পাকিস্তানের বিজয়ে আনন্দ করতে গিয়ে শ্রীঘরে
২৪ অক্টোবর ২০২১, রোববার। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের উদ্বোধনী ম্যাচ, পাকিস্তানের সঙ্গে। বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ দর্শক স্থির বসে আছে টিভির সামনে ম্যাচ দেখবে বলে। নাফিসা আত্তারির দুচোখও আঠার মতো সেঁটে রয়েছে টিভি পর্দায়।
উত্তর ভারতের উদয়পুরের এই স্কুলশিক্ষিকা টিভি পর্দায় ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের ১০ উইকেটের জয়ের সাক্ষী হন।
কিন্তু এর কদিন পরই তার ঠাঁই হলো কারাগারে। নাফিসার অপরাধ: পাকিস্তানের জয় উদযাপন করে দেওয়া তার হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাস।
শুধু নাফিসাকেই নয়, ওই ম্যাচে পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়ার জন্য আরও কয়েকজন মুসলিমকে গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে বাক-স্বাধীনতার নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠিয়ে দিল এই ঘটনা। পর্যবেক্ষকদের মতে, সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর জন্য এটা ক্ষমতাসীন উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির নতুন কৌশল।
২৪ অক্টোবর পাকিস্তানের কাছে ভারত হারার পর নাফিসা তার হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, 'জিত গ্যায়ে…. উই ওয়ান' (আমরা জিতে গিয়েছি)। সঙ্গে পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের জুড়ে ছবি দেন।
হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাসটি নাফিসার এক ছাত্রের বাবার নজরে আসে। তিনি অন্য অভিভাবকদের কাছে তা পাঠিয়ে দেন। এরপর স্ট্যাটাসটি ভাইরাল হয়ে যায়।
এর জেরে স্কুলের চাকরি খোয়ান নাফিসা। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩ বি (জাতীয় সংহতি বিরোধী) ধারায় গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। আদালতে তোলা হলে নাফিসার জেল হয়।
স্থানীয় এক টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাফিসা তার 'অপরাধে'র জন্য ক্ষমা চান।
তিনি বলেন, 'সেদিন একজন আমার স্ট্যাটাস দেখে হোয়াটসঅ্যাপেই জানতে চেয়েছিলেন, আমি পাকিস্তানকে সমর্থন করছি কি না। সঙ্গে কিছু হাসির ইমোজিও ছিল। মনে হয়েছিল হালকা মেজাজে মজা করে আমাকে প্রশ্নটা করা হয়েছে। আমিও হাসতে হাসতেই বলেছিলাম, "হ্যাঁ"।
'কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, আমি পাকিস্তানকে সমর্থন করি। আমি ভারতীয়। ভারতকে ভালবাসি।'
আপাতত জামিনে মুক্ত নাফিসা এখন বাড়িতে স্বামী ও সন্তানের সঙ্গে রয়েছেন। সেইসঙ্গে আইনি লড়াই চালাচ্ছেন।
নাফিসার আইনজীবী রাজেশ সিংভি বলেছেন, 'পুলিশ সম্পূর্ণ ভুল কাজ করেছে। কেউ ভুল করলে, বা কেউ কারও সঙ্গে একমত না হলে সেটাকে কখনোই দেশদ্রোহিতা বলা যায় না। এটা আমাদের সংবিধানবিরোধী।'
হিন্দু সংগঠন বজরং দলের সদস্য রাজেন্দ্র পারমারও নাফিসার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন।
তিনি বিবিসিকে বলেন, 'এসব লোকেদের পাকিস্তানে চলে যাওয়া উচিত। ভারতে থাকছ, রোজগার করছ, আর জয় উদযাপন করছ পাকিস্তানের! এটা তার জন্য [উচিত শিক্ষা] হওয়া উচিত। উনি স্কুলে পড়ান। ছাত্রছাত্রীদের উনি কী শিক্ষা দেবেন?'
পারমারের এই মন্তব্য ভারত-পাকিস্তানের দা-কুমড়া সম্পর্ককেই তুলে ধরছে। কাশ্মীরের দখল নিয়ে দুদেশের সম্পর্কে প্রায় সবসময়ই টানটান উত্তেজনা বিরাজ করে।
পাকিস্তান ক্রিকেট টিমকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগে কাশ্মীরে একদল মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধেও কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় মামলা করা হয়েছে।
অনলাইনে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা গেছে সাবেক বিজেপি বিধায়ক বিক্রম রান্ধাওয়া বলছেন, কাশ্মীরের ওই শিক্ষার্থীদের 'জ্যান্ত অবস্থায়ই চামড়া তুলে' নেওয়া উচিত। সেইসঙ্গে পাকিস্তানপন্থি স্লোগান দেওয়ার অপরাধে তাদের ডিগ্রি ও নাগরিকত্বও কেড়ে নেওয়া উচিত।
বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানোর অপরাধে রান্ধাওয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে পুলিশ। বিজেপিও তাকে তিরস্কার করেছে এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে বলেছে।
তবে বিজেপির অনেক সিনিয়র নেতাই পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়া ব্যক্তিদের ভালো চোখে দেখছেন না। অনেকে তো এই কাজকে অপরাধ হিসেবেই গণ্য করেছেন।
ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং বর্তমানে বিজেপির সাংসদ গৌতম গম্ভীর বলেছেন, যারা পাকিস্তানের জয় উদযাপন করেছেন, তারা অত্যন্ত 'লজ্জাজনক' কাজ করেছেন।
গম্ভীর টুইটারে লিখেছেন, 'পাকিস্তান জেতায় যারা বাজি ফাটাচ্ছেন, তারা ভারতীয় হতে পারেন না। আমরা ভারতীয় দলের পাশে আছি।'
নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ সহচর এবং ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পাকিস্তানের জয় উদযাপন করলে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযোগ দায়ের করা হবে। পরে তিনি এ নিয়ে টুইটও করেন। সেই পথে হেঁটেই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের পরে আগ্রায় তিন কাশ্মীরি শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
শাসক দলের এরকম কাজকে হিন্দু ভোট বাগানোর কৌশল হিসেবে দেখছেন অনেক বিশ্লেষক। তাদের মতে, গোহত্যা, হিন্দু-মুসলিম বিয়ে, পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়া ভারতীয়—এই বিষয়গুলোকে বিজেপি নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
নাফিসাসহ অন্যান্য মুসলিমদের গ্রেপ্তারকে সমর্থন করে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা কাঞ্চন গুপ্ত বিবিসিকে বলেন, 'তারা ভারতের হার উদযাপন করছিলেন। এ ধরনের যেকোনো ঘটনা যেকোনো সময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে পারে, বড় ঘটনা ঘটতে পারে। তাই যেভাবেই হোক, এগুলো বন্ধ করতে হবে।'
উত্তরপ্রদেশে সাতজনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের জয় উদযাপনের অভিযোগ আনা হয়েছে। পুলিশ বলছে, তারা ভারতীয় ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধে অবমানকাকর কথা ও দেশবিরোধী মন্তব্য করেছেন।
অভিযুক্তদের তিনজন—আরশাদ ইউসুফ, ইনায়াত আলতাফ শেখ ও শওকত আহমেদ গনাই—জেলে আছেন। তিনজনই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। তাদের সবাইকেই কলেজ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রত্যেকেই আইনজীবী খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছেন।
শহরের ইয়াং লইয়ারস অ্যাসোসিয়েশন-এর প্রেসিডেন্ট নিতিন ভার্মা বলেছেন, 'ওই ছাত্ররা ভারতে বাস করে পাকিস্তানের জয় উদযাপন করছিল, তাই আমরা ওদের কোনো আইনি সহায়তা দেব না।'
তিনি বলেন, 'এটা আমাদের দেশ ও জাতিবিরোধী কাজ। আমাদের দায়িত্ব ওদের বিরোধিতা করা, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজে আর কেউ উৎসাহিত না হয়।'
ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ ঘিরে এরকম ঘটনা এ-ই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৪ সালে একই কারণে উত্তরপ্রদেশে ৬০ জন কাশ্মীরি ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও পরে তাদের ওপর থেকে অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়।
ক্রিকেট সাংবাদিক শারদা উগ্রা প্রশ্ন তুলেছেন, 'প্রতিপক্ষ ক্রিকেট টিমকে সমর্থন দেওয়া কবে থেকে আইনের চোখে অপরাধ হয়ে গেল?
'যুক্তরাজ্য বা অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদেরও কি তাহলে ভারতকে সমর্থন দেওয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার করা উচিত? এটা নিঃসন্দেহে সচেতনভাবে সৃষ্টি করা ধর্মীয় বিভাজন, যা দুই পক্ষকেই উত্তেজিত করছে।'
শুধু ভারতে নয়, একই ঘটনা ঘটার উদাহরণ আছে সীমান্তের ওপারেও। ২০১৬ সালে কোহলিভক্ত এক পাকিস্তানিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি পাকিস্তানে বসে ভারতের জাতীয় পতাকা নিয়ে কোহলীকে সমর্থন করছিলেন।
- সূত্র: বিবিসি