কপ ২৬: জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ববাসীর সত্যিকারের প্রতিক্রিয়া কী
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/11/09/_121455681_gettyimages-1228386010.jpg)
যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে জাতিসংঘের নেতৃত্বে চলমান কপ-২৬ সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহ শেষ। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এতে যোগ দিয়ে বন উজার বন্ধ, কয়লা ব্যবহার থেকে সরে আসাসহ বড় কিছু অঙ্গীকার করেছেন।
২০৫০ সাল নাগাদ কয়লা ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধের অঙ্গীকার করেছে ৪০টির বেশি দেশ। ১০০টির বেশি দেশের সরকার প্রধানেরা ২০৩০ সাল নাগাদ বন উজার বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় ইউনিয়ন অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মিথেন নিঃসরণ কমানোর ঘোষণা দিয়েছে।
সাংহাই থেকে সাও পাওলো- বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশে জনগণ ও সরকারি প্রতিক্রিয়া এখানে বিবিসি সূত্রে তুলে ধরা হলো।
চীন:
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমে জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনা তেমন হচ্ছে না। তার মানে, চীনের জনসাধারণ চলমান কপ-২৬ সম্পর্কেই জানেন না, এমন নয়। তবে সম্মেলনের সংবাদ অনেকটাই কম গুরুত্বসহকারে পরিবেশিত হয়েছে।
কপ-২৬ সম্মেলনে যোগ দেননি গণচীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। গুরুত্ব না দেওয়ার সেটাই প্রধান কারণ। অন্যান্য প্রভাবশালী দেশের নেতারা উপস্থিত থাকলেও, শি জিনপিং যে এতে যোগ না দিলেন না; বেশি সংবাদ করা হলে সেদিকেও সবার মনোযোগ আকর্ষিত হবে।
চীনের গণমাধ্যম শাসক সমাজতন্ত্রী দল নিয়ন্ত্রিত। এই দলেরই বর্তমান মহাসচিব শি জিনপিং। তার অনুপস্থিতে কাভারেজ কম হওয়াই স্বাভাবিক।
তবে জলবায়ু পরিস্থিতির পেছনে পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকার সমালোচনা করেছে সমাজতন্ত্রী দলের ইংরেজি ভাষার মুখপত্র গ্লোবাল টাইমস। গণমাধ্যমটি কপ-২৬ এ শুধু শি জিনপিংয়ের অনুপস্থিতির বিষয়টি তুলে ধরায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কড়া সমালোচনা করেছে।
চীনের সামাজিক মাধ্যম অবশ্য পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচনামূলক পোস্টের জোয়ার দেখা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ জনগণের নিন্দামূলক পোষ্ট সরিয়ে ফেলছে।
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচের বাইরে এসে সকল দেশের সরকারের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার আহবান করেছেন। তারা বলছেন, সংকট থেকে মুক্তি পাবার এটাই একমাত্র উপায়। নিতে হবে অতি দ্রুত ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ। চীনা প্রশাসন এদিকটি অনুধাবন করেই সামাজিক মাধ্যমের সমালোচনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অর্থাৎ, জলবায়ু ইস্যুতে সহযোগিতার দ্বার খোলা রাখার ইঙ্গিত দিচ্ছে চীন।
যুক্তরাষ্ট্র:
কপ-২৬ সম্মেলনে আমেরিকার নেতৃত্বমূলক ভূমিকাকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে এজন্য প্রথমেই তাকে নিজ দেশের অতীত ভূমিকার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন এমএসএনবিসির মতামত কলামিস্ট হায়েজ ব্রাউন।
বাইডেনের পূর্বসূরী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করেছিলেন। দূষণ কমানো নিয়েও যত্নশীল ছিল না ট্রাম্প প্রশাসন। বিশ্বকে তাই আবার আশ্বস্ত করার দায় এখন বাইডেনের ঘাড়ে। অন্তত এমনটাই মনে করেন হায়েজ।
অবিশ্বাসের কারণও যথেষ্ট। অতীতেও যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলের ফলে জলবায়ু চুক্তির গুরুত্ব কম-বেশি হয়েছে। ফলে গ্লাসগোতে আমেরিকানরা যে প্রতিশ্রুতিই দিক না কেন, ২০২৫ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের কোন রাষ্ট্রপতি এসে তা বদলে ফেলতে পারেন।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2021/11/09/_121456513_gettyimages-685579846.jpg)
দেশটির সংরক্ষণশীল রাজনীতি প্রভাবিত গণমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল বলেছে, বৈশ্বিক নিঃসরণ কমিয়ে আনতে অধিকাংশ দেশের প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে জো বাইডেন চীন ও রাশিয়ার সরকার প্রধানদের অংশগ্রহণ না করাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বললেও, প্রকৃতপক্ষে তার প্রশাসন মস্কো ও বেইজিংকে নিজ অবস্থান থেকে সরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
কার্বন নিঃসরণ কমাতে জ্বালানি অবকাঠামোয় বড় পরিবর্তন আনতে চায় বাইডেন প্রশাসন। কিন্তু, জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদক রাজ্যের আইনপ্রণেতারা বাইডেনের পরিবেশ সহযোগী পরিকল্পনার বড় বিরোধী, যা কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগকে পিছিয়ে দেবে বলেও ধারণা করছেন বিশ্লেষকগণ।
রাশিয়া:
বিপন্ন পৃথিবীকে বাঁচাতে ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ বিশ্বনেতাদের প্রতি আহবান জানান। যার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার সবচেয়ে বহুল প্রচারিত একটি সংবাদপত্র শিরোনাম করেছে- 'সত্যিই কী আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনকে ভয় পাওয়া উচিত?'
প্রতিবেদনে দৈনিকটি দাবি করেছে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই, 'জলবায়ু পরিবর্তনের ইতিবাচক দিকও আছে' বলে সেখানে দাবি করা হয়। বিশেষ করে, হিমশীতের দেশ রাশিয়ায় এতে ঘর উষ্ণ রাখার খরচ কমবে এবং বরফগলা মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে জাহাজ চলাচল সহজ হবে বলে সেখানে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।
ক্রেমলিন ঘেঁষা দৈনিকটির এ প্রতিবেদন দেশটির নীতিনির্ধারকদের জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধে উদ্যমী হওয়ার কোনো ইচ্ছে না থাকার বিষয়টিই স্পষ্ট করেছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রেমলিন অবশ্য জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাকে অস্বীকার করেনি। রুশ সরকারের দাবি, বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও দ্রুত বা আড়াইগুণ বেশি গতিতে উষ্ণ হয়ে উঠছে রাশিয়ার গড় তাপমাত্রা।
গ্লাসগোতে রাশিয়া একটি বড় প্রতিনিধিদল পাঠালেও, সেখানে যাননি ভ্লাদিমির পুতিন। সম্মেলনের মূল আয়োজনে পুতিন রাশিয়া থেকেই ভিডিওকলের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছিলেন।
তবে একইসাথে ২০৬০ সাল নাগাদ কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাশিয়া। গ্লাসগোয় দেশটির প্রতিনিধিরা ২০৩০ সাল নাগাদ বন উজাড় বন্ধ ও ভূমি সংরক্ষণের অঙ্গীকারনামাতেও স্বাক্ষর করেছেন। তবে একইসময় নাগাদ ৩০ শতাংশ মিথেন গ্যাস নিঃসরণ কমানোর অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেনি দেশটি।
জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলনের অবকাঠামো মিথেন গ্যাস নিঃসরণের বড় উৎস। আর রাশিয়া জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনের বৈশ্বিক শক্তি, আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির সরকার বলছে দূষণমুক্ত বা পরিবেশ বান্ধব জ্বালানিতে তারা ধীরে ধীরে ঝুঁকতে চায়।
এব্যাপারে পরিবেশবাদী আন্দোলন গ্রিনপিস-রাশিয়ার কর্মী ভাসিলি ইয়াবলোকোভ বলেন, 'সবাই চায় রাশিয়া খুব দ্রুত কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জন করুক। রাশিয়া জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা স্বীকার করে পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়ায় আমি খুবই খুশি। তবে নিজের দেশের কাছে খুব উচ্চ প্রত্যাশাও করছি না। সব দেখেশুনে মনে হয়, রুশ সরকার যেন ভিনগ্রহের বাসিন্দা।'
ভারত:
বৈশ্বিক নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কপ-২৬ সম্মেলনের আগে থেকেই ভারতের ভূমিকা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হলেও, দেশটির সিংহভাগ জনগণের কাছে তা তেমন গুরুত্ব পায়নি।
অভ্যন্তরীণ চাপ না থাকার পরও গত সোমবার ২০৭০ সাল নাগাদ মোট কার্বন নিঃসরণ শূন্যতা অর্জনের ঘোষণা দেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এরপরই অনেক ভারতীয়র কাছে গ্লাসগো সম্মেলন বাড়তি গুরুত্ব লাভ করে।
বড় নিঃসরণকারী দেশের মধ্যে সবার শেষে এই লক্ষ্য অর্জনের ঘোষণা দিয়েছে ভারত, যা নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনাও হয়েছে। কিন্তু, উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে ভারতের জন্য এই লক্ষ্যপূরণে সফল হওয়াও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। অর্থনীতি ও পরিবেশ দুদিকেই ভারসাম্য রক্ষা করে চলার বিষয়টিই সবচেয়ে জটিল।
অধিকাংশ ভারতীয় বলছেন, উন্নত দেশগুলো একইসাথে পরিবেশ দূষণ অব্যাহত রেখে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। তাই তারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর চাপ সৃষ্টি করার অধিকার রাখে না। সম্মেলনে এমন কথা মোদিও বলেছেন। তিনি জানান, 'ভারতে বিশ্বের ১৭ শতাংশ জনসংখ্যা বাস করলেও দেশটি মোট কার্বন নিঃসরণের মাত্র ৫ শতাংশ করছে।'
ব্রাজিল:
বর্ষাবন বা চিরসবুজ অরণ্যের বিশাল মালিকানা রয়েছে ব্রাজিলের। এখানেই অবস্থিত মহাবন আমাজন। বৈশ্বিক নিঃসরণ রোধে এ বনের ভূমিকা অসংখ্যবার আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচিত হয়েছে।
তবে দেশটির দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারো ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আশঙ্কাজনক মাত্রায় বেড়েছে বন উজারিকরণ। তার প্রত্যক্ষ সমর্থনে দিনে দিনে সংকুচিত হচ্ছে আদিম অরণ্য। কপ-২৬ সম্মেলনে যোগ না দিয়ে বলসোনারো পরিবেশ সচেতনতাকে আরও একবার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন।
তাছাড়া, এক দেশ হলেও আমাজন থেকে বহুদূরে সাও পাওলো ও রিও ডি জেনিরোর মতো শহরবাসী ব্রাজিলীয়রা চান শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। বন উজাড় নিয়ে তারা জানলেও, এনিয়ে অধিকাংশের তেমন মাথাব্যথা নেই।
সূত্র: বিবিসি