‘তারা আমাকে স্পর্শ করতে পারবে কিন্তু আমি আপত্তি জানাতে পারি না’, বার ও ক্লাবে নেপালি শিশুরা
নেপালের বিভিন্ন বার এবং লোকসঙ্গীতের ভেন্যুতে শিশুদের শোষণ করা হচ্ছে বলে উঠে এসেছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে। এমনকি কিছু কিছু জায়গায় চলছে যৌন ব্যবসা। অনুমান বলছে, এতে হাজারো অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু ক্ষতির মুখে পড়ছে।
শিশুদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেওয়া অবৈধ হলেও নেপালে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় ১.১ মিলিয়ন শিশু শিশুশ্রমে নিযুক্ত রয়েছে। এছাড়া, ০.২২ মিলিয়ন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পে কাজ করে।
ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত চাইল্ড লেবার অ্যাকশন রিসার্চ প্রোগ্রাম, ক্লারিসার মতে, হাজারো নেপালি শিশু রয়েছে যারা ১০-১১ বছর বয়সেই যৌন-ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে।
এদেরই একজন রিতা (ছদ্মনাম)।
গ্রাম থেকে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে আসার সময় তিনি ভেবেছিলেন, অবশেষে দারিদ্রতা থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছেন। গ্রামে রিতা তার মদ্যপ মা ও ভাইবোনদের সাথে থাকতেন। রিতার বাবা বেশ আগেই কাজের খাতিরে পরিবার ত্যাগ করে মালয়েশিয়া পাড়ি জমান।
রিতা বলেন, "প্রথমে তিনি আমাদের টাকা পাঠাতেন, কিন্তু পরে বন্ধ করে দেন। আমাদের পর্যাপ্ত জমি ছিল না, তাই আমি ১২ কি ১৩ বছর বয়সে কাঠমান্ডুতে আসি।"
সেখানে প্রথমদিকে তিনি ইটের কারখানায় কাজ করা থেকে শুরু করে বাড়িতে বাসন মাজা, হোটেলের রান্নাঘরে কাজ করা এবং দোকানের সহকারীর কাজ করেছেন। এসব হাড়ভাঙ্গা খাটুনিরও পরেও তার বেতন ছিল খুবই নগণ্য। পাশাপাশি প্রায়ই পুরুষ সহকর্মীরা রিতাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করত।
১৪ বছর বয়সে রিতা একটি রেস্তোরাঁয় চাকরি পান যেখানে তাকে গ্রাহকদের সাথে বসে খেতে এবং পান করতে হতো।
"গ্রাহকরা হুক্কা এবং অ্যালকোহল পান করত। তারা আমার হাত স্পর্শ করত, অশ্লীল কথা বলত, কিন্তু আমি এতে আপত্তি জানাতে পারিনি," বলেন রিতা।
ক্লারিসার কর্মীদেরকে নিজের গল্প খুলে বলেন রিতা। তিনি জানান, তাকে মদ্যপান করতে বাধ্য করা হতো। এছাড়া, সেই রেস্তোরাঁয় আসা লোকেরা তাকে কাছাকাছি গেস্ট হাউস বা ভাড়া করা রুমে নিয়ে টাকার বিনিময়ে যৌন-সম্পর্কে বাধ্য করে।
ক্লারিসার পরিচালক এবং সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক ড্যানি বার্নস বলেন, "শিশু শ্রমের সবচেয়ে খারাপ ধরন হলো ছোট ব্যবসা এবং পারিবারিক মালিকানাধীন ব্যবসা - যে ধরনের জায়গায় রিতার মতো শিশুদের নিয়োগ করা হয়।"
এদিকে ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কাঠমান্ডু। একইসাথে ২০২২ সালের মধ্যে শিশুশ্রমের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিকগুলো বন্ধের লক্ষ্যও নির্ধারণ করেছে তারা।
দেশটির নারী, শিশু ও প্রবীণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী উমা রেগমি বিবিসি নেপালি সার্ভিসকে বলেছেন, "সরকার লক্ষ্য পূরণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।"
তিনি বলেন, "আমাদের হাতে খুব কম সময় আছে, কিন্তু আমরা ২০২২ সালের মধ্যে নিকৃষ্টতম শিশুশ্রমের অবসান ঘটাতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাব।"
কাঠমান্ডুর ক্লারিসার গবেষক প্রজ্ঞা লামসাল বিবিসিকে বলেন, তারা 'অ্যাডাল্ট সেক্টরে' নিযুক্ত প্রায় ৪০০ শিশুর সাক্ষ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছে।
নেপালে ক্লারিসার প্রধান সুধীর মাল্লা বলেন, বেশিরভাগ শিশু দরিদ্র পরিবার বা ভাঙা ঘর থেকে এসেছে এবং শহরে তাদের বেশিরভাগই 'দোহোরি রেস্তোরাঁ'গুলোতে কাজ করে। মূলত লোকসংগীত প্রচারের দাবি করে তাদেরকে ভাড়া করে এ ধরণের রেস্তোরাঁগুলো।
সুধীর বলেন, "লোকসংগীত প্রচার করার মতো কিছু রেস্তোরাঁ অবশ্যই আছে। তবে, ছোট রেস্তোরাঁগুলোই বেশিরভাগ সময় যৌন ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। মদ পরিবেশন, টেবিলে অপেক্ষা, হুক্কা ও নাচের বারে কাজ এবং ম্যাসাজের জন্য যুবতী ও অল্পবয়স্ক মেয়েদের ভাড়া করে তারা।"
"এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিতভাবে ডকুমেন্ট নিবন্ধন ও নবায়ন এবং কর্তৃপক্ষকে তাদের কর্মীদের বিশদ বিবরণ দেওয়ার বিষয়ে আইনে উল্লেখিত আছে। কিন্তু অনেকেই প্রাথমিকভাবে নিবন্ধন করে সেটি নবায়ন করে না। এছাড়া, এমন অনেকেই আছে যারা নিবন্ধনই করে না। এমনকি এদের জন্য তেমন পদক্ষেপও নেওয়া হয় না," বলেন তিনি।
ফলে, এসব জায়গায় শিশু শ্রমিকেরা আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়াই কাজ করে এবং তাদেরকে কোনো কাজের বিবরণ বা নির্দিষ্ট বেতন দেওয়া হয় না।
প্রজ্ঞা লামসাল বলেন, "এখানে কাজ করা মেয়েদেরকে বলা হয়, যদি অতিথিরা বেশি বিল দেয় তাহলে তাদের টিপসও বেশি হবে। এদের বেশিরভাগই অল্পবয়সী এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন। তাছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, এসব মেয়েদের পরিবার তাদের উপর নির্ভরশীল থাকায় তাদের কোনো বিকল্পও থাকেনা।"
তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ মেয়েই তাদের বাবা-মাকে এই শোষণের বিষয়ে জানায় না। তাই নির্যাতনের ক্ষেত্রে তারা তাদের পরিবার বা পুলিশের কাছে সাহায্যের জন্য যেতে পারে না। অনেকে তাদের চাকরি হারানোর ভয়ে হেনস্তার অভিযোগও করেন না।
সুধীর মাল্লার মতে, কোভিড-১৯ এর ফলে বর্তমানে এ পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
এদিকে অধ্যাপক বার্নস মনে করেন, কোন দেশই ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রমের সমাপ্তি ঘটাতে পারবে না।
"দীর্ঘদিন ধরে শিশুশ্রমের হার কম থাকলেও গত দেড় বছরে বিভিন্ন দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে," তিনি বলেন।
মন্ত্রী উমা রেগমি বলেছেন, "আমরা খুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে কাজ করা শিশুদের সম্পর্কে খুঁজে বের করার জন্য বিভিন্ন সংস্থার সাথে কাজ করছি। এবার যখন আমরা এই বিষয়ের সত্যতা পেয়েছি, আমরা সেই অবৈধ অপারেটরদের জবাবদিহি করতে এবং তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও যাবো।"
- সূত্র- বিবিসি