“ফেসবুকের মৃত্যুই আমাদের জন্য কাম্য”: কোম্পানিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে পাঁচ বিশেষজ্ঞের ভাষ্য
কংগ্রেসের সামনে সাক্ষ্য প্রদানের সময় সাবেক ফেসবুক কর্মী ফ্র্যান্সিস হাউগেন আইন-প্রণেতাদের হুশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, মার্ক জাকারবার্গের কোম্পানির লাগাম টেনে ধরতে চাইলে তাদের 'এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে'।
এই ঐতিহাসিক শুনানিতে ফেসবুক কীভাবে শিশুদের ক্ষতি করছে, মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডে অবদান রাখছে সেসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। তবে হাউগেনের এই শুনানির প্রভাব কীভাবে পড়তে পারে তা নিয়ে এখনো বেশ বিভক্ত আইন প্রণেতা, বিশেষজ্ঞ এবং নিয়ন্ত্রকরা।
এই শুনানির প্রভাব এবং ফেসবুকের ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে, তা নিয়ে প্রযুক্তি জগতের কয়েকজন বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে ইংলিশ দৈনিক গার্ডিয়ান। এ প্রতিবেদনে সেসব বিশেষজ্ঞের মতামত তুলে ধরা হলো।
'নজরদারি পুঁজিবাদ শিশুশ্রমের মতোই অনৈতিক'
—রজার ম্যাকনামি, প্রথমদিকের ফেসবুক বিনিয়োগকারী এবং রিয়েল ফেসবুক ওভারসাইট বোর্ডের সদস্য
ফ্রান্সিস হাউগেনের এই শুনানি ফেসবুকের জন্য খুবই বিধ্বংসী। তিনি সাহসী, প্রাসঙ্গিক এবং তার বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাসযোগ্য। এ সমস্যাগুলোর ব্যাপারে আমরা আগেও জানতাম, কিন্তু তিনি অভ্যন্তরীণ নথি সরবরাহ করে খেলা বদলে দিয়েছেন পুরোপুরি। তিনি প্রমাণ করেছেন, যে ভয়ানক সমস্যাগুলো আসতে যাচ্ছে তাদের ব্যাপারে ভালোভাবেই জানত ফেসবুকের ব্যবস্থাপনা পরিষদ। কিন্তু এরপরও তারা উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
হাউগেন জননিরাপত্তার চেয়ে মুনাফাকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় জাকারবার্গের নৈতিক ব্যর্থতার সমালোচনা করেছেন। এখন আমাদের বুঝতে হবে, এই সমস্যাটির ব্যাপ্তি ফেসবুকের চেয়েও অনেক বড়। সকল কোম্পানির প্রধান নির্বাহীকে বলা হয় যেকোনো মূল্যে শেয়ারহোল্ডারদের মূল্য বাড়ানোর জন্য। ফেসবুকের ব্যবসায়িক মডেলকে হার্ভার্ড অধ্যাপক সুশানা জুবফ নজরদারি পুঁজিবাদ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। নজরদারির মাধ্যমে আমাদের পছন্দ এবং আচরণের তথ্য ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে এই মডেল। এই মডেল উদ্ভাবন করেছিল গুগল। এখন অ্যামাজন, মাইক্রোসফট থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রতিটি সেক্টরের কোম্পানিই এই মডেল ব্যবহার করে। সেজন্য ব্যবহারকারীদের ক্ষতির আশঙ্কার কথা বিবেচনা করে অবশ্যই নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
এ ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় থাকার জন্য কংগ্রেসের শেষ যে অজুহাতটুকু ছিল, তাও সরিয়ে দিয়েছেন হাউগেন। তাদের এখন তিনটি ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন করতে হবে: গোপনীয়তা, নিরাপত্তা এবং প্রতিযোগিতা। গোপনীয়তার ক্ষেত্রে, কারো হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে সকল মানুষের। নজরদারি পুঁজিবাদ শিশুশ্রমের মতোই অনৈতিক, এবং একেও নিষিদ্ধ করা উচিত। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের স্বাস্থ্যখাতের মতোই কোনো অভিভাবক প্রতিষ্ঠান দরকার, যারা বলে দিবে পণ্য নিরাপদ কি না। আর মনোপলি বা একাধিপত্যের ক্ষতি কমাতে নতুন অবিশ্বাস আইন করা উচিত।
'ফেসবুকের মৃত্যুই আমাদের জন্য কাম্য'
—ইভান গ্রিয়ার, ডিজিটাল অধিকার সংগঠন ফাইট ফর দ্য ফিউচারের পরিচালক
এটাই হয়তো সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত যখন (ওয়াশিংটন) ডিসির আইনপ্রণেতারা শেষ পর্যন্ত চেয়ার থেকে উঠে বাস্তব কোনো তথ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করবেন। বর্তমানে নির্বাচিত কর্মকর্তাদের জন্য সবচেয়ে বড় দায়িত্ব এটিই- ফেসবুকের ক্ষতি কমানো। ফেসবুক যেসব অ্যালগরিদম ব্যবহার করে সেগুলোকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করাটা আসলেই কঠিন। তবে এই অ্যালগরিদমগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য যে সমস্ত ডাটা ব্যবহার করা হয়, সেগুলো সংগ্রহ করাকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন আপনি।
ফেসবুকের যে নজরদারি পুঁজিবাদী ব্যবসায়িক মডেল, সেটি তার মূলেই মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে মৌলিকভাবে বেমানান। সেজন্য ক্ষতি হ্রাস করবে এমন নীতির দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত আমাদের। বড় কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া ক্ষমতার কারণে হওয়া সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং গুরুতর ক্ষতিগুলোর সমাধানে গোপনীয়তা আইন এবং অবিশ্বাস প্রয়োগ নীতির মতো আইনগুলোয় জোর দেওয়া উচিত।
কিন্তু শেষ কথা হচ্ছে, আমাদের সবার ভালোর জন্য ফেসবুকের মৃত্যুটাই কাম্য। বিকেন্দ্রীভূত ও সম্প্রদায়ভিত্তিক বিকল্প নির্মাণের মাধ্যমে আমাদের ফেসবুককে অচল করে দিতে হবে। এবং এসব বিকল্পদের সিলিকন ভ্যালির ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার, এবং শেষ পর্যন্ত তাদেরকে প্রতিস্থাপন করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
'নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ'
—ফাদি কুরআন, অলাভজনক কর্মী গোষ্ঠী আওয়াজের ক্যাম্পেইন ডিরেক্টর
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাই হোক, ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিষয়টিই হোক, বা রোহিঙ্গা গণহত্যা হোক; প্রতিটি ঘটনার পরই ফেসবুক তাদের প্ল্যাটফর্মে খুঁটিনাটি কিছু পরিবর্তন এনে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের খুশি করতে সক্ষম হয়েছে। তবে বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং স্বল্প মাত্রায় মার্কিন সরকারও নীতিমালা প্রণয়নের একটি গতিবেগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাদের নজর যদি এবার ফেসবুকের দিকে পড়ে, তাহলে এই দুষ্ট চক্রের অবসান ঘটতেও পারে।
বল এখন আইনপ্রণেতাদের কোর্টে। ফেসবুকের লবিং শক্তি বেশ গভীর। নিজেদের স্বার্থ অনুসারে আইনপ্রণেতাদের প্রভাবিত করার সক্ষমতা আছে তাদের। তাই জো বাইডেন, ন্যান্সি পেলোসি এবং কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের এখন দায়িত্ব নিয়ে অ্যালগরিদম-ভিত্তিক স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতাকে জরুরী অগ্রাধিকার দিতে হবে। এবং এই বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যেন লবিংয়ের মাধ্যমে আইন প্রণয়নকে প্রভাবিত না করতে পারে সেজন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মানুষের জীবন, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
ফেসবুকের প্রতি মানুষের আস্থা দিন দিন কমছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কোম্পানিটি এখন একাধিপত্য বিস্তার করার পথে রয়েছে। এসব অ্যাপ বিশ্বের অনেক প্রান্তে ইন্টারনেটেরই প্রতিশব্দ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মেসেজিংয়ের জগতে কোনো বড়সড় ব্যাঘাত ছাড়া লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারী এই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দিবে, এই সম্ভাবনা নেই বলতেই চলে। তবে সম্প্রতি ইইউ'র ডিজিটাল সার্ভিসেস অ্যাক্ট, এবং মার্কিন কংগ্রেসের প্রস্তাবিত বেশ কয়েকটি বিল বড় প্রযুক্তির ক্ষতি থেকে মানুষকে উল্লেখযোগ্য সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা তৈরি করছে। কিন্তু ফেসবুক এবং অন্যান্য প্রযুক্তি কোম্পানির লবিস্টরা যে এসব নীতিমালা বানচাল করার জন্য সবরকমের চেষ্টা চালাবে, সেই ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে।
সংক্ষেপে, নীতিমালা প্রণয়নের জন্য সামনের বছরটি একটি ঐতিহাসিক বছর হতে যাচ্ছে। এবং ফেসবুকের চেহারা উন্মোচন করতে হাউগেনের দেওয়া সাহসী বিবরণী এই খাতে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব যোগ করেছে। তবে কার্যকরভাবে নীতিমালা প্রণয়ন করতে চাইলে রাজনীতিবিদদের ভালোভাবে সংঘটিত হতে হবে।
'আমার মনে হয় না এই ঘটনা ধারণাগুলোকে খুব বেশি পরিবর্তন করতে চলেছে'
—ড্যানিয়েল কাস্ত্রো, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশনের সহ-সভাপতি
আমার মনে হয় না এই ঘটনা আমাদের ধারণাগুলোকে খুব বেশি পরিবর্তন করতে চলেছে। যারা মনে করত ফেসবুক গণতন্ত্র রক্ষার জন্য, ভুল তথ্যের বিস্তার বন্ধ করতে অথবা গুণ্ডামি বন্ধ করতে যথেষ্ট কাজ করছে না, তারা এরকমই ভাবতে থাকবে। এবং এই মর্মে যুক্তি তৈরির জন্য তাদের হাতে এখন আরও রশদ থাকবে।
আমরা সবাই জানি, অনলাইনে খারাপ কর্মকাণ্ড ঘটছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ ব্যাপারে কী করা উচিত আমাদের? এবং এই জায়গাতেই বিতর্কটা বদলাবে বলে ধারণা আমার। কেউ কেউ চাইবে আরও নিয়ন্ত্রণ এবং তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা করতে। আবার অনেকেই চাইবে অবিশ্বাস আইন, তথ্য সুরক্ষা আইন বা শিশু সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে কোম্পানিটির পিছনে লাগতে। কোম্পানিটির প্রভাব নিয়ে আরও গবেষণাও হয়তো দেখব আমরা।
কিন্তু যেই প্রশ্নটি সবসময়ই টেবিলে ছিল, সেটি হচ্ছে, 'কোম্পানি কি সত্যনিষ্ঠটা বজায় রেখেছে?'
শুধু ফেসবুক নয়, এরকম যেকোনো কোম্পানির জন্যই এই প্রশ্ন। তারা কী করছে এবং তারা মুখে কী বলছে তা খুব কাছ থেকে দেখতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে এই দুইয়ের মধ্যে মিল আছে কি না। হাউগেনের আভ্যন্তরীণ গবেষণা দেখায় যে ফেসবুক বিতর্কিত কিছু সামাজিক বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছিল। দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সমালোচনা হচ্ছে এ নিয়ে যে যে তারা এই বিষয়গুলো উপেক্ষা করছে। কিন্তু এসব গবেষণা প্রমাণ করে যে তারা বিষয়গুলো ঠিক উপেক্ষা করছিল না, বরং ঘনিষ্ঠভাবে দেখছিল। এখন তারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট কাজ করেছে কি না সে প্রশ্ন থাকবেই। আমি মনে করি এই প্রশ্নে এখনো মানুষ যুক্তিসঙ্গতভাবে দ্বিমত পোষণ করতে পারে। এই একই জরিপে আরও দেখা গেছে, ফেসবুক কিশোর -কিশোরীদের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
'বেশিরভাগ মানুষই মনে করে সমস্যা আছে কিন্তু সমাধানের ব্যাপারে তারা একমত না'
—গৌতম হ্যান্স, ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী ক্লিনিকাল অধ্যাপক
২০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়ে আছে ফেসবুক। কিন্তু বেশ কয়েক দফা আইনি ঝামেলা পেরিয়ে, এবং আইনপ্রণেতাদের চক্ষুশূল হওয়ার পরও টিকে আছে কোম্পানিটি। কারণ বেশিরভাগ মানুষই মনে করে যে সমস্যা আছে, কিন্তু সমাধানের ব্যাপারে তারা একমত না।
গোপনীয়তা আইন পাস করা থেকে শুরু করে ফেসবুকের বিরুদ্ধে সব ধরণের আইনি প্রস্তাবের কথাই হয়তো শুনেছেন আপনি। এদের মধ্যে কিছু কিছু আইন কাজে আসতে পারে, কিছু পারে না…
আমি মনে করি ফেসবুক টিকে থাকবে। এটি খুব শক্তিশালী। এমন একটি জগতের কথা ভাবা কঠিন যেখানে ফেসবুকের অস্তিত্ব নেই। তবে কোম্পানিটির জনসাধারণের ধারণা বা কাঠামোতে পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছি আমি। কিন্তু ফেসবুককে নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় হাতিয়ারগুলোর মধ্যেই ত্রুটি রয়েছে।
আমি বলতে চাই না, কোনো আশা নেই। মিডিয়ার প্রচারণা, সক্রিয়তা, (ফেসবুকের) অসন্তুষ্ট কর্মচারীদের চাপ হয়তো যেকোনো আইনি কৌশলের চেয়ে বেশি কার্যকরী। ফেসবুক নির্বাহীরা স্পষ্টতই এখনো এটি ধরতে পারছেন না, কিন্তু এই মাপের একটি কোম্পানি বেশিদিন বালিতে মাথা রেখে থাকতে পারে না।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
- ভাষান্তর: কিরো আদনান আহমেদ