‘চিঠিটি পেলাম দেশ স্বাধীন হওয়ার পর’
একাত্তরের জুলাই মাসের ২০ তারিখে বীর মুক্তিযোদ্ধা পাটোয়ারি নেসারউদ্দিন (নয়ন) রণাঙ্গন থেকে একটি দারুণ পত্র লিখেছিলেন। সেটিকে প্রেমপত্র বললে ভুল হবে না। চিঠির কিছু অংশ পড়ে দেখুন আপনারাও একমত হবেন।
পাহাড়ের শ্যামল বনরাজির এ মেলায় প্রায় প্রতিদিন বর্ষা নামে চারদিক অন্ধকার করে। বর্ষার অশান্ত বর্ষণে পাহাড়ি ঝর্ণায় তখন মাতন নেমে আসে। দুর্বার বেগে ঝর্ণার সে জলধারা কলকল গান করে এগিয়ে চলে সমতলের দিকে। আমার মনের সবটুকু মাধুরী ঢেলে তখন সে ধারাকে কানে কানে বলি-ওগো ঝর্ণার ধারা, তুমি সমলের দেশে গিয়ে আমার অনুকে আমার এ বার্তা বলে দিও-ওকে আমার একান্ত কাছে পাই যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে।
প্রথমা প্রকাশনের 'একাত্তরের চিঠি' বইয়ে প্রকাশিত জনাব পাটোয়ারির চিঠির শুরুটাও মমতামাখা। তিনি লিখছেন,
অনু,
ভালো আছি। তোমার মনের বাঁধ ভেঙে গেলে বলব, লক্ষী আমার, মানিক আমার, চিন্তা করো না। তোমার নয়ন কুশলেই আছে। যখন আমায় বেশি করে মনে পড়বে তখন এই ভেবেই মনকে বোঝাবে, এই বলেই বিধাতার কাছে প্রার্থনা জানাবে-শুভ কাজে অনড় থেকে শুভ সমাধা করে যেন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরতে পারি। ফিরতে পারি মায়ের বুকে-মুছিয়ে দিতে মায়ের এত কান্নাকে। নতুন দিনের আলোয় উজ্জ্বল প্রভাতে গিয়ে যেন মাকে মা বলে ডাকতে পারি।"
চিঠির শেষ তিনি করেছেন একটি ধাঁধা দিয়ে। তার একটু আগে লিখেছেন, "এবার কিন্তু ইতি টানব না-শুধু বলব-নিচে একটা ধাঁধা দিলাম, মাথা ঘামিয়ে ভেঙে দাও। ভাঙতে পারলে জানতে পারবে আমি কোথায় আছি।
ধাঁধা
তিন অক্ষরের নাম আমার হই দেশের নাম
মধ্যের অক্ষর বাদ দিলে গাছেতে চড়লাম
শেষের অক্ষর বাদ দিলে কাছে যেতে কয়
বলো তো অনু, আমি রয়েছি কোথায়?
আজ ১৪ ডিসেম্বর দুপুর বেলায় কথা হচ্ছিল পাটোয়ারি সাহেবের স্ত্রী মানে চিঠির প্রাপক ফাতেমা বেগম অনুর সঙ্গে। বর্তমানে তার বয়স ৭৩ বছর। প্রথমেই জানতে চেয়েছিলাম, ধাঁধাটি কি তিনি ভাঙতে পেরেছিলেন? হেসে ফেলে উত্তরে বলেছিলেন, হ্যাঁ সঙ্গে সঙ্গেই। আমরা ঘরে এমন মজা আগেও অনেকবার করেছি। তিনি যে আসামে ছিলেন তা বুঝতে আমার একটুও কষ্ট হয়নি। একাত্তরে জুন মাসের ৪ তারিখে পাটোয়ারি সাহেব কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম হয়ে আগরতলা যান। তারপর আসামে গিয়ে গেরিলা ট্রেনিংয়ের জন্য নির্বাচিত হন।
নয়ন-অনুর বিয়ে হয়েছিল একাত্তরের এপ্রিলে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ঘোর যুদ্ধের মধ্যে বিয়ে করলেন, কোনো কারণ ছিল? অনু বললেন, তিনি যুদ্ধে চলে যাবেন, তার আগে বিয়েটা সেরে যেতে চাইছিলেন।
আপনাদের কি অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ হয়েছিল? অনু হেসে জবাব দিলেন, জ্বি না, লাভ ম্যারেজ।
নয়নের বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল অনুদের বাড়ির কাছে। সেটা চাঁদপুরের মতলবে। নয়নদের বাড়ি চাঁদপুর সদরে। নয়ন বোনের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেলে অনুর সঙ্গে পরিচয় হয়। সেটা ১৯৬৮ সালে। তারপর দিনে দিনে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। অনু তখন চাঁদপুর ওমেন্স কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছেন আর তখন নয়ন পড়ছিলেন ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে (এখন বিশ্ববিদ্যালয়)। নয়নের এক চাচাতো ভাই নাম আবুল কালাম আজাদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি পুলিশের ডিবিতে ছিলেন। ভাইয়ের সাহচর্যে নয়নও সক্রিয় হলেন রাজনীতিতে। উল্লেখ্য এক পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার আবুল কালাম আজাদকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৭০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। একাত্তরের আগস্টে তিনি রাজাকারদের হাতে শহীদ হন।
ওদিকে অনু ঢাকায় এসে ইডেন কলেজে ভর্তি হলেন। উনসত্তরের সেই মিছিল যাতে পতাকা হাতে ছোট্ট এক শিশু সবার সামনে সেই মিছিলে ছিলেন অনু। বিশ্ববিদ্যালয়ে বটতলায় সহপাঠিদের সঙ্গে অনু যেতেন, আন্দোলন সংগ্রামের গতিবিধি জানতেন, মতামত রাখতেন। তাই অনু বলছিলেন, আমিও মুক্তিযোদ্ধা, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করিনি কিন্তু অস্ত্র সামলে রেখেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের রেঁধে খাইয়েছে, শুশ্রূষা করেছি, তথ্যাদি যোগান দিয়েছি। আমাদের একটা ব্যাপার কী ছিল জানেন, নয়নের বাড়ির দিকে লোকেরা আমাদের বিয়েটা নিতে পারেনি অনেকদিন। নয়ন যুদ্ধে যাওয়ার আগে পরিবারের সম্মতি ছাড়াই বিয়েটা সেড়ে নিয়েছিল এই ভেবে যে যদি আর না ফেরে। নয়ন আগরতলা চলে যাওয়ার আগের প্রায় এক মাস বাড়িতে বা কাছের মাঠে অন্যদের সঙ্গে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছে। ইপিআরের কিছু সেনা তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিত।
চিঠিটা পেয়েছিলেন কবে? পাটোয়ারি সাহেব তো চিঠিটা লিখেছিলেন জুলাই মাসে। আপনার হাতে পৌছাতে কতদিন লেগেছিল?
পেয়েছিলাম দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। আসলে হয়েছিল কি নয়ন দুটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন- একটি তার মাকে অন্যটি আমার কাছে। কেউ একজন এসে চিঠি দুটি চাঁদপুরের বাড়িতে দিয়ে গিয়েছিল আমার ভাসুরের স্ত্রী মানে আমার জায়ের হাতে। কিন্তু যেহেতু তারা আমাদের বিয়ে তখনো মেনে নেয়নি তাই আমি চিঠিও পাইনি। সম্ভবত জুলাইয়ের শেষ দিকেই চিঠি দুটি দেশে এসে পৌছায়। আর নয়ন দেশে সিলেট হয়ে দেশে ঢুকে পড়েছিল আগস্ট মাসেই। সেখানে তাঁরা কচি বাঁশ চিবিয়ে দিন কাটিয়েছে শুনেছি। খাবার পানিও ঠিকমতো পায়নি।
চিঠি তখন কার মারফত পাঠানো হয়েছিল?
বলুন কার কার মারফত। একজন তো নয় বেশ কয়েকজন। এক মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে আরেক মুক্তিযোদ্ধা তারপর আরেকজন - এভাবে। আমি কারুর নামই বলতে পারছি না। কাউকে আমি দেখিইনি।
পাটোয়ারি সাহেব চাঁদুপুরে কি যুদ্ধ করেছেন?
হ্যাঁ। চাঁদুপরের বদপুরের যুদ্ধ তো বিখ্যাত। সেটা হয়েছিল ২৩ নভেম্বর। নয়নরা ১১ জন পাকসেনাকে আটক করেছিলেন। সে যুদ্ধে পায়ে কিছু আঘাত পেয়েছিলেন নয়ন। এছাড়া তাঁর গায়ে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল মানে তিনি চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। দূষিত পানি বা পোকা মাকড়ের আক্রমণে এমনটা হয়ে থাকতে পারে। তাঁরা কিন্তু চাঁদপুরে চলে এসেছিলেন আগস্টের শেষ দিকেই।
তবে তো যুদ্ধের মধ্যেই আপনাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে?
তা তো হবেই। ওনাদের ক্যাম্প ছিল একটি প্রাইমারি স্কুলে। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্রই ৫ মিনিট দূরে। ওনাদের অস্ত্র, গোলা-বারুদ তো আমিই আগলে রাখতাম।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাটোয়ারি সাহেব কী করতেন?
যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি ডিগ্রি শেষ করেছিলেন। স্বাধীন হলে তিনি প্রশাসন বিভাগে যোগ দেন। উপ-সচিব হয়ে অবসরে যান। তিনি মারা গেছেন ২০১৪ সালে।
আপনাদের কতজন ছেলে-মেয়ে?
আমাদের ৪ ছেলে। বড় ছেলের জন্ম ওই একাত্তরে। গর্ভে সে সাত মাস ছিল। ২৪ নভেম্বর তার জন্ম। মুক্তিযোদ্ধারা তার নাম রেখেছে বিপ্লব। সে প্রকৌশলী। মেঝ ছেলে চিকিৎসক। সেজো ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। সবার ছোটটি আমেরিকায় গুগলে কাজ করে।
আপনার বয়স এখন কত? কেমন আছেন?
৭৩ এর কিছু বেশি। জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ ভালো রেখেছেন।
ভালো থাকবেন আপা, আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।