অনেক রক্তচোষা উকুন মাথায়
'পলিটিক্স' শব্দের উৎপত্তি 'ল্যাটিন' থেকে। 'পলি' শব্দের অর্থ হচ্ছে বহু বা অনেক, আর 'টিক্স' শব্দের অর্থ হচ্ছে রক্তচোষা উকুন! – মার্কিন অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস
কাকতালীয় ব্যাপার কি না নির্ণীত না। তবু গল্পটা আগে বলে নেওয়া ভালো। এক লোক রাজনীতি করে, অবসর সময়ে সে নাকি পরকীয়াও করে! যার সাথে ঐ লোকের পরকীয়া সে এলাকায় 'ভাবি' হিসেবে পরিচিত। যা-ই হোক, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না পেয়ে সে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়ালো। তার মার্কা বরাদ্দ হলো আনারস! নির্বাচনী সহিংসতায় ঐ লোক মারা গেল। লোকজন বলাবলি শুরু করল, খুন না হলেও সে এমনি এমনি মারা যেত! কারণ ভাবী তাকে আদর করে 'দুধ-চা' খাওয়াত। এরপর আনারসের সাথে ব্লেন্ড হলেই কেল্লাফতে!
ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বেশিরভাগ বিদ্রোহী প্রার্থীর (ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন না পেয়ে যে নির্বাচন থেকে সরে আসে না সে-ই বিদ্রোহী) মার্কা নাকি 'আনারস'! এছাড়া মোমবাতি আর হারিকেন মার্কার গল্পও আছে। সেই গল্পে পরে আসা যাবে! আগে দলের গল্প বলে নেই।
বাংলাদেশ নামের দেশটায় কোন দলের ভেতরেই শৃংখলা নেই (ধর্ম ভিত্তিক ও দুই একটা বাম দল ছাড়া)। ক্ষমতার সাথে থাকতে চাওয়াটাই তাই স্বপ্ন। যেকোনো ভাবে মনোনয়ন পাওয়াটাই লক্ষ্য! মনোনয়ন পাওয়াটা একালের সবচেয়ে বড় 'ভোট বানিজ্য'! পঞ্চাশ লাখ টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন, মনোনয়ন পাওয়া মানেই ভোটারবিহীন ভোটে জিতে আসা এবং 'কয়েকগুণ পঞ্চাশ লাখ' টাকা তুলে আনা তখন কোনো ব্যাপারই না!
এছাড়া মোটা দাগে বলা যায়, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তা-ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপি বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ছিল। এরপর থেকে বাংলাদেশে যেন আর কোন বিরোধী দল নেই। তাই নির্বাচন কমিশনও ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ, যে দলের মনোনয়ন পায় সেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী প্রার্থী বেশিরভাগ সময়ে বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ, পুলিশ কিংবা প্রশাসনও ক্ষমতাসীনদের বলয়ে থাকতে গর্ব বোধ করে, হয়তো থানার ওসি নিজেই 'জয়বাংলা' শ্লোগান দেয়!
বাংলাদেশের নির্বাচনে কালো টাকা, পেশি বা মাস্তানতন্ত্র, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ক্ষমতাসীনদের পদলেহন- সব কিছু আগে থেকে থাকলেও আওয়ামী লীগ আমলের এক নতুন 'বিষ' হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ব্যবহার। মানে দাঁড়াচ্ছে একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে নৌকা ও ধানের শীষের নামে 'বিভাজন'!
বামদল হিসেবে পরিচিত একটা দলের শ্লোগান ছিল এমন-নৌকা, পাল্লা, লাঙ্গল, শীষ/সব সাপের একই বিষ! মাছ যখন খুব ছোট থাকে অথবা যখন ধরার সময় হয়, তখন পুকুরে বিষ মিশিয়ে দিলে সব মাছই মরে ভেসে ওঠে। দুর্ভাগ্য এই যে, ক্ষমতায় থেকে তৃণমূল পর্যায়ে যে 'বিষ' ছড়ানো হয়েছে সেই বিষে বিরোধীরা কেউ 'নীল' হয়নি। নীল হয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগই। যেন সেই বাংলা ছবির গান - 'বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি, তুমি আমার সাধনা'! টাকা ছড়িয়ে মনোনয়ন কেনা, ভয় ছড়িয়ে নির্বাচন হতে না দেওয়া এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনে জিতে এসে টাকা উসুল করাটাই এখন সাধনা!
তৃণমূলে ছড়ানো এই বিষের কারণে ২০২১ এর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে যতো সহিংসতা ও প্রাণহানি হয়েছে তা স্বাধীনতার পরে হয়েছে কি না সন্দেহ আছে। অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে. এম. নূরুল হুদার সাফাই হচ্ছে এমন, 'এ জাতীয় ঘটনা পাহারা দিয়ে ঠেকানো যায় না। বাস্তবতা হলো এটা! আপনাদের এটা বুঝতে হবে এদেশের নাগরিক হিসেবে।' প্রধান নির্বাচন কমিশন মনে করেন, সহিংসতা ও হত্যাকান্ড ঠেকানোর একমাত্র উপায় নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রার্থী ও ব্যক্তিদের সহনশীলতা!
আগেই লিখেছি, তৃণমূলে এখন আর সহনশীলতা নেই, আছে বিষের বালি। এই বালি মুখে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। গরীব কিন্তু যোগ্য প্রার্থীরা আগেও নির্বাচিত হতেন না, ভবিষ্যতেও হবেন না। অনেক টাকার মালিক এবং যারা পেশি শক্তিতে বলীয়ান সেসব খারাপ বা নির্মম মানুষই নির্বাচিত হবেন তৃণমূল পর্যায়ে। তারপর গায়ক নচিকেতার সেই গল্প মনে পড়বে। একজন বলছে, জানিস সংসদ নির্বাচনে না বুলু ভাই হেরেছে। অন্যজন উত্তর দিলো, কী বলিস? বুলু ভাই খুব খারাপ লোক হয়েও জিততে পারেনি? তাহলে যে জিতলো অর্থাৎ টুলু ভাই সে কী আরও জঘন্য?
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ২০২১ এর জানুয়ারিতে বলেছিলেন, 'আমেরিকায় নির্বাচন হয় আমেরিকার নিয়মে আর বাংলাদেশে হয় আমাদের নিয়মে। ওরা চার-পাঁচদিনে ভোট গুনতে পারে না, আমরা চার পাঁচ ঘন্টায় গুনে ফেলি!' কখনো সখনো গোনাও লাগে না। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায়!
আমরা বরং প্রতিদ্বন্দ্বী বা বিরোধীদের ভোট করতে না দেয়া, বিদ্রোহী প্রার্থীদের বসিয়ে দেয়া, নির্বাচন না করে বিজয়ী হওয়া, সন্ত্রাস, খুনোখুনি এসব বাদ দিয়ে নির্বাচনের গল্প শুনি। গল্প নাকি মন ভালো করে দেয়!
এক.
ইউনিয়ন পরিষদে মনোনয়ন পেয়েছেন এক ভদ্রলোক। ব্যাপক শো ডাউন করেছেন এলাকায়। বিদ্রোহী প্রার্থীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং শোনা যাচ্ছে সে এলাকা থেকে নাই হয়ে গেছে! এই আনন্দে ভদ্রলোক এক গাড়ির শো রুম থেকে দুটো গাড়ি নিয়েছেন, হাজারো পোস্টার ছাপিয়ে এলাকার দেয়ালে লাগিয়েছেন, দুটো জমি কেনায় বায়না করেছেন। যা-ই হোক, কয়েকদিন পরে গাড়ির শো রুমের লোক, পোস্টার ছাপানোর কারণে প্রেসের লোক আর জমির লোক টাকা চাইতে আসলো। মনোনয়ন পাওয়া ভদ্রলোক বললেন, 'কয়েকদিন অপেক্ষা করেন। ইউপি নির্বাচনের ভাও বুঝতেছি মাত্র, কয়েকদিন পরে সংসদ নির্বাচন। সেখানেও দাঁড়াবো। সংসদ নির্বাচনেও জিতবো এবং সংসদে গিয়ে আপনাদের সবার বিল পাশ করিয়ে আনবো!'
দুই.
কলেজ জীবনের দুই বন্ধু বহুদিন পর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে। একজনের মার্কা মোমবাতি আর অন্যজনের হারিকেন। মোমবাতি মার্কার প্রার্থী শহরে থাকে, ব্যবসা করার কারণে টাকা পয়সা আছে। হারিকেনের প্রার্থী সরকারি জমি দখল ও 'ভেজালি জমি' কেনাবেচা করে পয়সা বানিয়েছে। তবে সে ঝানু পলিটিশিয়ান। নির্বাচনের আগে দেখা গেল মোম আর হারিকেনের প্রার্থীরা মারামারি করছে। মার খেলো মোমবাতির প্রার্থীরা কিন্তু হারিকেনের প্রার্থীরা ব্লেড দিয়ে হাত পা কেটে থানায় মামলা করলো। ফলাফল মোমের অনেক কর্মী গ্রেফতার হলো। এরপর দেখা গেল, পুলিশ মাদক বিরোধী অভিজানে নেমেছে এবং গাজা বা ইয়াবাসহ মোমের কর্মীরা গ্রেফতার হচ্ছে। কারণ হারিকেনের কর্মীরা মোমের কর্মীদের বাড়ি বা অফিসে মাদক রেখে তাদের ধরিয়ে দিয়েছে! নির্বাচনের দুই তিন দিন আগে এসব নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট হলো এবং মোমের প্রার্থীর খুব বদনাম হলো। নির্বাচনের আগের দিন দুই বন্ধুর দেখা। মোমের প্রার্থী বললো, 'আমরা না ছোটকালের বন্ধু? তুই এমন করতে পারলি? নির্বাচনের জন্য এত নিচে নামতে পারলি?' হারিকেন প্রার্থী বললো, 'দোস্ত আশা করি কাল তোকে হাতে হারিকেন দিয়ে এলাকা ছাড়া করতে পারব! মনে রাখবি রাজনীতিতে আর যাই থাকুক বন্ধুত্ব থাকতে পারে না!'
রাজনীতিতে আপনার রক্ত চুষে আরেকজন রঙিন হবে। জনগণের প্রতি ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের নামেই হয়তো এসব করা হবে! আপনি রাজনীতির ঘুঁটি হবেন আর আপনাকে নিয়ে দাবা খেলবে রাজা বাদশারা! আপনি উকুন ধরার নামে যতই মাথা চুলকান বেশিরভাগ সময় নিজেকে বাঁচাতে পারবেন না!
লেখক: সাংবাদিক, সম্পাদক, রম্য রচয়িতা