জুলাই-অক্টোবরে ভারতে রপ্তানি বেড়েছে ৬৫%
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ দুই-তৃতীয়াংশ বেড়ে ৭০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
এর মাধ্যমে বাংলাদেশের শীর্ষ ৬ রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় ঢুকে পড়েছে প্রতিবেশি দেশটি।
ভারতে রপ্তানি এই হারে বাড়তে থাকলে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় প্রথমবারের মতো দুই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর কর্মকর্তারা।
২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রথমবারের মতো ১ বিলিয়ন ডলারের সীমা ছাড়িয়ে ১ দশমিক ২৮ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছিল।
এদিকে বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় গন্তব্যস্থল যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির এক-পঞ্চমাংশের গন্তব্যস্থল দেশটিতে উচ্চহারে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি জার্মানী, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের দেশগুলোতে রপ্তানি বাড়ায় অক্টোবরে লক্ষমাত্রা টপকে ৬০% প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারি কাটিয়ে দেশগুলোর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোয় আগামী দিনগুলোতেও এসব দেশে পণ্য রপ্তানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি আশা করছেন রপ্তানিকারকরা।
ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রধান বাজার ও প্রধান পণ্যগুলোর রপ্তানি বেড়েছে। বিশ্বজুড়ে কোভিড সংক্রমণ কমে যাওয়া এবং রপ্তানি পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। আশা করছি, আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জুলাই-অক্টোবর সময়ে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০ মিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৪২৫ মিলিয়ন ডলার।
ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ টিবিএসকে জানান, যদি প্রবৃদ্ধির বর্তমান প্রবণতা বজায় থাকে, তাহলে বর্তমান অর্থবছরেই রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করবে।
ভারতকে বিশ্বের অন্যতম রপ্তানিকারক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতে তৈরি পোশাক থেকে শুরু করে খাদ্য দ্রব্য বিভিন্ন ধরনের নতুন পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা উপকৃত হচ্ছেন। তিনি জানান, পাট এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিও এ বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মাতলুব আহমাদ আরও যোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো গতানুগতিক বাজারের পাশাপাশি বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা বর্তমানে ভারতের উপরও মনোযোগ দিচ্ছে, যেন তারা ভারতে ২৫টি পণ্য বাদে আর সকল পণ্যের শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধার ফায়দা লুটতে পারেন।
কম শিপিং চার্জও ভারতে রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ার আরেকটি বড় কারণ বলে জানান তিনি।
"মহামারির কারণে আন্তর্জাতিকভাবে শিপিং চার্জ বেড়ে তিনগুণ হয়েছে। কিন্তু যেহেতু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত রয়েছে, তাই ভারতীয় আমদানিকারকরা অতিরিক্ত খরচ কমাতে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানিতে উতসাহী হচ্ছেন। এর কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতে রপ্তানির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে," তিনি বলেন।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)-এর সাবেক সভাপতি আরও জানান যে চলমান যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধই ইউরোপীয় দেশসহ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের উচ্চ রপ্তানি প্রবৃদ্ধির প্রধান কারণ।
"আন্তর্জাতিক শিপিং ও লজিস্টিকস চেইন ভেঙে পড়ায়ও পশ্চিমা দেশগুলোতে চীনের রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে উপকৃত হচ্ছে বাংলাদেশ। ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।"
প্রধান পণ্যগুলো ভারতে রপ্তানি বৃদ্ধির বড় কারণ
ইপিবি'র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বছরে ৫ বিলিয়ন ডলারেরও অধিক বাণিজ্য ঘাটতি থাকা ভারতের বাজারে এবার বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ৬৪.৭০%, যা গত চারমাসে দেশের প্রধান ২০টি রপ্তানি বাজারের মধ্যে সর্বোচ্চ।
গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৩.৩১% রপ্তানি হয়েছিল ভারতে, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.৪৪%। ভারতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য ওভেন, নিটওর্য়ার, পাট ও পাটজাত পণ্য, কটন ও কটন প্রোডাক্টস, প্লাস্টিক পণ্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বিশেষ করে এবছর কোরবানীর সময় ওয়েট ব্লু রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া এবং বাংলাদেশ ও ভারতে পাটের সংকট দেখা দেওয়ায় এ দু'টি পণ্য রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
তবে ইপিবি এখনও অক্টোবরের জন্য পণ্যভিত্তিক উপাত্ত প্রস্তুত করেনি। তারপরও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে ভারতে রপ্তানি উপাত্তের একটি বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, উচ্চ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি মূলত সংঘটিত হয়েছে প্রধান কয়েকটি রপ্তানি পণ্য - যেমন ওভেন পোশাক ও নিটওয়্যার, পাট ও পাটজাত পণ্য, তুলা ও তুলাজাত পণ্য, প্লাস্টিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের কারণে।
বিশেষত, ঈদ-উল-আযহার সময়ে ওয়েট ব্লু চামড়ার অনুমোদন এবং উভয় দেশেই পাটের সংকট এই দুইটি পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলেছে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
যুক্তরাষ্ট্রে বাজার বৃদ্ধি
গত বছরের জুলাই-অক্টোবরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার বেড়েছে। ফলে চার মাসেই দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আগের বছর এই সময়ে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ১৮ শতাংশেরও কম রপ্তানি হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিতে। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯.৫০% এ।
কোভিড সংক্রমণের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বড় ধরণের হোঁচট খাচ্ছিল। আগের অর্থবছর রপ্তানি কমার পরও গত অর্থবছর যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশেরও কম। মহামারী পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পর থেকেই ওভেন, নিটওয়্যার ছাড়াও ক্যাপ, হোম ট্যাক্সটাইল ও ক্রাস্টেসিয়ানস রপ্তানিও উচ্চ হারে বাড়ছে।
দৃঢ় হচ্ছে ইউরোপের বাজারও
যুক্তরাষ্ট্রের পরে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য হয়েছে জার্মানী, যুক্তরাজ্য, স্পেন ও ফ্রান্সে। এই চারটি দেশের অক্টোবর পর্যন্ত চারমাসে প্রবৃদ্ধির হার দুই অংকের ঘরে। এর মধ্যে জার্মানীতে ১৩.২৮% প্রবৃদ্ধি হয়েছে। শীর্ষ ২০ রপ্তানি বাজারের মধ্যে থাকা ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে ইটালীতে, ৫.৪৩%।
চলতি অর্থবছর ইউরোপের দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানিতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও স্পেনে। এর মধ্যে পোল্যান্ডে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৩১%, নেদারল্যান্ডে ২৭% ও স্পেনে ২২.৫৩%।
চীনা বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা
এশিয়ার বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীনে ৯৭% পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাওয়ার সুফলও ভোগ করতে শুরু করেছে ঢাকা। দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার ১১.৯৪%। এই সময়ে জাপানেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩% এর বেশি। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ২১০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। রাশিয়াতে রপ্তানি এক-চতুর্থাংশ বেড়ে ২০৭ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
চলতি অক্টোবর মাসে প্রোডাক্টওয়াইজ রপ্তানি তথ্য এখনও প্রস্তুত করেনি ইপিবি। তবে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনমাসে ভারতে রপ্তানি তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য রপ্তানিতেই চলতি অর্থবছর উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
সম্ভাবনা দেখাচ্ছে নতুন বাজারগুলো
ইপিবি'র তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সব মিলিয়ে জুলাই-অক্টোবর সময়ে বাংলাদেশের প্রধান ২০টি বাজারের ১৯টিতেই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। শুধু এই সময়ে শুধু তুরস্কে রপ্তানি কমে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় অর্ধেক কমে ১০৩ মিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
বাংলাদেশের প্রচলিত রপ্তানি বাজারগুলোর তুলনায় অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হয়েছে বলে জানান ইপিবির কর্মকর্তারা। তারা জানান, প্রধান ২০টি রপ্তানি বাজারের বাইরে অপ্রচলিত বাজারগুলোতে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে ৩৯.৪২%।
গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে নতুন বাজারে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১.৩৮ বিলিয়ন ডলার, যা এবার বেড়ে ১.৯৩ বিলিয়নে পৌঁছেছে।
চলতি অর্থবছর ৪৩.৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে রপ্তানি হয়েছে ১৫.৭ বিলিয়ন ডলার। এটি চার মাসের লক্ষমাত্রার তুলনায় ১৩.৩৩% বেশি।
রপ্তানিকারকরা কী বলছেন
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-র সহ-সভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, "কোভিড-১৯ এবং মিয়ানমারে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও চীনে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভিয়েতনাম ও ভারতের রপ্তানি বিপর্যয় হয়। তাই আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো থেকে অনেক ওয়ার্ক-অর্ডার (কার্যাদেশ) আমাদের কাছে চলে এসেছে এবং আমাদের এখানে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।"
তিনি আরও যোগ করেন, "আমাদের কাছে এখনও যথেষ্ট অর্ডার আসছে। কিন্তু সেটাকে কাজে লাগানোর জন্য, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা ২০ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন।"
তিনি বন্দর অবকাঠামোর উন্নয়নের উপরও যোগ দেন।
"উভেন ফেব্রিকসের মতো বিভিন্ন কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির ফলে আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্সপোজার সীমা যেহেতু বৃদ্ধি পায়নি, তাই রপ্তানি অর্ডার অনুযায়ী কাঁচামাল আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না," তিনি যোগ করেন।