মহামারির ধাক্কায় গভীর সংকটে বিলাসবহুল হোটেল প্রকল্প
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে, হাতিরঝিলের কাছে, নবনির্মিত চার-তারকা হোটেল হলিডে ইন ঢাকা। ২০২০ সালের মার্চ থেকে অতিথিদের স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত ছিল হোটেলটি। কিন্তু করোনা মহামারি এসে সব প্রস্তুতিতে পানি ঢেলে দিল।
দেড় বছর পর ২০০ কক্ষবিশিষ্ট এই হোটেলের জিমনেশিয়ামটি এখন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং তার ছেলে সকালে ব্যায়ামের জন্য ব্যবহার করছেন। রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তায় নিযুক্ত কয়েকজন কর্মচারী ছাড়া আর সবাইকে ছাঁটাই করা হয়েছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হলিডে ইনের মতো অন্তত ১৭টি তারকা-ক্যাটাগরির হোটেল ২০২৫ সালের মধ্যে চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড মহামারির কারণে আপাতত হোটেলগুলো চালু করার পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছে। ১৭টি হোটেলের মধ্যে ১৩টি পাঁচ তারকা ক্যাটাগরির রয়েছে। এই হোটেলগুলোতে বিনিয়োগ হয়েছে ৬০০০ কোটি টাকা।
বনানীর শেরাটন হোটেলও গত বছর মার্চের শেষের দিকে খোলার কথা ছিল, কিন্তু মহামারিজনিত মন্দার কারণে তা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশে যেসব আন্তর্জাতিক হোটেল চেইন ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে তাদের মধ্যে রয়েছে হোটেল শেরাটন, হলিডে ইন, জেডব্লিউ ম্যারিয়ট, সুইসোটেল, হায়াত রিজেন্সি, এলিমেন্ট হোটেল, সেন্ট রেজিস হোটেল এবং ডুসিট হোটেল।
নতুন এই হোটেলগুলোতে ৩ হাজারের এরও বেশি কক্ষ থাকবে। হোটেলগুলোতে অন্তত ৬ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
স্থানীয় উদ্যোক্তারা সাধারণত তখনই বিলাসবহুল হোটেল তৈরি করেন, যখন আন্তর্জাতিক হোটেল চেইনগুলো প্রফিট-শেয়ারিং ব্যবস্থার অধীনে সেগুলো পরিচালনা করে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ধরনের হোটেলের ভবন তৈরির খরচের ৬০-৭০ শতাংশ ব্যাংক ঋণ দিয়ে মেটানো হয়। বাকি খরচ আসে ইকুইটি থেকে।
দ্য ওয়েস্টিন ঢাকা হোটেলের ম্যানেজার এবং দ্য ওয়েস্টিন ঢাকা ও শেরাটন ঢাকার বিক্রয় ও বিপণনের ক্লাস্টার ইনচার্জ মো. আল আমিন জানান, একটি তারকা ক্যাটাগরির হোটেলে প্রতি কক্ষের বিপরীতে ১.৭ থেকে ১.৮ জন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়।
তিনি আরও জানান, একটি তারকা ক্যাটাগরির হোটেলের একটা রুমের ইন্টেরিয়র ডিজাইনে খরচ হয় ন্যূনতম ৩০ লাখ টাকা। ২৫০ কক্ষবিশিষ্ট একটি পাঁচ তারকা হোটেল তৈরি করতে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা প্রয়োজন।
করোনাভাইরাসের কারণে চলমান প্রকল্পের কাজ থমকে গেছে জানিয়ে শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলেন, মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি হলেও নির্মাণকাজে এখনও গতি আসেনি। সামগ্রিক অর্থনীতি কবে কোভিডের ধাক্কা সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারবে, তা নিশ্চিত নয়। তাই হোটেলগুলো কবে চালু করতে পারবেন, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না উদ্যোক্তারা।
আসন্ন অনেক হোটেল প্রকল্পই এক বছর বা তারও বেশি পিছিয়ে গেছে। কারণ মহামারির মধ্যে বেশিরভাগ প্রকল্পের কাজই বন্ধ ছিল। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে উদ্যোক্তাদের ওপরও।
দ্য ওয়েস্টিনের ম্যানেজার মো. আল আমিন বলেন, 'কোভিড-১৯ সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে এবং আসন্ন হোটেলগুলো সময়মত চালু হওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।'
যদিও তারকা হোটেলগুলোর ব্যবসা ইতিমধ্যে চালু হয়েছে, পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তবে ব্যবসা মহামারি-পূর্ব পর্যায়ের অর্ধেক অবস্থায় ফিরে আসতে, অন্তত ২০২২ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিক লেগে যাবে বলে জানান তিনি।
তিন প্রকল্পে বিনিয়োগ ১৬শ কোটি টাকা:
রাজধানী ঢাকায় তিনটি- শেরাটন ঢাকা হোটেল, হোটেল হায়াত সেন্ট্রিক ও সেন্ট রেজিস হোটেল নির্মাণে ১,৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস।
মোট বিনিয়োগের ৪৫৭ কোটি টাকা লগ্নী করা হয় শেরাটন হোটেলে, ৫৩৩ কোটি টাকা হোটেল হায়াতে এবং ৬২১ কোটি টাকা সেন্ট রেজিসে।
"এরমধ্যে বনানীতে শেরাটন হোটেলটি চলতি মাস থেকেই চালু হওয়ার জন্য প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে, ইতোমধ্যেই আমরা প্রায় ৪০০ জন কর্মী নিয়োগ দিয়েছি। একইসাথে, নির্মাণাধীন পর্যায়ে রয়েছে সেন্ট রেজিস হোটেল, তবে কোভিড জনিত কারণে কাজের গতি কমে গেছে," যোগ করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, "ওয়েস্টিন রেসিডেন্স নামে পরিচালিত হবে, এজন্য হায়াত সেন্ট্রিক ঢাকা হোটেলের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। হোটেলটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর সব কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে।"
২০২৪ সাল নাগাদ কোম্পানিটি রাজধানীর গুলশানে তাদের ওয়েস্টিন রেসিডেন্স পাঁচ তারকা হোটেল চালুর পরিকল্পনা করছে। আর ২০২৫ সাল নাগাদ সাত তারকা সেন্ট রেজিস হোটেল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান আল আমিন।
অন্যান্য প্রকল্প:
আতিথেয়তা খাতে বিশ্বের অন্যতম বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল গ্রুপ। বাংলাদেশের মরিয়ম গ্রুপের সঙ্গে তারা যৌথভাবে ঢাকায় হলিডে ইন হোটেল নির্মাণ শুরু করে।
তবে মহামারির কারণে কর্তৃপক্ষকে হোটেলটি চালু করার পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছে। এমনকী গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে যান হোটেলটির জেনারেল ম্যানেজার ড্যানিয়েল লুদউইক।
এনিয়ে টিবিএস- এর সাথে আলাপকালে হোটেলের বিক্রয় এবং বিপণন শাখার প্রধান ধীরাজ রয় বলেন, আগামী নভেম্বর নাগাদ আমরা সীমিত আকারে (সফট লঞ্চ) কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা করছি। পুরোনো কর্মচারীদের ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি তারা নতুনদেরও নিয়োগ দিচ্ছেন বলে জানান।
রাজধানীর গুলশান-তেজগাঁও লিঙ্ক রোডে সুইসোটেল হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস নামে আরেকটি আন্তর্জাতিক চেইনের ৩৭৫টি কক্ষের একটি হোটেল নির্মাণাধীন রয়েছে।
সুইসোটেল ঢাকার স্থানীয় ব্যবসায়ীক অংশীদার বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অঙ্গ:প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল হোটেলস অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেড।
বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন এর আগে টিবিএস'কে বলেছিলেন যে, তাদের হোটেলটি ২০২২ সাল থেকে অতিথিদের জন্য উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে মহামারির কারণে নির্ধারিত সময়ে চালুর পরিকল্পনাও পেছানো হয়েছে।
২০২২ সাল নাগাদ গুলশানে হোটেল ওজিও নামে আরেকটি বিলাসবহুল পান্থশালা চালুর পরিকল্পনা করেছিল আমারি ঢাকা হোটেল। মহামারির কারণে এ প্রকল্পও পিছিয়েছে।
আমারি হোটেলের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, "হোটেলের অন্দরসজ্জার কাজের জন্য প্রাথমিকভাবে আমরা একটি ভবন ভাড়া নেই। তবে ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তের কারণে প্রকল্পটি বন্ধ রয়েছে।" অবশ্য তিনি এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যা করেননি।
এদিকে খুলনায় ১৫০ কক্ষের একটি বিলাসবহুল হোটেল যৌথভাবে নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল র্যাডিসন হোটেল গ্রুপ ও গ্রান্ড হোটেল অ্যান্ড হসপিটালিটি লিমিটেড।
২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে র্যাডিসন হোটেল খুলনা নামে এটি চালুর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। দেশের দ্বিতীয় সাড়ির বন্দর নগরীর প্রাণকেন্দ্রে বৃহৎ পান্থশালাটি নতুন আঙ্গিক যোগ করবে।
উইন্ডহ্যাম হোটেল গ্রুপ ব্র্যান্ডের হাওয়ার্ড জনসন হোটেলও ২০২২ সালে চালু হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর মহাখালীতে হোটেল ভবনটি নির্মাণ কাজ চলছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্যানুসারে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হোটেল ও রেস্তোরাঁ খাত ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। গেল অর্থবছরে যা ৭ দশমিক ১৩ শতাংশে নেমে আসে।
২০১৯ অর্থবছরে খাতটি ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে বলে বিবিএস সূত্র জানায়।
বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হোটেল ও রেস্তোরাঁ সেলের হিসাবে, বর্তমানে দেশে ১৭টি পাঁচ তারকা, ছয়টি চার তারকা এবং ২০টি তিন তারকা ক্যাটাগরির হোটেল রয়েছে।