উত্তপ্ত বৈশ্বিক বাজার: জ্বালানি, সারের জন্য আরও ভর্তুকি নাকি মূল্যবৃদ্ধি?
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায়, জ্বালানি এবং সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলোর ক্রমবর্ধমান আমদানি মূল্য কীভাবে মেটানো যায় সে বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো।
অত্যাবশ্যকীয় এই দুই আমদানি খাতে বরাবরই ভর্তুকি দিয়ে এসেছে সরকার। তবে আমদানির খরচ অতিরিক্ত বাড়ায় কিছুক্ষেত্রে এ ভর্তুকির পরিমাণ বর্তমানের তিনগুণ পর্যন্ত হতে পারে। আবার বিশাল এ ভর্তুকির কথা চিন্তা করে পণ্যের দাম বাড়ালে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন গ্রাহকরা।
এরকমই একটি পণ্য হল ইউরিয়া সার। গত বছরের ডিসেম্বরে সৌদি আরব থেকে ৩০ হাজার টন ইউরিয়া আমদানিতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৬৬ কোটি টাকা। কিন্তু বুধবার একই দেশ থেকেই ১৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে সমপরিমাণ ইউরিয়া আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
অর্থাৎ, গত ১০ মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরিয়া সারের দাম বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। গত ডিসেম্বরে সৌদি আরব ও কাতার থেকে প্রতিটন ইউরিয়া আমদানি হয়েছে ২৬২ ডলারে, এখন আমদানি হচ্ছে প্রায় ৭৩২ ডলারে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিও সরকারি অর্থের ওপর একই রকম চাপ সৃষ্টি করেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে এ বছরের জানুয়ারিতে জ্বালানি তেলের দাম ছিল গড়ে প্রতি ব্যারেল ৪৯ ডলার। চলতি মাসে সেই তেলের দাম উঠেছে ৮৫ ডলারে কিছু বেশি। ২০১৪ সালের পর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম এই প্রথম প্রতি ব্যারেল ৮৫ ডলার ছাড়াল।
দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়া তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি'র দামও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ বিষয়ে বুধবার ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির একটি বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
বৈঠকের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, ভর্তুকির চাপ মোকাবেলা করতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে অর্থ কেটে এনে ভর্তুকি বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হলেও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে। ইউরোপের দেশগুলো জ্বালানি ব্যয় কমাতে লোডশেডিং ব্যবহার করছে উল্লেখ করে সভায় কেউ কেউ দেশে একই রকম উদ্যোগ নেওয়ারও প্রস্তাব দেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কিছুদিন আগেই দেশের ভেতরে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে এখন আবারও বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের মূল্য বাড়ানো যৌক্তিক হবে না বলে বৈঠকে মন্ত্রীরা একমত পোষণ করেন। এক্ষেত্রে ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়টিও আমলে নিচ্ছেন নীতি-নির্ধারকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ভর্তুকির ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান চাপ মোকাবেলার উপায় খুঁজে বের করতে আমরা আলোচনা করছি, কিন্তু এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।"
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা টিবিএসকে বলেছেন, এ প্রেক্ষাপটে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির চাপ মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণে আগামী সপ্তাহে পৃথক বৈঠকে আলোচনায় বসতে পারেন এই তিন মন্ত্রী। পরে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা নেবেন তারা।
কৃষিতে ভর্তুকি
বুধবার ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কাতার, সৌদি আরব ও দেশীয় কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) থেকে ৩০ হাজার টন করে মোট ৯০ হাজার টন ইউরিয়া সার কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। এ সময় সারের ভর্তুকির প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন কৃষিমন্ত্রী।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে কৃষিখাতে ৯৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে, এবছর ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে তিনগুণে উন্নীত হবে।
এ সময় অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার কৃষিমন্ত্রীকে বলেন, ২০১৯ সালে ডিএপি সারের দাম কমানোর সময় কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল যে, এ সারের দাম কমালে ইউরিয়ার ব্যবহার কমবে। বাস্তবে ইউরিয়ার ব্যবহার কমেনি, উল্টো ডিএপি'র ব্যবহার বেড়েছে। প্রতিকেজি ডিএপি সারে ৮৬ টাকা ভর্তুকি দিয়ে ১৬ টাকা দরে বিক্রি করে সরকার।
ইউরিয়া সারের ভর্তুকি কমানোর জন্য দেশের সার কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করে অধিক পরিমাণ সার উৎপাদনের বিষয়ে আলোচনা হয়। এতে সার আমদানির ভর্তুকির তুলনায় গ্যাসের ভর্তুকির পরিমাণ বেশি হবে বলে মত দেয় জ্বালানি মন্ত্রণালয়।
'ডিএপি সারের গুণ বেশি, অল্প ব্যবহারেই ফলন বেশি' এমন স্লোগানে পোস্টার ও মাইকিং করেছি আমরা, যাতে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমিয়ে কম পরিমাণে ডিএপি ব্যবহার করে কৃষক। কিন্তু প্রচারণার পর ডিএপি'র ব্যবহার দ্বিগুণ হয়ে গেছে'- জানান কৃষিমন্ত্রী।
তবে করোনা পরবর্তী এই সময়ে সারের দাম না বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে উপস্থিত মন্ত্রী ও সচিবরা।
ইউরিয়া উৎপাদনের মূল কাঁচামাল নাইট্রোজেন, যা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে পাওয়া যায়। বিশ্বজুড়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে ইউরিয়ার উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। গত অর্থবছর দেশের সার কারখানাগুলো ১০ লাখ টন উৎপাদন করেছে, যা মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ। বাকি ১৫ লাখ টন আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে সারে ভর্তুকি বাবদ মোট ৭,৭১৮ কোটি টাকা ব্যয় করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ওই বছর ২৪.৬৩ লাখ টন ইউরিয়া, ৫.২২ লাখ টন টিএসপি, ৭.৯৮ লাখ টন এমওপি এবং ১৪.২৪ লাখ টন ডিএপি সার ভর্তুকি মূল্যে কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করে সরকার।
জ্বালানি খাতে ভর্তুকি
আন্তর্জাতিক বাজারে চলতি মাসে ব্যারেল প্রতি ৮৫ ডলার যা চলতি বছরের শুরুতেই ছিলো ৪৯ ডলার।
প্রায় দেড় বছর কম দামে বিক্রির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তেল উত্তোলনকারী দেশগুলো দাম বাড়ানোর কৌশল হিসেবে দৈনিক তেল উত্তোলনের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সব ধরনের জ্বালানির দাম আরও কিছুদিন ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংকও।
গত সপ্তাহে সংস্থাটির প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড কমোডিটি আউটলোকে এমন আশঙ্কা করে বলা হয়েছে, কোভিড পরবর্তী উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি ও কয়লার দামও বাড়ছে। এতে আমদানি নির্ভর বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের কপালে ভাঁজ পড়ছে।
বুধবার অর্থমন্ত্রীকে নসরুল হামিদ জানান, আমদানি করা এলএনজির সঙ্গে দেশে উৎপাদিত গ্যাসের মিশ্রণ করলে প্রতি ঘনফুটে ব্যয় হয় ২২ টাকা, কিন্তু আমরা তা বিক্রি করি ৭-৯ টাকায়। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে প্রতি ঘনফুটে ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ৩২ টাকা। এতে এলএনজি আমদানিতেও সরকারের ভর্তুকি বিপুল পরিমাণ বাড়বে। একই অবস্থা জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেও।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এলএনজি আমদানিতে ৬০০০ কোটি টাকা এবং জ্বালানি তেল আমদানিতে ১০,০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হতে পারে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতে প্রায় ৯৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রেখেছে অর্থবিভাগ।