীর্ঘকাল যাবত পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে তালেবানদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল।
চীন একদিকে পাকিস্তানের বন্ধু, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাজনৈতিক শত্রু। যদিও ইতিহাসটা এমন ছিল না। চীনের অর্থনৈতিক বিকাশের যাত্রা শুরু হয়েছিল পশ্চিমা বিশ্বের মুক্তবাজার অর্থনীতির কল্যাণে। যার প্রায় পুরোটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়। ১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন সফর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় চীনকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য বানানো- সবকিছুই ছিল মার্কিন উদ্যোগে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন মনে করেছিল, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে চীনকে ফেরত এনে নব্বইয়ের দশকে তারা এক বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে।
এই সাফল্য হয়তো ওই সময়ের জন্য ঠিকই ছিল। কিন্তু সময় বসে থাকেনি। এই লম্বা সময়ে মার্কিন অর্থনীতিতে চীনের প্রবেশ এত ব্যাপক মাত্রায় ঘটেছে যে, আজ মার্কিন উৎপাদন ব্যবস্থা চীনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। মার্কিন ভোক্তা আজ চীনে উৎপাদিত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল।
এই প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। গত ১০ বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্প 'আমেরিকা ফার্স্ট' স্লোগানের মধ্য দিয়ে ভোক্তা বাজারে চীনের রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করে। মার্কিন বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে নানাবিধ বাধার সৃষ্টি করা হয়। মার্কিন প্রশাসন কিছুটা সক্ষম হলেও এখনো তার সুফল মার্কিন অর্থনীতিতে দৃশ্যমান হয়নি। এমনি একটি পরিস্থিতিতে মার্কিনিদের আফগানিস্তান ত্যাগ করা এবং ফলশ্রুতিতে চীনের প্রবেশ প্রায় নিশ্চিত জেনেও মার্কিনিরা কেন আফগানিস্তান ত্যাগ করল? এ প্রশ্নটা সবার মনেই জেগেছে। কেন মার্কিনিরা চীনাদের জন্য এই সুযোগ সৃষ্টি করল?
এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এমন হতে পারে যে, মার্কিনিরা গত ২০ বছরে এই সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছে, বাইরের কোনো শক্তির পক্ষে আফগানদের দর্শন ও চিন্তায় সংস্কার আনা সম্ভব নয়। বাইরের শক্তির এই চেষ্টা করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফেরত আসার স্বাদ এর আগে পেয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, এবার পেল আমেরিকা নিজে এবং পরেরবার চীনের জন্যই এই মঞ্চ তৈরি করে রাখা হলো! এটা দেখতে আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে: আফগানিস্তান চীনের জন্য ফাঁদ হবে নাকি চীনের হাত ধরে আফগানিস্তান সত্যি কোনো পরিবর্তন দিকে যাবে।
দোহায় মার্কিনিদের সঙ্গে তালেবানের যে চুক্তি হয়ে থাকুক না কেন, আফগান রাষ্ট্রব্যবস্থায় মোল্লা ওমরের সেই চরমপন্থী ইসলামেরই পুনর্জাগরণ ঘটছে। নারী শিক্ষা থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে তারা প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও প্রকারন্তে নারী স্বাধীনতার বিষয়ে বা নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে নতুন নতুন কৌশলে তা সংকুচিত করা হচ্ছে। এমনকি তার প্রভাব প্রতিবেশী পাকিস্তানের উপরেও ব্যাপকভাবে পড়ছে। পাকিস্তান নারীদের পোশাকের ওপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
নারীর পর্দা ব্যবস্থা পুরুষদের প্রতি একটি অনাস্থা প্রকাশ করে। আফগান নারীরা যে ধরনের পোশাক পরতে বাধ্য হয়, তার মধ্য দিয়ে তালেবানদের যে মানসিকতার প্রকাশ ঘটে, তা পৃথিবীর প্রায় সকল প্রান্তে 'মানসিক বিকার' হিসেবে পরিগণিত হবে। এই ভূখণ্ডের পুরুষরা নারীদের কি কেবলই যৌনবস্তু হিসেবেই দেখে? সেই কারণেই কি নারীদের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে? এই কারণেই কি তারা নারীদের ঘেরা পর্দার অন্তরালে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য করে?
আফগানিস্তানের মতো এত তীব্র না হলেও অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে সংকট তৈরি হচ্ছে।
তালেবান শিক্ষামন্ত্রী ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন, সমাজের জন্য পিএইচডি বা মাস্টার ডিগ্রির প্রয়োজন নেই। আফগান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সেদিনও মাথার মূল্য ছিল ৫০ লক্ষ ডলার। ধারণা করা হয়, এইসব উগ্র ধর্মতত্ত্ব চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে সম্প্রচারিত হবে, তেমনি একটি বিশ্বাসের জায়গা থেকেই মার্কিনিরা আফগানিস্তান থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে নিয়েছেন।
জিনজিয়াং প্রদেশে চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তাদের উৎপাদিত তুলা। প্রায় ৮৫ শতাংশ তুলা উৎপাদিত হয় প্রদেশটিতে। চীনের টেক্সটাইল খাতের ব্যাপক প্রসারের প্রধান কারণ তাদের তুলা। উইঘুর সম্প্রদায়ের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে চীনের এক ধরনের সংকট চলছে। মার্কিনিরা ভাবছে, তালেবানি আন্দোলন উইঘুর সম্প্রদায়ের মধ্যে ইতোপূর্বে সম্প্রসারিত হয়েছে। তালেবানরা সেখানে তাদের ব্যাপক শক্তি বৃদ্ধি করবে, যার ফলে চীনের অর্থনীতির জন্য একটি বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হবে। এই বিশ্বাসের জায়গা থেকেই সম্ভবত মার্কিন রাজনীতিবিদরা আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে বলেই ধারণা করা যেতে পারে।
আফগানিস্তান ইস্যুতে এই দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু ভারত বিপজ্জনক অবস্থায় পতিত হয়েছে। ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তান ও চীন আফগান ভূখণ্ডের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ফলে ভারতের অবস্থা শূন্যে রূপান্তরিত হয়েছে। ভারতের বহু বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এখন এক সংকটের মুখে পড়েছে। এছাড়া আফগান লাগোয়া কাশ্মীরের মুজাহিদীন কিংবা অন্যান্য কাশ্মীরী মৌলবাদী ফ্রন্টকে তালেবানরা এবং তালেবানদের ছত্রছায়ায় আল-কায়েদা ঘনিষ্ঠ ভূমিকা রক্ষা করবে, তাও চূড়ান্ত প্রায়।
বর্তমান অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের আফগাননীতি অবশ্যই প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ সরকার তালেবানদের সামগ্রিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে রেখেছে। আফগানকে এখনই স্বীকৃতি দেওয়া নয়, এমন একটি নীতিতে রয়েছে।
আফগানি তালেবানি দর্শনের সমর্থক বাংলাদেশেও রয়েছে বলে আমাদের ধারণা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বিজয় উল্লাস প্রকাশ করছে। সেদিক বিবেচনায় বাংলাদেশের সতর্ক ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসনীয়। বাংলাদেশকে আরও গভীরভাবে আফগানিস্তানের সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করতে হবে।
বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে, এ দেশের ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী যেন কোনোভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। হেফাজতে ইসলাম নামক সংগঠন কিংবা এর আশেপাশে আরও অনেক সংগঠন তালেবানি মতাদর্শ ধারণ করে। অনেকে মনে করে, হেফাজত ইসলামের নেতৃত্বে পরিচালিত মাদ্রাসাগুলোকে নজরে রাখা দরকার। সরকারকে ২০১৪ সালের হেফাজতি তাণ্ডব ভুলে গেলে চলবে না।
মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা আদৌ বিশ্বের কোথাও কোনো ফল বয়ে আনেনি, আফগানিস্তান এই সময়ে তার বড় প্রমাণ।
-
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক