ব্রাইডাল সেট থেকে রাষ্ট্রপতির মনুমেন্ট! সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরির জয়যাত্রার গল্প
'সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি'- নামটি যদি আপনার পরিচিত না হয় তাহলে শুরুতেই নিশ্চয়ই কল্পনায় আসবে ছয় গজের কোনো শাড়ির দৃশ্য। কিন্তু বাংলাদেশের ফ্যাশন জগতে অভিনব গয়নার ডিজাইনের জন্যই বেশি সমাদৃত নামটি।
শুরুতে শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করলেও হাতে তৈরি গয়নার নান্দনিকতাতেই ক্রেতাদের মন ছুঁয়ে গেছে লোরা খানের প্রতিষ্ঠিত অনলাইন ব্র্যান্ড সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি।
"ভালো জিনিস আনব, ভালো জিনিস বানাব, ভালোভাবে দেখাব" মন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে কাজ করেন লোরা খান। স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা করে শাড়ি আর গয়নার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্পের শুরুটা হয় হঠাৎ করেই। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী থাকাকালীন ২০১৪ সালে অনলাইন ব্যবসা যখন দেশের মানুষের কাছে খুব একটা পরিচিত হয়ে ওঠেনি সেসময়েই সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরির যাত্রা শুরু করেন তিনি।
"আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জে। ছোটবেলা থেকেই ঘরে ঘরে তাঁতের কাজ দেখে তাঁতকে কখনো জীবনের চেয়ে আলাদা করে ভাবার সুযোগ হয়নি। ব্র্যাকে পড়ার সময় বন্ধুদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে তাঁতিদের কাছে কম দামে এত ভালো কোয়ালিটির শাড়ি দেখে তারা সবাই খুব অবাক হয়েছিল। প্রত্যেকেই অনেকগুলো শাড়ি কিনে নিয়ে আসে তাঁত ঘর থেকে। ওই ঘটনা থেকেই মাথায় এলো আমি তো এই শাড়ি গুলো নিয়ে নিজের ব্যবসা শুরু করতে পারি," বলেন লোরা খান।
ব্যবসার শুরুটা হয় মায়ের কাছ থেকে নেওয়া ৩০ হাজার টাকা দিয়ে। তবে মেয়ের ব্যবসায় সমর্থন ছিল না বাবার। "আর্কিটেকচার থেকে পড়ালেখা করে শাড়ি-চুড়ি বেচার ব্যবসা কেন করবে!" বলেছিলেন তিনি। তাই বাবার কাছ থেকে লুকিয়েই ব্যবসা চালিয়ে যান লোরা। কয়েকবছর পর যখন লোরার উদ্যোগ নিয়ে পত্রিকায় আর্টিকেল ছাপে তখন আবার বাবার কাছে জানান ব্যবসার কথা।
"এখন বাবা আমার কাজ নিয়ে বেশ খুশি। সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি নিয়ে কোথাও আলোচনা হলে নিজেই উৎসাহী হয়ে আমাকে দেখান," জানান লোরা।
আনকমন ডিজাইনের গয়নার প্রতি সবসময় ঝোঁক ছিল লোরা খানের। শুরুতে শাড়ির ছবি তোলার সময় নিজের সংগ্রহ করা নানা গয়না দিয়েই মডেলদের সাজাতেন। তখন ফেসবুক পেইজের দেওয়া ছবিগুলোতে শাড়ির চেয়েও গয়না নিয়ে জিজ্ঞাসা আসতো বেশী। সেখান থেকেই নিজের নকশায় গয়না বানানোর অনুপ্রেরণা পান তিনি।
লোরা বলেন, "আর্কিটেকচারে পড়ায় ডিজাইন করা, প্রেজেন্টেশন করার ব্যাপারে বেশ ভালো ধারণা ছিল আমার। নিজের ডিজাইন দিয়ে শাড়ি বনানোর সুযোগ ছিল না, কিন্তু নিজের ডিজাইনে গয়না বানানো তার চেয়ে সহজ ছিল। সাত বছর আগে সরাসরি না দেখে শাড়ি কেনায় মানুষ তেমন ভরসা করতে পারত না। তবে গয়না নিয়ে অনলাইনে ভরসা করা তুলনামূলক সহজ ছিল।"
নানা ধরনের সাধারণ ধাতু দিয়ে গয়নার নকশা করা শুরু করেন লোরা। শুরুতে পরিচিত অনেকেই টিপ্পনী কেটেছিল, "এসব গয়না কেউ পরবে নাকি!" বলে। কিন্তু গয়না বানানো শুরু করার পর আর কখনো এসব টিপন্নী শোনার সময়ই পাননি লোরা খান।
২০১৫ এর শেষে গয়না নিয়ে কাজ শুরুর পর শাড়ি আনায় কিছুটা ভাটা পড়ে গেলেও প্রায় প্রতিবছর শাড়ির একটা নতুন কালেকশন রাখার চেষ্টা করেন লোরা। শাড়ির ডিজাইন থেকে শুরু করে সরবরাহের জন্য পুরোপুরি তাঁতিদের উপরই নির্ভরশীল তিনি। তবে এখনও পর্যন্ত সব গয়না ডিজাইন করার কাজ নিজেই সামলান লোরা।
অভিনব আধুনিক ডিজাইনের গয়নার পাশাপাশি সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি সাবেকি ডিজাইনেকেও নতুন করে তুলে ধরার প্রয়াস করে। নানী-দাদীর আমলের গয়নার ডিজাইনের মাধ্যমে সময়ের নস্টালজিয়া জাগিয়ে তোলেন গ্রাহকদের মনে। বর্নমালা কানের দুল, বর্নমালা লকেট, চশমার চেইন ইত্যাদি তাদের অভিনব উদ্ভাবন। গয়না ছাড়াও বিয়ে উপলক্ষে রূপা বা তামায় নাম খোদাই করে বানানো কলম কাস্টমাইজ করে তারা। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির জন্য মনুমেন্ট বানানোর দায়িত্ব পেয়েছিল সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি।
নিজেদের রেগুলার ডিজাইনের বাইরেও কনেদের পছন্দ অনুসারে বিয়ের গয়না কাস্টমাইজড করে থাকে সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি। এজন্য দুই-এক মাস আগে যোগাযোগ করতে হবে তাদের সাথে। কাস্টমাইজড গয়নার মূল্য রেগুলার গয়নার কাছাকাছিই হয় বলে জানান লোরা।
২০১৪-১৫ সালের দিকে অনলাইন ব্যবসার তেমন প্রচলন না থাকায় নানা রকমের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে লোরাকে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ ছিল পণ্যের ডেলিভারি নিয়ে। সেসময়ে ডেলিভারির জন্য বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান ছিল না তেমন। অনেক সময়ই নিজেই কাস্টমারদের ঠিকানায় পার্সেল ডেলিভারি দিয়ে আসতেন। বেশ কয়েকবার পণ্য ডেলিভারির পর টাকা না দিয়ে ডেলিভারি ম্যানের লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু সব ধরনের দুর্ভোগ সামলে সেরা কাস্টমার সার্ভিস দিতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন লোরা। তিনি বলেন, "ব্যবসার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো কাস্টমার সার্ভিস।"
শুরুতে লোরার বন্ধুরাই সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরির প্রচারণায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন। শাড়ি আর গয়নার মডেল হিসেবেও ছিলেন বন্ধুরা। এখন ফেসবুকে এডের মাধ্যমে প্রচারণার কাজ করেন।
একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসায় লোরার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল কাজে তার সিরিয়সনেসের প্রতি মানুষকে বিশ্বাস করানো। কারিগর থেকে শুরু করে পরিবার পর্যন্ত সব জায়গায় মানুষ ভাবতো কিছুদিন পরই হয়ত এই কাজের সাথে আর যুক্ত থাকার সুযোগ পাবেন না। নিজের ব্যক্তিগত জীবন, সংসার সব সামলিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবেন না এই আশঙ্কা ছিল সবার। কিন্তু নিজের প্রতি লোরার বিশ্বাস অটুট ছিল সবসময়ই। বিয়ে আর এক সন্তানের মা হওয়ার পর এখন নিজের ক্যারিয়ারের প্রতি তার দায়িত্ব আরোও অনেক বেড়ে গেছে মনে করেন তিনি।
"আমার সন্তান যেন আমাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে এমন কাজ করতে চাই আমি," বলেন লোরা।
অনলাইনে নানা পেইজে তার গয়নার ডিজাইন চুরি করার ঘটনা ঘটে প্রায়ই। শুরুতে এসব নিয়ে খুব আপসেট হয়ে গেলেও এখন তেমন পাত্তা দেয়ার সময় পান না লোরা। বরং কাস্টমাররাই তার হয়ে সেসব নকলকারী পেইজকে কথা শুনিয়ে আসে এখন।
সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরির সব কাজ পরিচালনার দায়িত্বে আছেন লোরা খান নিজেই। এখন পর্যন্ত কোনো আউটলেট নেই তাদের। অনলাইনেই যেন সেরা সার্ভিস দেয়া যায় সে চেষ্টাই করছেন লোরা। অনলাইন কেনাকাটা সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে চান তিনি।
১৮ জন কর্মী নিয়ে একটি অফিস আছে সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরির। বর্তমানে তাদের গয়নার মূল কারিগর পাঁচ জন। তাদের নির্দেশে কাজ করেন আরো অনেক কারিগর। সাভারে সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরির নিজস্ব গয়নার ফ্যাক্টরি রয়েছে।
সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরির পণ্য সারা পৃথিবীতেই ডেলিভারির ব্যবস্থা আছে। বাংলাদেশের বাইরে আমেরিকা ও কানাডায় তাদের সবচেয়ে বেশী ক্রেতা। ২০১৯ সাল থেকে তাদের গয়না আমাজনের ওয়েবসাইটেও পাওয়া যাচ্ছে।
ভবিষ্যতে সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরিকে আন্তর্জার্তিক স্বনামধন্য ব্র্যান্ড হিসেবে দেখতে চান লোরা খান।