দিয়েগো ম্যারাডোনা স্মরণে...
আর্জেন্টিনার ভিলা ফিওরিতোতে নিজ এলাকার লোকেরা তাকে ডাকতো 'এল পেলুসা' বলে। তারুণ্যে লম্বা ঢেউ খেলানো চুলের সৌন্দর্য্যের জন্যই পেয়েছিলেন এই নাম। তার আরেক নাম 'ডি১০এস', স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায় 'ঈশ্বর'। এই নামের সাথে জড়িয়ে আছে তার জীবন, ফুটবল নামক চর্মগোলক নিয়ে ভালোবাসা-উন্মাদনা এবং তার বিখ্যাত দশ নম্বর জার্সি। বলছি অনন্তকাল জাগ্রত এক নক্ষত্র, দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনার কথা। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে যিনি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, কাঁদিয়েছিলেন অগণিত ভক্তকে।
২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ৬০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে বিবেচিত দিয়েগো ম্যারাডোনা। শুধু পেশাদার শিরোপা অর্জনের জন্য নয়, ক্ষ্যাপাটে এই কিংবদন্তী তার ক্যারিশমা ও পাগলামির মধ্য দিয়েই যেন পৌঁছে গিয়েছিলেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে। বাঙালির ফুটবলপ্রেমের শুরু হয়েছে যাদের হাত ধরে, সেখানেও অবধারিতভাবে থাকবে ম্যারাডোনার নাম।
আর্জেন্টিনার বুয়েন্স এইরেসের শহরতলিতে জন্ম নেওয়া এই ফুটবলার অনেকের কাছেই 'ফুটবল ঈশ্বর' হিসেবে পরিচিত। ইতালির নাপোলিতে তিনি একজন কাল্ট হিরো, রাজত্ব করেছেন ইউরোপের দলটির জার্সি গায়ে। তার নামে বানানো হয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্স, ম্যুরাল, স্মৃতিফলক; অগণিত বাবা-মা তাদের সন্তানের নামকরণ করেছেন ম্যারাডোনার নামে!
কিংবদন্তীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে তাকে স্মরণ করেছেন প্রিয়জন ও ভক্তরা। আর বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে সেই চিত্র। ম্যারাডোনার এক মেয়ে ডালমা ম্যারাডোনা ইনস্টাগ্রামে লেখেন, বাবা চলে যাওয়ার দিনটি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন। চলতি সপ্তাহে আর্জেন্টিনার ৩৪ বছর বছর বয়সী শিক্ষক ইজেকুয়েল রসির সাথে কথা হয় রয়টার্সের। তিনি বলেন, "দিয়েগো আমাদের অনেক কিছু অনুভব করতে শিখিয়েছে। একটা শিশু যার কিছুই ছিল না, তাকে বিশ্বজয় করতে দেখাটা ভীষণ আনন্দের। তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন, যেন আমরা আরও বড় কিছু অর্জন করতে পারি।"
স্বপ্নদ্রষ্টা নয় তো কি! আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের শিরোপা খরা ঘোচানোর পেছনেও কি দিয়েগোর স্বপ্নই ছিল না? গত ১১ জুলাই দিনটাতে কি ম্যারাডোনাকে খুঁজে ফেরেনি মেসিদের চোখ? আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকা জয়ের দিন যদি এই কিংবদন্তী থাকতেন, তাহলে হয়তো আনন্দের পাগলামির চূড়ান্তই দেখতো বিশ্ব!
ম্যারাডোনার মৃত্যুতে সবচেয়ে আঘাত পেয়েছেন, এমন মানুষদের তালিকায় লিওনেল মেসির নাম আসবে শুরুতেই। ম্যারাডোনার সঙ্গে মেসির তুলনাও কম হয়নি! ম্যারাডোনাকে নিজের কোচ হিসেবেও পেয়েছিলেন মেসি। স্প্যানিশ দৈনিক মার্কা'কে চলতি সপ্তাহের শুরুতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ম্যারাডোনার প্রয়াণ সম্পর্কে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন পিএসজি তারকা।
"আমার খুব অদ্ভুত লাগে, মনে হয় যেন মাত্র গতকালই ঘটনাটা ঘটলো। দিয়েগোকে ছাড়াই একটা বছর পার হয়ে গেল, এতগুলো বছর বাদে আর্জেন্টিনা আবার চ্যাম্পিয়ন হলো। সবসময় মনে হয়, এই বুঝি তাকে আবার টিভিতে দেখবো, কিংবা একটা সাক্ষাৎকারে। কিন্তু না, অনেকদিন হয়ে গেল তিনি নেই। তবুও বিশ্বাস হয়না! আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি যে তার সাথে আমার এত সুন্দর সুন্দর স্মৃতি আছে, আমি আজীবন তাকে এসব স্মৃতির মধ্য দিয়েই মনে রাখবো", বলেন মেসি।
নাপোলিকে ১৯৮৭ ও ১৯৯০ সালে 'সিরি এ' জেতানো খেলোয়াড় ম্যারাডোনার স্মরণে নভেম্বরের ৩টি ম্যাচ ম্যারাডোনার সংবলিত জার্সি গায়ে খেলবে নাপোলি। ম্যারাডোনার বাকি দুই ক্লাব বার্সেলোনা ও বোকা জুনিয়রস 'ম্যারাডোনা কাপ' আয়োজন করবে। আর্জেন্টিনার ক্লাবগুলোর ম্যাচে এক মিনিট নীরবতা পালন করবে বলে জানা যায়।
একজন দিয়েগো ম্যারাডোনা ফুটবল জগতকে এবং ফুটবল ভক্তদের যা দিয়েছেন, তাতে যুগ যুগ পরেও অমলিন রয়ে যাবে তার নাম। ম্যারাডোনা একজন মায়েস্ত্রো, যিনি আমাদের ফুটবল ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, কোনোকিছু পরোয়া না করে প্রাণোচ্ছল আনন্দে মেতে উঠতে শিখিয়েছেন। আর সেজন্যেই 'কীর্তিমানের মৃত্য নাই'- বাক্যটি ম্যারাডোনার ক্ষেত্রেই খাটে!