মণিপুরী ভাষা: আছে ঐতিহ্য, নেই স্বীকৃতি
সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রভাতপ্রতিম সিংহ সঙ্গীত। মণিপুরী এই শিশুকে স্কুলে বাংলা ও ইংরেজি বই পড়তে হয়। স্কুলে নিজের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ নেই তার। অথচ ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের কথা উল্লেখ রয়েছে।
শুধু সঙ্গীত নয়, নিজের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে সিলেটের মণিপুরী শিশুরা। অথচ এই ভাষার রয়েছে নিজস্ব লিপি। আছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। ভারতীয় সংবিধানেও মণিপুরী ভাষা অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। তবে যেখানে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রাণ বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল, সেখানেই নেই মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতি। বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষার সাংবাধিনিক স্বীকৃতি নেই।
এ নিয়ে আক্ষেপ করে বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদের সভাপতি কবি এ কে শেরাম বলেন, ‘আমাদের তো সাংবিধানিক স্বীকৃতিই নেই। আমাদের যে নিজস্ব ভাষা আছে, ঋদ্ধ সংস্কৃতি আছে। তা বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকার করেনি। এছাড়া অর্থনৈতিক উপযোগিতা না থাকায় মণিপুরী তরুণ প্রজন্ম এখন এই ভাষাটা শিখতেও আগ্রহী নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমারে দুই থেকে তিন লাখ মণিপুরী আছে। কিন্তু রাষ্ট্রের অসহযোগিতার কারণে সেখানে মণিপুরী ভাষাভাষি নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে সে তুলনায় কয়েকগুণ কম মণিপুরীর বাস। ফলে এই দেশ থেকেও মণিপুরী ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণাকালে উল্লেখ করা হয়- সকল ভাষাকে পৃষ্টপোষকতা, সংরক্ষণ ও সমানাধিকার প্রদানই এই দিবসের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪৫টি জাতিসত্ত্বা রয়েছে। এদের অনেকের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, লিপি, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
এ নিয়ে মণিপুরী ভাষার কবি এ কে শেরাম ক্ষোভের সঙ্গেই বললেন, ‘যারা নিজেদের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে সেই দেশেই অন্য ভাষার এমন অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা, অবহেলা করা সত্যিই হতাশজনক।’
এমন ক্ষোভ সকল মণিপুরীদেরই। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলেই মণিপুরীদের বসবাস। মণিপুরীদের মধ্যে রয়েছে বিভাজন। মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া। অনেক সামঞ্জস্য থাকলেও এদের ভাষা আলাদা। বাংলাদেশে বসবাসকারী মণিপুরীদের সংখ্যা হাজার চল্লিশেক।
মণিপুরীদের রয়েছে নিজস্ব লিপি। খ্রীষ্টিয় প্রথম শতকে মণিপুররাজ পাখংবা এই লিপির উদ্ভাবন করেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ মেলে। তখন এর সংখ্যা ছিল ১৮। পরবর্তীকালে, শপ্তদশ শতাব্দিতে মহারাজ খাগেম্বা উচ্চারণকে অধিকতর প্রমিত করার লক্ষ্যে গুরু উচ্চারণে আরও সাতটি বর্ণ সংযোজন করেন। এ ছাড়া রয়েছে আটটি হসন্ত বর্ণ এবং আটটি অক্ষর বা কার চিহ্ন।
মণিপুরী লিপির প্রতিটি বর্ণমালার নামকরণ করা হয়েছে দেহের এক একটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নামে। যেমন- বাংলা ‘ক’ এর মণিপুরী প্রতিবর্ণের নাম ‘কোক’- যার বাংলা অর্থ মাথা। বাংলা ‘স’-এর মণিপুরী প্রতিবর্ণ ‘সম’- যার বাংলা অর্থ চুল। ম-এর প্রতিবর্ণ ‘মিৎ’- যার বাংলা প্রতিশব্দ চোখ। সব বর্ণই এ রকম। শরীরের নানা অঙ্গের নামে।
মণিপুরী সংস্কৃতিতে মুগ্ধ ছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও। শান্তিনিকেতনেও চালু করেছিলেন মণিপুরী নৃত্য।
তবে, এমন ঐতিহ্য থাকলেও বাংলাদেশ থেকে ধীরে ধীরে মণিপুরী ভাষা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন মণিপুরীরা।
বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা সিলেট বিভাগের সভাপতি ও মৈতৈ মণিপুরী ভাষার লেখক লক্ষীকান্তু সিংহ বলেন, ‘‘শিক্ষালাভের সুযোগ কিংবা ব্যবহারিক উপযোগীতা না থাকলেও এতদিন ‘পারিবারিক ভাষা’ হিসেবে ঘরে নিজেদের ভাষাতেই কথা বলতেন মণিপুরীরা। কিন্তু ইদানীং পেশাগত কারণে মণিপুরী জনগোষ্ঠি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এখন তাদের ঘরেও ঢুকে পড়েছে বাংলা। মণিপুরী শিশু-কিশোররা এখন নিজেদের মাতৃভাষায় লিখতে পারা তো দূরের কথা বলতেও পারে না।’’
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার পত্রিকা ইথাক সম্পাদক সংগ্রাম সিংহ বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন ফরাসি, জাপানিজসহ অনেক ভাষাই শেখার সযোগ রয়েছে। এসব ভাষা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু এই দেশে থাকা ক্ষুদ্র জাতিগুলোর ভাষার শিক্ষার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।’
তবু নিভূ নিভূ প্রদীপটা জ্বালিয়ে রাখার চেষ্ট করা হচ্ছে। ১৯৭৫ সালে গঠন করা হয় কেন্দ্রীয় মণিপুরী সাহিত্য সংসদ। এই সংসদ থেকে প্রতিবছর মণিপুরী শিশুদের মধ্যে ভাষা প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়। মণিপুরী ভাষায় রচনা প্রতিযোগিতা করা হয়।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদাহরণ দিয়ে কবি এ কে শেরাম জানান, ত্রিপুরায় ২১ ফেব্রুয়ারি আয়োজন করা হয় ‘ভাষা দিবস’ নামে। ত্রিপুরার রাজ্য ভাষা বাংলা। কিন্তু তারপরও ভাষা দিবসের সকল অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ত করা হয় রাজ্যের সকল ভাষাভাষি জনগোষ্টিকে। সরকারি অনুষ্ঠানমালায় ও প্রকাশনায় সকল ভাষাভাষী জনগোষ্টির ভাষা ও সাহিত্য স্থান পায়। তিনি বাংলাদেশেও এমন উদ্যোগের দাবি জানান।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বায়েজিদ খান বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাপ্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নিজ নিজ ভাষায় বইও প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সব শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন মাতৃভাষায় বই পৌঁছে দেওয়া যায়নি। ধীরে ধীরে তা করা হবে।