অসহায় কিডনি রোগীদের ভরসা ডা. কামরুল
দুবাইতে কর্মরত অবস্থায় ২০১৮ সালে দুটো কিডনিই ৫০ শতাংশ 'ড্যামেজ' হয়ে যায় কিশোরগঞ্জের সুজন মিয়ার (২৯)। সেখানে চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে না পেরে দেশে চলে আসেন। ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ের সামর্থ না থাকায় পরিকল্পনা করলেও ভারতে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য যাওয়া হয়নি। পরবর্তীতে পরিচিত একজনের মাধ্যমে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানী শ্যামলীর সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস এন্ড ইউরোলজি হসপিটালে (সিকেডি) মাত্র দুই লাখ টাকায় কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেন। বড় ভাই ফজলু মিয়ার একটি কিডনি নিয়ে এখন সুস্থভাবে বেঁচে আছেন সুজন।
সুজন মিয়ার মতই ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে দুটো কিডনি নষ্ট হয় আব্দুল আলীমের। স্থানীয় ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে আট মাস ডায়ালাইসিস, ইনজেকশন ও ওষুধে প্রায় দশ লাখ টাকা ব্যয় হয় তার। তারপর ডিসেম্বরে সিকেডি হাসপাতালে দুই লাখ দশ হাজার টাকা ব্যয়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করেন। তিন বছর ধরে দুই মাস পরপর ফলোআপ ট্রিটমেন্ট নিয়ে সুস্থ জীবনযাপন করছেন তিনিও। জীবিকা নির্বাহে এখন বিকাশ ও ফ্লেক্সিলোডের দোকান দিয়েছেন।
সুজন মিয়া ও আব্দুল আলীমের দেশের অধিকাংশ দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত কিডনি রোগীর বড় অংশ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার বা দেশের বাইরে যাওয়ার সামর্থ রাখেন না, এমনকি টাকার জন্য চিকিৎসাও করতে পারেন না অনেকে। স্বল্পমূল্যে অসহায় সেসব কিডনি রোগীদের ট্রান্সপ্ল্যান্টসহ উন্নত কিডনি ট্রিটমেন্ট দিয়ে আসছেন সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস এন্ড ইউরোলজি হসপিটালের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। দেশে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১০০৪টি কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা প্রথম চিকিৎসক তিনি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে অধ্যাপক ডা. কামরুল বলেন, "স্বচ্ছল জনগোষ্ঠীর জন্য দেশে অনেক বড় বড় বেসরকারি হাসপাতাল আছে, প্রয়োজনে তারা দেশের বাইরে গিয়েও চিকিৎসা নিতে পারে। কিন্তু এখনো দেশে ৮০% দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ আছে যারা সেসব হাসপাতালে যেতে পারেনা, তাদের জন্য আমাদের সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস এন্ড ইউরোলজি হসপিটাল"।
রাজধানীর শ্যামলীর ৩ নম্বর রোডে অবস্থিত ছয়তলার একটি সাদামাটা হাসপাতাল সিকেডি। আর দশটা করপোরেট হাসপাতালের পরিবেশ নেই সেখানে, কিন্তু স্বল্পমূল্যে উন্নত সেবা পায় দরিদ্র রোগীরা। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালটিতেই শুধু সপ্তাহে চারটি কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়।
ডা. কামরুল বলেন, "আমাদের হাসপাতালে করপোরেট হাসপাতালের মতো পরিবেশ দিতে পারিনা। কিন্তু মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়। এখানে সবচেয়ে ভাল ডায়ালাইসিস মেশিন আছে, চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্যও উন্নত মেশিন ব্যবহার করা হয়। সবাই স্বচ্ছল সোসাইটিকে সার্ভিস দিতে চায়, কিন্তু গরিব মানুষদের জন্য কেউ নেই। আমি তাদের জন্য তাই এ হাসপাতাল করেছি"।
স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা ও ফ্রি ফলোআপ
সিকেডি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপনে খরচ দুই লাখ দশ হাজার টাকা। এখানে ডোনার ও রোগীর অপারেশন খরচ, রোগীর কিডনি আইসিইউতে ১৪ দিন রাখা, ডোনারের হাসপাতালে ভর্তি থাকা, ওষুধ, ডাক্তার- সব খরচ যুক্ত থাকে। কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টে কোন সার্জন ফি নেন না ডা. কামরুল ইসলাম। একই ট্রান্সপ্ল্যান্টে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়।
সিকেডি হাসপাতালে কিডনির পাথর ফুটো করে বের করা, স্টোন ক্রাশ, কিডনি ক্যান্সার সার্জারি, প্রস্টেট সার্জারিসহ অন্যান্য ইউরোলোজিক্যাল সার্জিক্যাল ইন্টারভেনশন থেকে যে আয় হয়, তা থেকে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টে ব্যয় করা হয়। সেজন্য কম খরচে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে পারছে প্রতিষ্ঠানটি।
শুধু কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেই দায়িত্ব শেষ নয়, রোগীদের ফ্রি ফলোআপ টেস্ট করা হয়। প্রতি মাসে ৫০০-৬০০ রোগী এসে সাড়ে তিন লাখ টাকার ফ্রি টেস্ট করে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির চিকিৎসকেরা।
সুজন মিয়া প্রতি মাসে ও আব্দুল আলীম দুই মাস পরপর সিকেডিতে ফলোআপে এসে ফ্রি-তে সব টেস্ট করেন ও ডা. কামরুলকে রিপোর্ট দেখিয়ে যান।
ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, "ফলোআপের কারণে রোগীর কিডনি অনেক দিন সুস্থ থাকে। যদি ফলোআপ পরীক্ষার জন্য টাকা নেয়া হতো, তাহলে রোগীদের বড় একটি অংশ প্রতিস্থাপনের পর ফলোআপ পরীক্ষা করতে আসত না। তাতে অনেকেরই কিডনি নষ্ট হওয়ার শঙ্কা থাকত"।
৫০ বেডের সিকেডি হাসপাতালে আছে ২২ বেডের ডায়ালাইসিস ইউনিট। মাত্র ১৫০০ টাকায় ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা আছে। হাসপাতালটিতে আইসিইউ বেডের খরচ ৭ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা।
আগামী ৫ বছরে ১০০০ ট্রান্সপ্ল্যান্টের টার্গেট
২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট শুরু করেন ডা. কামরুল ইসলাম। ১৪ বছরে এক হাজার কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেছেন তিনি। আগামী ৫ বছরের মধ্যে ১০০০ কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার টার্গেট নিয়ে কাজ করছেন।
ডা. কামরুল বলেন, "আমাদের পাশ্ববর্তী দেশে প্রতিদিন ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয় কিন্তু আমাদের হাসপাতালে হয় সপ্তাহে চারদিন। আমরাও প্রতিদিন ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার লক্ষ্যে কাজ করছি। বছরে আড়াইশো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে চাই"।
নিজের হাসপাতালের পাশাপাশি প্রয়োজনে কিডনি ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করে দিয়ে আসেন এ চিকিৎসক। সেসব হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সদের ট্রেনিং দেয়া হয় সিকেডিতে।
তিনি বলেন, "আমি চাই সব হাসপাতালে ট্রান্সপ্ল্যান্ট হোক। কিডনি রোগীদের কষ্ট দূর হোক। ডায়ালাইসিসে রোগীদের কষ্ট ও খরচ বেশি হয়"।
মহামারিতেও কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট বন্ধ রাখেননি তিনি; করোনাকালে ২৫০টির বেশি কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেছেন।
কিডনি ডোনারদের নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা
ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, "আমরা এক হাজারের বেশি কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেছি তাই আমাদের এক হাজারের বেশি ডোনার আছে। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিতে আরো কাজ করার পরিকল্পনা আছে। ডোনারদের বছরে একবার কিডনি টেস্ট করা, তাদের কিডনির কোন সমস্যা হলে ফ্রি চিকিৎসা করা, এমনিকে তাদের কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন হলেও তাও করা হবে"।