কেমন ছিল নব্বইয়ের দশকের সেরা সুপারমডেলের জীবন, জানালেন ক্লডিয়া শিফার
১৯৮৭ সালের একদিন জার্মানির ডুসেলডর্ফে নিজ বাড়ির পাশের একটি নাইটক্লাবে বন্ধুদের সঙ্গে নাচছিলেন ক্লডিয়া শিফার। ওই মুহূর্তেই জনৈক অ্যাজেন্ট ১৭ বছর বয়সী ক্লডিয়ার দিকে এগিয়ে আসেন এবং তাকে মডেল হওয়ার প্রস্তাব দেন।
এর মাত্র কয়েক মাসের মাথায় জার্মানি থেকে সোজা প্যারিসে উড়ে যান ক্লডিয়া, প্রবেশ করেন ফ্যাশন ও স্টাইলের জমকালো জগতে।
ফরাসি ম্যাগাজিন 'এলে'র প্রচ্ছদে প্রথমবারের মতো আত্মপ্রকাশ করেন তিনি ১৯৮৯ সালে।
বিশ্বের সেরা সুপারমডেলদের একজন ক্লডিয়া শিফার জানালেন তার সেই অনুভূতি, 'এ ছিল অসাধারণ এক সময়। ফ্যাশন, সংগীত, শিল্প ও বিনোদন- সবকিছু মিলিয়ে যেন রোমাঞ্চকর ও প্রাণবন্ত এক জগত তৈরি হয়েছিল। ওই সময়টায় যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা হয়েছিল যেন!'
নব্বইয়ের দশকে আমেরিকান পোশাক নির্মাতা ব্র্যান্ড 'গেজ' জিন্সের মডেল হিসেবে নজরকাড়া ও আবেদনময়ী বিজ্ঞাপনে হাজির হয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ক্লডিয়া। বিজ্ঞাপনের ছবিগুলো তুলেছিলেন তার বন্ধু এলেন ভন আনওয়ের্থ। ওই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
'গেজ পারফিউমে'র জন্য নিজের প্রথম ক্যাম্পেইন ট্যুরের স্মৃতিচারণ করে বর্তমানে ৫১ বছর বয়সী ক্লডিয়া বলেন, 'মনে আছে, ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে কীভাবে আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শহরগুলোতে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম।'
'গেজে'র বিজ্ঞাপন এই সুপারমডেলকে এতটাই পরিচিত মুখ করে তুলেছিল, সাধারণ মানুষ তাকে এলোমেলো অবস্থায় দেখলেও চিনে ফেলত।
ডুসেলডর্ফের কুনস্টপালাস্ট জাদুঘরে নিজের কিছু বিখ্যাত শুটের ছবি এবং ক্যামেরার পেছনের কিছু ছবি প্রদর্শনের জন্য দিয়েছেন ক্লডিয়া। তার কয়েক শত ছবি সংবলিত এই ব্যক্তিগত প্রদর্শনী 'ক্যাপ্টিভেট! ফ্যাশন ফটোগ্রাফি ফ্রম দ্য নাইন্টিস' দর্শককে নব্বইয়ের দশকের ফ্যাশন সম্পর্কে দারুণ ধারণা দেবে।
ক্লডিয়ার ভাষ্যে, নব্বইয়ের দশক ছিল এমন একটি যুগসন্ধিক্ষণ- যা সৌন্দর্য্য ও ফ্যাশনের আদর্শকে সামনের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। আশির দশকের আপাদমস্তক গ্ল্যামারের দর্শন থেকে বেরিয়ে এসে তখন প্রকৃতিবাদ ও মিনিমালিজমের দিকে বইতে শুরু করে ফ্যাশনের ধারা। সে সময় স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বতন্ত্র আরও জোরালো হয়ে ওঠে এবং ক্লডিয়া সেটিই আলিঙ্গন করতে চেয়েছিলেন।
নিজের এমনই কিছু 'চিত্তাকর্ষক' ছবির পেছনের গল্প পাঠকদের জানিয়েছেন তিনি।
গেজ জিন্সের বিজ্ঞাপন, ১৯৮৯
১৭ বছর বয়সে এলেন ভন আনওয়ের্থের সঙ্গে প্যারিসে পরিচয় হয় ক্লডিয়ার। পম্পিদ্যুর কাছে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন দুই বন্ধু। এর কিছুদিন পরেই 'গেজ' ব্র্যান্ডের টিম তাদেরকে ১৯৮৯ সালের বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইনের জন্য প্রস্তাব দেয়।
গ্রীষ্মের রৌদ্রোজ্জ্বল এক দিনে ইতালির পিসাতে গেজ জিন্সের জন্য বিখ্যাত বাইসাইকেল ছবিটির শুট করা হয়। আলোকচিত্রী এলেন সেদিন ক্লডিয়াকে বলেছিলেন, গৎবাঁধা পোজের পরিবর্তে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যমতো অঙ্গভঙ্গি করতে। খালি পায়ে বাইসাইকেলের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন ক্লডিয়া, পরনে ছিল কালো সুইমস্যুট। দেখে মনে হচ্ছিল যেন সমুদ্র সৈকতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন!
ক্লডিয়া বলেন, 'আপনার মনে যখন বিশ্বাস ও ভরসা থাকে, তখন চাইলেই দুষ্টু-মিষ্টি ভঙ্গিমা প্রকাশ করা যায়।'
শ্যানেল ক্যাম্পেইন, ১৯৯০
মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিখ্যাত ফরাসি লাক্সারি ব্র্যান্ড 'শ্যানেলে'র নকশাকার কার্ল লেজারফেল্ডের সঙ্গে পরিচয় হয় ক্লডিয়ার। এর আগেই অবশ্য যুক্তরাজ্যের 'ভোগ' ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ঠাঁই পেয়েছিলেন তিনি। সেটি দেখেই ক্লডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন কার্ল।
এক বুক আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্যারিসে কার্লের স্টুডিওতে ঢুকেছিলেন ক্লডিয়া। তাই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে মডেল হিসেবে নির্বাচন করতে কোনো অসুবিধা হয়নি কার্লের। দুজনেই জার্মান ভাষায় কথা বলেছিলেন এবং কার্লের রসবোধ বেশ পছন্দ হয়েছিল এই সুপারমডেলের।
পরদিন সকালে দুভিলেতে পৌঁছান ক্লডিয়া ও বাকি কলাকুশলীরা। এই জায়গাটি 'শ্যানেলে'র প্রতিষ্ঠাতা কোকো শ্যানেলের জন্য একটি বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র হয়ে ছিল। ক্যামেরা হাতে দাঁড়ানো পাপারাজ্জিদের সামনে নির্ভয়ে গ্ল্যামারাস পোজ দিচ্ছেন ক্লডিয়া- এ রকম ছবিটি তুলেছিলেন কার্ল লেজারফেল্ড নিজেই।
কার্ল তার কাজকে ভালোবাসতেন। কখনো কখনো স্বপ্নের মধ্যেও তিনি তার পণ্যের নকশা আবিষ্কার করতেন এবং মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে উঠে তার স্কেচ আঁকতে বসে যেতেন! একইসঙ্গে একজন আলোকচিত্রী হওয়ায় ফ্যাশন পোর্ট্রেট তোলায় বিশেষ দক্ষতা ছিল তার।
ক্লডিয়াকে ফ্যাশন, সংস্কৃতি ও ছবি তোলা সম্পর্কে অনেক কিছু শিখিয়েছিলেন কার্ল। ক্লডিয়া নিজেই জানান, এসব ব্যাপারে কার্লের আগ্রহ ছিল আকাশচুম্বী। তিনি ক্লডিয়াকে পরামর্শ দেন, যেন সব সময় নিজের কাছে নিজে স্পষ্ট থাকেন এবং নিজের সহজাত প্রবৃত্তির ওপর রাখেন ভরসা।
ভারসাচি পোস্ট-রানওয়ে, ১৯৯৪
ইতালির 'ভোগ' ম্যাগাজিনের জন্য ক্যাটওয়াক শেষেই সোজা এই ছবি তোলার জন্য চলে গিয়েছিলেন ক্লডিয়া। ছবিতে অ্যাকুয়ারঙা পোশাকে পোজ দিয়েছেন তিনি এবং তার সঙ্গী হিসেবে আরও বেশ কয়েকজন মডেলও ছিলেন। 'ভারসাচি' ব্র্যান্ডের জন্য এই ছবি তুলেছিলেন মাইকেল কমতে।
দলগতভাবে শুট করা বেশ কঠিন, কারণ এখানে সব মডেলের অবস্থান ও অভিব্যক্তি ঠিক রাখতে হয়। কিন্তু মাইকেল অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই ছবিটির ভারসাম্য ধরে রাখেন।
ইউএস ভোগ শুট, ১৯৯৩
ক্লডিয়া শিফারের মতে, ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের 'ভোগ' ম্যাগাজিনের জন্য তোলা এই ছবি নব্বইয়ের দশকের ফ্যাশনের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আলোকচিত্রী হার্ব রিটসের তোলা ছবিটিতে আরও আছেন হেলেনা ক্রিস্টেনসেন, স্টেফানি সেমুর, ক্রিস্টি টার্লিংটন ও নাওমি ক্যাম্পবেল।
ক্লডিয়া বলেন, 'আমার এখনো মনে আছে, ওইদিন সেটে বসে আমি আর হেলেনা যষ্টিমধুর প্রকারভেদ নিয়ে কথা বলছিলাম। হেলেনা জানিয়েছিল, ডেনমার্কেই ওটা সবচেয়ে ভালো উৎপাদন হয় এবং আমি বলেছিলাম, আমার জন্য নিয়ে আসতে।'
ক্লডিয়ার প্রদর্শনীর ওপর ভিত্তি করে, তার নিজের সম্পাদিত বই 'ক্যাপ্টিভেট!' ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে পাওয়া যাওয়ার কথা রয়েছে।
-
সূত্র: নিউইয়র্ক পোস্ট