ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ সমাজকে বিভক্ত করছে
কুমিল্লার ঘটনাটির পর থেকে দেশের নানা প্রান্তে যা ঘটছে তার শেকড় কোথায় তা আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীকে একটি ভিডিও কলে দেখা গেল। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলছেন, 'রাষ্ট্রধর্ম বলে কিছু নাই। '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে হবে।' তিনি আরো বলেন, 'জিয়াউর রহমানের ফরমানের কোনো কিছু আর বাংলাদেশে অবশিষ্ট থাকবে না।' মাননীয় মন্ত্রী, আপনাকে ধন্যবাদ। আমরা আশান্বিত এ কারণে, আপনি কোনো ক্ষোভ থেকে বা হঠাৎ করে কথাটি বলেছেন, তা মনে হয় না। আপনি সরকারের একজন মন্ত্রী এবং রাষ্ট্রের নীতি ও কৌশল প্রণয়নের সাথে যুক্ত। আমাদের সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এবং অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযুক্ত করা হয়। এই দুটি ঘটনা দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদের অস্তিত্বকেই সাংবিধানিকভাবে অস্বীকার করার শামিল। এই দুটি কাজের রূপকার দুই জেনারেল। জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ। ধর্মের মাধ্যমে সমাজে বিভাজন বা কেবল ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস সভ্যতার পরিপন্থী। মন্ত্রী মহোদয়ের ঘোষণা যেন 'রাজনৈতিক' বক্তব্য না হয়, সেটাই কাম্য।
ইসলাম ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিমদের মানসিকভাবে প্রতারণা করার জন্যই এটা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৭৯ সালে যখন এই কাজটি করা হয়, তখনও দেশে সংখ্যালঘুর সংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ। এরপর জেনারেল এরশাদ ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে যখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেন তখনও দেশটিতে ১৭-১৮ শতাংশ মানুষ অন্য ধর্মের। সুতরাং সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম হতে পারে না। পৃথিবীর কোনো কোনো দেশের উদাহরণ থাকলেও তাদের সংবিধানের মৌলিক নীতির সঙ্গে সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের অধ্যায়গুলোতে স্পষ্ট করে বলেছে, মানুষকে ধর্ম দ্বারা বিভাজন করা যাবে না। কুমিল্লার ঘটনার প্রেক্ষিতে সারা দেশে যে সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছে, তা নিন্দনীয় এবং শক্ত হাতে এটা দমন করতে হবে। প্রশাসনের কোনো ব্যর্থতা থাকলে সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।
নানুয়ার দীঘিতে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে দুই ধরনের মত পাওয়া যায়। নানুয়ার দীঘির পাড়ে সম্পূর্ণ অস্থায়ী মণ্ডপে প্রতি বছর পূজা হয়। ১০ দিনের জন্য নির্মিত মণ্ডপ পুজার পরপরই ভেঙে ফেলা হয়। এখানকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য অত্যন্ত গভীর। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে দেশের নানা প্রান্তে যে জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা বা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নাসিরনগর, সুনামগঞ্জ বা কুড়িগ্রামে বিভিন্ন সময়ে যে সাম্প্রদায়িক উসকানি বা অস্থিরতার ঘটনা ঘটেছে, তখনও কুমিল্লার নানুয়া অঞ্চলে সামান্যতম অস্থিরতার কোনো ঘটনা ঘটেনি। এখানকার পূজা-পার্বণে কখনোই প্রশাসনের সহায়তা নিতে হয়নি। বরং এবারই প্রথম কিছু সময়ের জন্য টহল পুলিশ দেখা গেছে, তা-ও ঘটনার আগের দিন। তাহলে কি পুলিশের কাছে কোনো আগাম আশঙ্কার খবর ছিল? তাহলে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়নি কেন?
অজুহাতের কোনো অভাব হয় না। অন্য ধর্মের প্রতি এই বিদ্বেষ, এটা কোনো ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে না। অন্য ধর্মমতের মানুষকে নির্মূল করে ফেলা কোনো ধর্ম অনুমোদন দেয় না। তারপরও বাস্তবতা হলো, ঘটনা থেমে নেই। ঘটছে একর পর এক। এর দায় আমরা কেউ এড়াতে পারি না। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবৃক্ষ রোপন করেন দুই জেনারেল সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে। কিন্তু পরবর্তীতে সংবিধানে ওই দুইটি সংশোধনী বাতিল করা হলেও সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও রাষ্ট্রধর্ম প্রসঙ্গটি বহাল রাখা হয়। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্যই সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। দুষ্কৃতকারীদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার দৃঢ় প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেছেন। অপরাধ করে কেউ রেহাই পাবে না বলেও উল্লেখ করেছেন। তবে যত্রতত্র গড়ে উঠা সব মণ্ডপে পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না, আগামীতে এটা নিয়েও ভাবতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন। তবে এটাও সত্য, পুলিশ বন্দুক তাক করে পাহারা দেবে আর মানুষ ধর্ম পালন করবে, এ দৃশ্য কল্পনা করাও কঠিন। সেই পথে যেন আমাদের যেতে না হয়। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, সামাজিক ঐক্যের খাতিরে আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম কী হবে, সেটা নিয়েও ভাবতে হবে। আমাদের হারিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। যেখানে ভিন্নমতের অনুশীলন হবে শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার সাথে। মানুষের পারস্পরিক বন্ধনের অন্যান্য উপায় বের করতে হবে। আমাদের দেশের হাজারো উৎসব ছিল যা দিয়ে সামাজিক বন্ধন তৈরি হতো। এগুলোই প্রকৃত বিকল্প যার মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় পরিচয় মজবুত হবে এবং সামাজিক নিরাপত্তা দৃঢ় হবে।
আশু করণীয় হিসেবে অনেক পদক্ষেপ নিতে হয় সত্য। কিন্তু ভাবনার মধ্যে স্থায়ী সমাধানের উপায় অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। পুলিশি ব্যবস্থা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এই লেখা যখন লিখছি, তখন জানলাম সারা দেশে মোবাইল ইন্টারনেট ডাটা প্রায় বন্ধ রাখা হয়েছে। কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়া এ ধরনের ব্যবস্থা গ্ৰহণ ভালো কিছু না। আমাদের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ছোটখাটো বহু আর্থিক কার্যক্রম এখন ইন্টারনেটকেন্দ্রিক। সেদিক থেকেও এটা বড় ক্ষতি। এরকম সিদ্ধান্ত নেবার আগে আরো হাজারটা বিকল্প নিয়ে ভাবা উচিত। রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের কারণে কারো ক্ষতি গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারকে অনেকসময় এরকম অ্যাডহক সিদ্ধান্ত নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়। এটা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি পরিপন্থী। দুর্বল গণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থায় এমনটি দেখা যায় মাঝেমধ্যে। এখানে সরকারের বিচক্ষণতাই শেষ কথা।
পাশের দেশ ভারতে অব্যাহতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া মুসলিম বিদ্বেষের বিষবাষ্প, গরু সংরক্ষণসহ নানা ইস্যু ভারতীয় সমাজকে বিভক্ত করছে। ভারতীয় বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী নির্যাতিত হচ্ছে। এ অবস্থা ভারতের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্যই অন্তরায়। যদিও নির্বাচনে জয়লাভ করার খুব সহজ কৌশল ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি করে মানুষের ভোটকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসা। ভারতে আমরা এমন ঘটনা বহুবার ঘটতে দেখেছি। বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময় কাশ্মীরের ঘটনা। সাম্প্রতিক পশ্চিমবাংলার নির্বাচনে বিজেপি যদিও তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাজিত করতে পারেনি, কিন্তু সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবাংলার বিধানসভার পরীক্ষিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তির বিদায় ঘটেছে। বিদায় ঘটেছে ৩৪ বছরের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি বামফ্রন্টের। বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসকে নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়ে এগোতে গিয়ে তৃণমূল পশ্চিমবাংলায় বিজেপিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক সময়, বিশেষ করে ২০১৩, '১৪ ও '১৫ সালে সংঘটিত সংঘাতগুলোতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অনেকে। আগুনবোমার নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনৈতিক দলের মধ্যে জামাত-হেফাজত ইসলামসহ আরো অনেকের নাম শোনা যায়। চূড়ান্তভাবে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলেও তাদের দর্শন এখনো দেশের আনাচে-কানাচে ব্যাপকতা লাভ করেছে। কুমিল্লার ঘটনা তারই প্রমাণ। সরকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করলেও একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে আতঙ্কের সৃষ্টি হলো, তা থেকে সহজে মুক্তি মিলবে না।
ভারত বিশাল জনগোষ্ঠীর ও অর্থনীতির দেশ। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠী সেখানে বসবাস করে। বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতিতে ভারতের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এই সাহসী বক্তব্যকে স্বাগত জানাই। ভারতের সাম্প্রদায়িক নিগ্রহের প্রভাব আমাদের এখানে পড়তে পারে। দুই দেশের নিজস্ব শান্তি, সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য একসাথে কাজ করবার প্রয়োজন রয়েছে। দুই দেশের সংবিধানেই ধর্মনিরপেক্ষতার যে কথা আছে, তা সমুন্নত রাখতে হলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পরিহার করতে হবে। এই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ সমাজকে বিভক্ত করছে।