বিদেশে নতুন কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করবে না চীন
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় চীন বিদেশে নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করবে না বলে জানিয়েছেন শি জিনপিং। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে নিজের দেওয়া বক্তব্য উল্লেখ করে মঙ্গলবার এ কথা জানান তিনি।
তিনি এ বিষয়ে কোন বিবরণ দেননি। তবে নীতিটি কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তার উপর নির্ভর করে এই পদক্ষেপটি উন্নয়নশীল বিশ্বে কয়লা উৎপাদনের অর্থায়নকে উল্লেখযোগ্যভাবে সীমিত করতে পারে।
বিদেশে কয়লা অর্থায়ন বন্ধ করার জন্য বেশ কূটনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছে চীন। কয়লার অর্থায়ন বন্ধ করলে তা কার্বন নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করবে। অর্থাৎ, জলবায়ু মোকাবেলার উদ্দেশ্যে তৈরি প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্য পূরণে ভূমিকা রাখবে এটি।
এই বছরের শুরুতে দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান কয়লা অর্থায়ন বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়ার পর অবশেষে শি জিনপিংয়ের এই ঘোষণা আসলো। তাছাড়া, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং মার্কিন জলবায়ু দূত জন কেরিও চীনকে এ দু'টি দেশের পথ অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
জাতিসংঘের বার্ষিক সমাবেশে তার প্রাক-রেকর্ডকৃত ভিডিও বক্তব্যে শি জিনপিং বলেন, "বনায়ন এবং সীমিত-কার্বন শক্তির বিকাশে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সমর্থন বাড়াবে চীন। একই সাথে বিদেশে নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করবে না তারা।" সেই সাথে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীনের শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যের ওপর জোর দেন তিনি।
তার এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে এটিকে "মহান অবদান" হিসেবে উল্লেখ করেন কেরি। চীনের এ সিদ্ধান্তকে আসন্ন সিওপি২৬ জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের জন্য একটি শুভ সূচনা হিসেবে বিবৃত করেন তিনি। উল্লেখ্য, স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে আগামী ৩১ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে এ সম্মেলন।
কেরি এক বিবৃতিতে বলেন, "আমরা চীনের সঙ্গে বেশ কিছু সময় ধরে এই বিষয়ে কথা বলছি। এবং প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা জেনে আমি বেশ আনন্দিত।"
এছাড়া, সিওপি২৬- এর প্রধান অলোক শর্মাও এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
টুইটারে তিনি বলেন, "বিদেশে নতুন কয়লা প্রকল্প নির্মাণ বন্ধ করার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট শির এ অঙ্গীকারকে আমি স্বাগত জানাই। আমার চীন সফরের সময় আলোচনার মূল বিষয় ছিল এটি।"
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার প্রথম জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়ার পর শি তার বক্তব্য দেন। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোন সরাসরি উল্লেখ করেননি তিনি। এছাড়া, বাইডেন প্রশাসনও জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন নীতিগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং বেইজিংকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করার চেষ্টা করছে।
এছাড়া, গত বছর শি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, চীন ২০৬০ সালের আগে কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জন করবে।
সেসময় কিছু বিশেষজ্ঞ সেই লক্ষ্যগুলোকে যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী নয় বলে সমালোচনা করেন। তবে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসার পর বেইজিং এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান অর্জন করে। প্রসঙ্গত, জলবায়ু পরিবর্তনকে "ধোঁকা" হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন ট্রাম্প। জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর বাইডেনের প্রথম পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস চুক্তিতে ফিরিয়ে দেওয়া।
বিশ্বের বৃহত্তম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশ চীন তার অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রয়োজনে এখনও কয়লার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
সানরাইজ প্রজেক্টের গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্র্যাটেজির পরিচালক জাস্টিন গুয়ে বলেন, "চীন ছিল কয়লা অর্থায়নে সর্বশেষ দেশ। যদি চীন থেকে কয়লার পাবলিক ফাইন্যান্স না থাকে, তাহলে বৈশ্বিক কয়লা সম্প্রসারণ হবে না।" কয়লার তুলনায় জীবাশ্ম জ্বালানিতে নির্ভরতা বাড়ানো নিয়ে কাজ করছে তার এ প্রজেক্ট।
এদিকে, কয়লা বিষয়ে শির পদক্ষেপ এবং মার্কিন কংগ্রেসের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে বাইডেনের প্রতিশ্রুতি, উভয়কেই স্বাগত জানান জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সহায়তা করতে ২০২৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের তহবিল দ্বিগুণ বাড়িয়ে প্রতি বছর ১১.৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন বাইডেন।
এক বিবৃতিতে গুতেরেস বলেন, "প্যারিস চুক্তির ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্যের কাছে যাওয়ার জন্য কয়লার জ্বালানি থেকে বিশ্বকে মুক্ত করা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।"
'মুক্তভাবে শ্বাস নিন'
শি জিনপিং এর ঘোষণার আগে চীনের নাম উল্লেখ না করে বাইডেন বলেছিলেন, স্বৈরতন্ত্রের দ্বারা গণতন্ত্র পরাজিত হবে না।
তিনি বলেন, "ভবিষ্যত তাদেরই হবে যারা তাদের মানুষকে মুক্তভাবে শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা দেয়, এবং তাদের লোহার হাত দিয়ে মানুষের শ্বাসরোধ করতে চায় না।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের সবাইকে অবশ্যই জাতিগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচনা করা ও তাদের নিপীড়নের নিন্দা জানাতে হবে। এসকল ঘটনা জিনজিয়াং বা উত্তর ইথিওপিয়া অথবা বিশ্বের যে কোনো প্রান্তেই ঘটুক না কেন, তা সমর্থন করা যাবে না।" উইঘুর এবং অন্যান্য মুসলিম সংখ্যালঘুদের জন্য অন্তরীণ শিবিরের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে চীনের পশ্চিম অঞ্চল। তবে, জিনজিয়াংয়ে মানুষের ওপর অত্যাচারের এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে চীন।
কোভিড-১৯ এর উৎপত্তি থেকে শুরু করে মানবাধিকারজনিত সমস্যা পর্যন্ত নানা বিষয় নিয়ে বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যকার সম্পর্ক বর্তমানে রয়েছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
এদিকে, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া 'অকাস' নামক নতুন ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় জোট ঘোষণা করার পর গত সপ্তাহে এই অঞ্চলে অস্ত্রের প্রতিযোগিতার তীব্রতা সম্পর্কে সতর্ক করেছিল চীন। উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক চালিত সাবমেরিন মোতায়েনের প্রযুক্তি এবং ক্ষমতা প্রদান করবে এ জোট।
অপরদিকে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশৃঙ্খল প্রত্যাহারের বিষয়ে বাইডেনের ভাবমূর্তি বিশ্বজুড়ে বিড়ম্বনা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধের সমাপ্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় সম্পদ এবং লক্ষ্যে ফিরিয়ে আনবে।
"বাইরে থেকে সামরিক হস্তক্ষেপ এবং তথাকথিত গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ফলে ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই হয় না," বলেছিলেন শি জিনপিং। আপাতদৃষ্টিতে তার এ বক্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেকে লক্ষ্য করেই দেওয়া।
- সূত্র- রয়টার্স