ইয়াবার নিরাপদ রুট সিলেট
গত ২৫ জানুয়ারি সিলেটের বিয়ানীবাজারে অভিযান চালিয়ে এক হাজার পিস ইয়াবাসহ ফকির আলী নামে এক ভারতীয় নাগরিককে আটক করে পুলিশ। ফকির ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলার লাফাসাইল গ্রামের ইরমান আলীর ছেলে।
এর আগে গত ২৯ ডিসেম্বর বিয়ানীবাজারের সীমান্তবর্তী দুর্গম মুড়িয়া হাওর দিয়ে ইয়াবা পাচারের সময় বিনন্দ নমঃশুদ্র (৫৯) নামে আরেক ভারতীয় নাগরিককে আটক করে র্যাব-৯। বিনন্দ করিমগঞ্জেরই গোবিন্দগঞ্জ গ্রামের মৃত হরেন্দ্র নমঃশুদ্রের ছেলে। অভিযানে ৬৭০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে র্যাব। এ সময় ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে বিয়ানীবাজারের সুপাতলা গ্রামের সুভাষ দাশকেও আটক করা হয়।
বেশকিছুদিন ধরেই মরণনেশা ইয়াবার নতুন রুট হয়ে উঠেছে সিলেট। কক্সবাজারের বিভিন্ন সীমান্তের বদলে এখন সিলেটের কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে আসছে ইয়াবা। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশ ও র্যাব অভিযান চালিয়ে সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে ইয়াবা উদ্ধার করছে। তবে ইদানিং ইয়াবার সঙ্গে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে ভারতীয় পাচারকারীরাও। সম্প্রতি ইয়াবাসহ এমন দুজনকে আটকও করা হয়। ইয়াবা নিয়ে ভারতীয়দের বাংলাদেশে ঢুকে পড়ায় চিন্তিত নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারাও।
ঢুকে পড়ছে ভারতীয় পাচারকারীরাও
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-৯-এর এএসপি আনোয়ার হোসেন শামীম বলেন, এই অঞ্চল দিয়ে ভারত থেকে বেশকিছুদিন ধরে ইয়াবা বাংলাদেশে ঢুকছে। এ জন্য আমরা তৎপরতা জোরদার করেছি। পাচারকারীদের উপরও নজরদারি রাখছি। কিন্তু এখন দেখছি ভারতীয়রাও সরাসরি মাদক নিয়ে এদেশে ঢুকে পড়ছে। বিষয়টি আমাদের চিন্তায় ফেলেছে।
২৯ ডিসেম্বর ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে আটক বাংলাদেশি সুভাষ দাশের পরিচয়ও যথেষ্ট আশঙ্কা প্রকাশ করে এই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, সুভাষ একটি জুয়েলার্সের মালিক। বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতির আহ্বায়কও তিনি। ইয়াবা পাচার ও ব্যবসার সঙ্গে যেভাবে সাধারণ মানুষ জড়িয়ে পড়ছে তা উদ্বেগজনক।
সিলেটের চার সীমান্ত দিয়ে আসছে ইয়াবা
আইনশৃঙ্খলা ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর তথ্যমতে, সিলেট বিভাগের চার সীমান্ত দিয়ে দেশে সবচেয়ে বেশি ইয়াবা আসছে। সিলেটের জকিগঞ্জ ছাড়াও সুনামগঞ্জের মধ্যনগর ও ট্যাকেরঘাট এবং হবিগঞ্জের বাল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা আসছে বলে জানিয়েছেন তারা।
এতদিন বাংলাদেশে ইয়াবা প্রবেশের প্রধানতম রুট হিসেবে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত ধরা হতো। ওই সীমান্ত দিয়ে মায়ানমার থেকে আসত ইয়াবা। তবে ওই সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের ফলে টেকনাফ দিয়ে কমেছে ইয়াবার পাচার। এর পরিবর্তে সিলেটের চার সীমান্তকেই বেছে নিয়েছে মাদক পাচারকারীরা।
সিলেট বিভাগের চার সীমান্তের মধ্যে জকিগঞ্জ দিয়েই সবেচেয়ে বেশি ইয়াবা আসছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা। ২০১৮ সাল থেকে এসব সীমান্ত দিয়ে দেশে ইয়াবা আসা শুরু হয়। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি থেকে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে দেশে প্রথম ইয়াবা নিয়ে আসে কক্সবাজারের মাদক ব্যবসায়ীরা। এরপর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ইয়াবা পাচারের একমাত্র পথ ছিল কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের সমুদ্র এলাকা। ২০১৮ সালের শেষ দিক থেকে সিলেটের জকিগঞ্জসহ কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচার শুরু হয়।
ভারতের মিজোরাম রাজ্য থেকে মেঘালয় ও আসাম হয়ে সিলেটে ইয়াবা আসে বলে জানান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। এছাড়া সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্তের ওপারে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জে ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে বলে জানান তারা।
ইয়াবা পাচারে প্রভাবশালীরা
সিলেট জেলা পুলিশ ও র্যাব-৯ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত ছয় মাসে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে দুই শতাধিক ব্যক্তিকে। এরমধ্যে গত দুইমাসে প্রায় প্রতিদিনই সিলেটের কোথাও না কোথাও ইয়াবার চালান জব্দ হয়েছে।
সিলেট জকিগঞ্জ থানার ওসি মীর মো. আবদুন নাসের জানান, গত এক বছরে জকিগঞ্জ থানায় ৭০টির মতো ইয়াবাসংক্রান্ত মামলা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে আছেন যুবলীগ কর্মী, ইউপি সদস্যসহ কয়েকজন প্রভাবশালী।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঘনঘন ইয়াবা উদ্ধার হওয়ার ঘটনাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক জাহিদ হোসেন মোল্লা। তিনি বলেন, সিলেটের কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা আসা ইদানিং বেড়ে গেছে। এরমধ্যে জকিগঞ্জ দিয়েই সবচেয়ে বেশি আসছে। এ ব্যাপারে আমরা বারবার বিজিবি ও র্যাবের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের নজরদারি ও অভিযান বৃদ্ধির অনুরোধ করেছি। তারাও অনেকটা তৎপর হয়েছেন। ফলে সিলেট থেকে ইয়াবার অনেক বড় বড় চালান ধরা পড়ছে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন বাহিনীর কড়াকড়ির কারণে টেকনাফ দিয়ে ইয়াবা আসা কমে যাওয়ায় সিলেটের সীমান্তগুলোকেই নতুন রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা।
সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার সঙ্গে ভারতের প্রায় ৫৪ কিলোমিটারের সীমান্ত এলাকা। ভারতীয় অংশে পুরো সীমান্তেই কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ অংশে তেমন কোনো সুরক্ষা বেড়াই নেই। এই দীর্ঘ সীমান্ত এলাকায় দুই দেশকে বিভক্ত করেছে কুশিয়ারা আর সুরমা নদী। এই সীমান্ত পাহারা দেয় বিজিবির প্রায় ১৫টি বিওপি। নদীর তীর ধরে একটি বেড়িবাঁধ রয়েছে বাংলাদেশ অংশে। মূলত সেই বাঁধ ধরেই টহল দেন বিজিবি সদস্যরা। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে সেই বাঁধের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যানবাহন ব্যবহার সম্ভব হয় না। হেঁটেই বিজিবি সদস্যদের টহল দিতে হয়। আর এই সুযোগকে কাজে লাগায় চোরাকারবারীরা।
গডফাদারদের খোঁজে র্যাব
ইয়াবা আসার আগে এই সীমান্ত দিয়ে ফেনসিডিল, হেরোইন ও গরু চোরাচালানের অভিযোগ ছিল।
বিজিবি ১৯ ব্যাটেলিয়ানের অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইদ হোসেন বলেন, অনেকদিন ধরেই জকিগঞ্জসহ সিলেটের কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা আসা বেড়ে যাওয়ার খবর পাচ্ছিলাম। আমরা ওই সীমান্তে নজরদারিও বৃদ্ধি করেছি।
সাইদ হোসেন বলেন, সিলেট সীমান্ত দিয়ে ইয়াবার চোরাচালান রোধে বিজিবি ও বিএসএফ যৌথভাবে কাজ করছে। এরইমধ্যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে কয়েকবার বৈঠক করেছে বিজিবি। এছাড়া স্থানীয়দের মাঝে সচেতনতা তৈরিতে জকিগঞ্জে ইয়াবাবিরোধী লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, সিলেট ও ভারত দুই সীমান্ত এলাকায়ই রয়েছে বেশ কিছু ইয়াবা ব্যবসায়ী। এরসঙ্গে জকিগঞ্জ এলাকার অনেক জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিও জড়িত।
সূত্র জানায়, সিলেট অঞ্চলের খুচরা মাদক বিক্রেতাদের চাহিদা একত্রিত করে ফোনে সীমান্তের ওপারে বড় একটি চালানের অর্ডার দেন প্রভাবশালী বিক্রেতারা। ভারতে থাকা ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা পাঠানো হয় হুন্ডির মাধ্যমে। টাকা হাতে পেয়েই রাতের আঁধারে কাঁটাতারের উপর দিয়ে ইয়াবা পার করে দেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। আগেই সেখানে অবস্থান নেয়া পাচার কাজে ব্যবহৃত লোকজন তা বাংলাদেশে নিয়ে আসে।
এ ব্যাপারে র্যাব-৯-এর সিনিয়র এএসপি (গণমাধ্যম) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জকিগঞ্জকেই ইয়াবা পাচারের রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা। এ ব্যাপারে র্যাব জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে। ফলে গত কয়েক মাসে ইয়াবার বেশ কয়েকটি বড় চালান ধরা পড়েছে। মাদক ব্যবসায়ীরাও আটক হয়েছে। ইয়াবা পাচারের গডফাদারদের খোঁজে বের করতে আমরা তৎপর রয়েছি। আশা করছি শিগগরিই তাদের আটক করতে সক্ষম হব।
সিলেট জেলা পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন বলেন, ইয়াবা পাচারকারী, ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারী সকলের বিরুদ্ধেই আমরা অভিযান চালাচ্ছি। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।