বিরোধিতার মধ্যেই বিদ্যুতের ‘কুইক রেন্টাল’-এর মেয়াদ বাড়ল পাঁচ বছর
বিদ্যুতের 'কুইক রেন্টাল' আরও পাঁচ বছর চালাতে বিল পাস হয়েছে সংসদে। বিরোধীদলের সদস্যদের তীব্র বিরোধিতার মধ্যেই 'বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন), ২০২১' বিলটি পাস হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জাতীয় সংসদে বিলটি পাসের জন্য তোলার পরপরই এর বিরোধিতা করেন বিরোধীদলের সাংসদরা। তাদের অভিযোগ, অসৎ উদ্দেশ্যে ও জনগণের টাকা কিছু ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এই আইন করা হচ্ছে।
জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, 'এই আইন আনার আমি কোন যুক্তি দেখতে পাই না। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু আমরা ১৩ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারছি। তাই এই মুহূর্তে আমার মনে হয় না আর বিদ্যুৎ প্রয়োজন আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আপনারা বিদ্যুতে অবকাঠামো তৈরি করেছেন গ্রামে-গঞ্জে। কিন্তু সেই সুফলটা পাই নাই। গরমের সিজনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। আমার এলাকার মানুষ ঘুমাতে পারে না। তারা আবস্থান-ধর্মঘট করেছে। আন্দোলন করেছে। অনেক অনুরোধ করে থামিয়ে রেখেছি।'
পল্লি বিদ্যুতের সাথে কথা হয়েছে উল্লেখ তিনি বলেন, তারা অনেক সময় বলেছে লাইন ভালো না।
প্রতিমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, 'আমাদের বাঁচান। বিদ্যুৎ যাতে ২৪ ঘণ্টা পাই, সেইজন্য প্রয়োজনীয় যা কাজ করতে হয়, লাইন নতুন করেন।'
চুন্নু আরও বলেন, 'পুরনো লাইন পরিবর্তন করে নতুন লাইনের আপনি কেন ব্যবস্থা করছেন না। সঞ্চালন লাইন নেই। পায়রার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কিনতে পারছেন না সঞ্চালন লাইন নেই বলে। ওইগুলো কেনেন। এই কাজ আগে করেন। এখন এই আইন কোনো দরকার নাই।'
একটি বিশেষ আইন ১৬ বছর কী করে থাকতে পারে জানতে চেয়ে জাতীয় পার্টির আরেক সাংসদ শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, এটা অস্থায়ী আইন হওয়ার কথা, জরুরি পদক্ষেপ। 'সরকার নিজেই বলছে শতভাগ বিদ্যুৎ হয়ে গেছে। কিন্তু তৃণমূলে ম্যানেজমেন্টের জন্য গালি খেতে হয়। এলাকায় বিদ্যুৎ থাকে না।'
তিনি আরও বলেন, 'আপনারা শতভাগ বিদ্যুৎ করেছেন, কিন্তু জনবল বাড়াননি। অল্প জনসম্পদ দিয়ে সেবা দিচ্ছেন। আমার এলাকার ৬০-৭০ কিলোমিটার একটা লাইন দিয়ে চলছে। ছোট্ট একটা ঝামেলা হলেই গোটা এলাকায় বিদ্যুৎ সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।'
এনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, 'এই আইন ২০১০ সালে করে বিদ্যুৎ ঘাটতি দূর করা হয়েছে। কিন্তু আরও পাঁচ বছর কেন বাড়ানো হচ্ছে? আমরা শতভাগ বিদ্যুতের কথা বলছি। এখনই ১৩০০০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অতিরিক্ত। এই বিদ্যুৎ আমরা কী করব? এই আইন করে আমরা অনিয়ম-দুর্নীতির বৈধতা দিচ্ছি।'
তিনি আরও বলেন, 'বিশেষ বিধান রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সাময়িক সময়ের জন্য করলেন। কিন্তু বিশেষ বিধান কেন ১৬ বছর ধরে চলবে? আজকে কেন আবার পাঁচ বছর? সর্বোচ্চ এই বছরের মধ্যে কাজ শেষ করেন। এছাড়া ঘোর আপত্তি থাকবে। বিশেষ বিধান এভাবে দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলতে পারে না।'
তিনি বলেন, 'রূপপুর, মাতারবাড়িতে বড় প্রকল্প করছি। এই যে বিশাল বিনিয়োগ, ঋণের বোঝা বাড়ছে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ প্রায় শেষ দিকে। বিভিন্ন দেশে এই ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে। এখন আপনারা জ্বালানি পরিবর্তন করছেন। বিরাট অঙ্কের টাকা সেখানে ব্যয় করতে হচ্ছে। এই যে অপরিকল্পিতভাবে মেগা প্রকল্পের ফাঁদে আপনারা পড়ে গেছেন এতে দেশ দেউলিয়া হয়ে যাবে।'
বিএনপির আরেক সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, 'এই আইনে কিছু মানুষের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। জনগণের টাকা কিছু মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হবে, কিন্তু তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না।
'বিশ্বে তেলভিত্তিক বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সবচেয়ে ব্যায়বহুল। সেইজন্য আপদকালীন সময় ছাড়া এই ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবহার হয় না। কিন্তু দেশে একটার পর একটা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে এবং দফায় দফায় এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
'যদিও বলা হয়েছিল ২০১২ সালের পর এর মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না। কিন্তু তারপরও আজকে বিল আনা হয়েছে আরও পাঁচ বছর মেয়াদ বাড়ানোর জন্য। অর্থাৎ মোট ১৬ বছর আমরা কুইক রেন্টাল চালাতে যাচ্ছি।'
রুমিন ফারহানা আরও বলেন, 'এই কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে টাকা বানানো এত সহজ হয়ে গেছে যে চাহিদা না থাকলেও তেলভিত্তিক এই কেন্দ্র স্থাপন চলছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতে প্রতি ইউনিটের মূল্য ৭ টাকা, সেখানে কুইক রেন্টালে ২০ টাকা—মানে তিনগুণ বেশি।'
রুমিন ফারহানা দাবি করেন, সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে কুইক রেন্টাল চালিয়ে কিছু ব্যবসায়ীর হাতে জনগণের কোটি কোটি টাকা তুলে দেওয়া।
তিনি বলেন, 'উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে গত এগারো বছরে বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে দশবার। এর পুরো বোঝা বইতে হয় জনগণকে।'
সাংসদ পীর ফজলুর রহমান বলেন, 'আমাদের এখন চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি। সেখানে কেন আমরা কুইক রেন্টালের মতো ব্যয়বহুল কেন্দ্রকে আইন করে দীর্ঘ সময় সুযোগ দেব। এতে জনগণের অর্থ ব্যয় হয়।'
সিলেট-২ আসনের সাংসদ মুকাব্বির খান এই আইনকে জঘন্য কালো আইন উল্লেখ করে বলেন, এখানে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে। তড়িঘড়ি করে করা হচ্ছে। জনগণের টাকা অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এই আইন।
বগুড়া-৭ আসনের সংসদ সদস্য মো. রেজাউল করিম বাবলু ভুতুড়ে বিল নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এর সাথে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
প্রতিবাদের জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, 'বিলটি নতুন করে আনা হয়নি। সময় বাড়ানো হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ যাতে দিতে পার্ সেজন্য এই আইন। ছয় মাসের মধ্যে যাতে কাজ করতে পারি, সেজন্য এই আইন। শতভাগ বিদ্যুতায়ন করেছি। এখন নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চাই। সঞ্চালন লাইন করতে গেলে সময় লাগবে।'
তিনি আরও বলেন, 'এটা কুইক রেন্টালের জন্য না। দ্রুত সরবরাহের জন্য এই আইন। আমাদের দ্রুত সঞ্চালন করতে হবে। মাটির নিচে যেতে হবে। আগামী তিন বছরের মধ্যে ঢাকা আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবে, সিলেট যাবে, খুলনা যাবে।'