বরেন্দ্র মিউজিয়ামে নষ্ট হচ্ছে হাজার বছরের প্রত্ন নিদর্শন
প্রায় পনেরশো বছরের প্রাচীন প্রস্তর ও ধাতব প্রত্ন নিদর্শন, খ্রিস্টপূর্ব এবং মুসলিম ও প্রাক-মুসলিম যুগের বিভিন্ন শ্রেণির মুদ্রা, হাজার বছরের প্রাচীন পুঁথি সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি নিয়ে সমৃদ্ধ দেশের প্রথম প্রত্মতাত্ত্বিক জাদুঘর যা বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম নামে পরিচিত।
এই মিউজিয়ামে প্রস্তর ও ধাতব প্রত্ম ভাস্কর্য, টেরাকোটা, মুদ্রা ও পাণ্ডুলিপি, ধাতব সামগ্রী এবং শিলালিপি মিলে প্রায় ১৯ হাজারের মতো প্রত্ন নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু স্থান সংকুলান না হওয়ায় প্রদর্শনীর জন্য মিউজিয়ামের ১১টি গ্যালারিতে মাত্র ১৪২৭টি প্রত্ন নির্দশন রাখা হয়েছে। বাকিগুলো রয়েছে মিউজিয়ামের পাঁচটি স্টোর রুমে। ফলে প্রাচীন এই নিদর্শনগুলো দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন হাজার হাজার দর্শনার্থী। আবার স্টোর রুমে রাখার ফলে নিদর্শনের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ করা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।
খোদ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ বলছে, স্টোর রুমে রাখার ফলে মূল্যবান এসব প্রত্ন নির্দশন রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা করার ক্ষেত্রেও অসুবিধা দেখা দিয়েছে। আবার মূর্তিতত্ত্ববিদ ও দক্ষ টেকনিশিয়ান না থাকায় এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়ম মেনে সংরক্ষণ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে নির্দশনগুলো। দক্ষ টেকনিশিয়ান ও বিশেষজ্ঞের অভাবে স্টোর রুম থেকে গ্যালারির প্রত্ন নিদর্শন মাঝে মধ্যে পরিবর্তন করে নতুন নিদর্শন রাখার নিয়ম থাকলেও গত এক দশক ধরে তা রাখা হয় না।
এমনকি গত ৩০ বছর ধরে নতুনভাবে সংগৃহিত প্রায় চার হাজার প্রত্ন নিদর্শনের ক্যাটালগিংও করা হয়নি। মূল্যবান এই মিউজিয়াম রক্ষায় রয়েছে নিরাপত্তারও ঘাটতি। মিউজিয়ামটি থেকে প্রত্ন নিদর্শন হারিয়ে যাওয়ারও ঘটনা ঘটেছে।
প্রত্ম ভাস্কর্য
মিউজিয়াম সূত্রে জানা যায়, বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে পাঁচ হাজারের মতো প্রত্ন ভাস্কর্য রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু দেব-দেবীর ভাস্কর্য। ভাস্কর্যগুলো পঞ্চম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালে বরেন্দ্র অঞ্চলের স্বতন্ত্র ধারায় তৈরি। পাল ও সেন আমলে তৈরি এই ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে মাত্র ৭৯৫টি রয়েছে গ্যালারিতে। বাকিগুলো রয়েছে স্টোররুমে। এত বিপুল সংখ্যক প্রত্ন নিদর্শন রাখা হয়েছে মাত্র পাঁচটি স্টোর রুমে। ফলে যথাযথ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলোর স্থায়িত্ব ও গুণগত মাণ ধীরে ধীরে নষ্ট হচ্ছে।
আবার এসব ভাস্কর্যের অনেকগুলো রাখা হয়েছে মিউজিয়ামের বারান্দায়। গত ১৯ জানুয়ারি মিউজিয়ামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মিউজিয়ামের ভেতরের বারান্দায় অনেকগুলো প্রত্ন ভাস্কর্য ফেলে রাখা হয়েছে। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি মূর্তি ভেঙে গেছে।
পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন টেরাকোটা
মিউজিয়ামে সিন্ধু সভ্যতার পোড়া মাটির ফলকসহ প্রায় দুই হাজারের মতো টেরাকোটা রয়েছে। যাতে ফুটে উঠেছে গ্রাম বাংলার লোকায়িত জীবন দর্শন। যা পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন। টেরোকোটাগুলো পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, গৌড়, পাণ্ডুয়া ও ময়নামতি থেকে সংগৃহীত। অথচ এসব টেরাকোটার মধ্যে মাত্র ৩৫০টি প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে মিউজিয়ামের গ্যালারিতে।
মুদ্রা
মিউজিয়ামে স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্য ও মিশ্র ধাতুতে নির্মিত সাড়ে ছয় হাজারের মতো মুদ্রা রয়েছে। এমনকি খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ থেকে ৪০০ বছর পূর্বের সিলভারে ছাপাঙ্কিত মুদ্রার অস্তিত্ব মেলে এখানে। রয়েছে রাজা শশাঙ্কের সময়ে নির্মিত মুদ্রা। তবে ওইসব মুদ্রার মধ্যে মাত্র ৭২টি মুদ্রা প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে। বাকিগুলো রয়েছে স্টোররুমে।
মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ বলছে, স্থান সংকুলান না হওয়ায় মুদ্রার বিশাল সংগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তারা স্বতন্ত্র মুদ্রা গ্যালারি তৈরি করতে পারেনি। ৩৮টি স্বর্ণের মুদ্রা থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তার কারণে কোনো স্বর্ণের মুদ্রা প্রদর্শনীর জন্য রাখা সম্ভব হয়নি।
পাণ্ডুলিপি ও পুঁথি
মিউজিয়ামে রয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন পুঁথি সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি, যার অধিকাংশ সংস্কৃত, প্রাকৃত ও আদি বাংলা ভাষায় রচিত। রয়েছে ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দ এবং ত্রয়োদশ শতকের কোনো এক সময়ে তালপাতায় লিখিত ও রঙিন চিত্রকর্ম দ্বারা শোভিত দুইটি অষ্ট সাহস্রিকা প্রজ্ঞা পারমিতা পাণ্ডুলিপি। যা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। অথচ এই পাণ্ডুলিপিও স্টোর রুমে সংগৃহীত রয়েছে। এত বিশাল সংখ্যক পাণ্ডুলিপির মধ্যে মাত্র ১৫টি প্রদর্শনীর জন্য গ্যালারিতে রাখা হয়েছে।
মিউজিয়ামের ইতিহাস
১৯১০ সালে এপ্রিলের প্রথম দিকে কুমার শরৎকুমার রায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রমাপ্রসাদ চন্দ ও শশধর রায় এই চারজন বাঙালি ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সোসাইটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। পরে এই সোসাইটিতে কলকাতা মিউজিয়ামের তৎকালীন সুপারিনটেনডেন্ট রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রামকমল সিংহ যোগদান করেন।
এরপর তারা উত্তরবঙ্গের (বরেন্দ্র ভূমির) অনুসন্ধান কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ওই বছরের ২৭ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি’ উদ্বোধন করা হয়। ১৯১৬ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল কর্তৃক মিউজিয়াম ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। ১৯১৯ সালে অনুসন্ধান সোসাইটির লাইব্রেরি ও মিউজিয়াম সম্বন্ধে একটি প্রাইভেট ট্রাস্টি বোর্ড গঠিত হয়। অতপর একই বছরের ২৭ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন বাংলার গভর্নর লর্ড রোনাল্ডশে কর্তৃক রাজশাহী মহানগরীর হেতেম খাঁয় স্থাপিত মিউজিয়ামের উদ্বোধন হয়। বর্তমানে মিউজিয়ামটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে।
হয় না গবেষণা
বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের মূল কাজ গবেষণা হলেও স্টোররুমে বেশিরভাগ প্রত্ন নির্দশন থাকায় সেগুলো নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব হয় না। ২০০৪ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত এই মিউজিয়াম থেকে কোনো ধরনের জার্নাল প্রকাশিত হয়নি। তবে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ বলছেন, চলতি বছরের জুন-জুলাই নাগাদ জার্নাল বের করা হবে। এজন্য দেশি-বিদেশি গবেষকদের কাছ থেকে লেখা আহ্বান করা হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফোকলোর বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের সাবেক পরিচালক ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী বলেন, পর্যটকদের রুচির কথা চিন্তা করে বিশ্বের সব মিউজিয়ামই তার সংগ্রহকৃত প্রত্ন নির্দশনের ২০ শতাংশ প্রদর্শন করে থাকে। প্রদর্শনীর জন্য গ্যালারি থেকে তিন বছর পর পর পরিবর্তন করা হয় প্রত্ন নির্দশনগুলো। অথচ আমাদের মিউজিয়ামে গত এক যুগেরও বেশি সময় সেটা করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া স্টোর রুম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত না থাকার কারণে নিদর্শনগুলো নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিপুল পরিমাণ প্রাচীন মুদ্রা থাকা সত্ত্বেও সেইসব মুদ্রা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়নি। অন্তত গোল্ড কয়েনগুলোর রেপ্লিকা করে হলেও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা উচিত।
দর্শনার্থী কলেজ শিক্ষক মোতলেবুর রহমান রহমান বলেন, যেটুকু জানি এই মিউজিয়ামে ১৫ থেকে ২০ হাজার প্রত্ন নির্দশন রয়েছে। অথচ গত ১৫ বছর ধরে গ্যালারিতে একই ধরনের প্রত্ন নিদর্শন দেখছি। যেহেতু কলেজে পড়াই তাই বাধ্য হয়েই শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসতে হয়।
বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের উপ-প্রধান সংরক্ষণ কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুস বলেন, স্থান সংকুলানের অভাবে সিংহভাগ নিদর্শন স্টোর রুমে রাখা হয়েছে। এত বিশাল পরিমাণ প্রত্ন নিদর্শন স্টোর রুমে রাখাটা কঠিন। আবার দক্ষ টেকনিশিয়ান ও প্রত্ম বিশেষজ্ঞের অভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা করাও কঠিন হয়। পর্যাপ্ত জনবলের অভাব থাকা সত্ত্বেও তারপরও আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করি।
বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের পরিচালক অধ্যাপক ড. আলী রেজা মুহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, সব প্রত্ন নির্দশন স্টোর রুম থেকে বের করে ডিসপ্লের জন্য একটা মাস্টারপ্ল্যান দেওয়া হয়েছে। এজন্য মূল ভবনের বাইরে ফাঁকা জায়গাতে হাই রাইজ বিল্ডিং নির্মাণ বা মূল ভবনের পিছনে পরিচালকের বাস ভবনের উপরে বহুতল ভবন নির্মাণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাজেট পেলেই কাজ শুরু হবে।