আফসানার স্কাইডাইভিং, স্নোবোর্ডিং, দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চার—সবই শাড়ি পরে
টোকিও স্কাইডাইভিং ক্লাবে বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল এক দিনে আফসানা বেগম অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে স্কাইডাইভিংয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। যদিও ক্লাবটি স্বাভাবিকভাবেই প্রতি সপ্তাহে তার মতো শত শত রোমাঞ্চ-সন্ধানীদের জন্য এই আয়োজন করে থাকেন। তবে আফসানা যেন সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। কেননা এই নারী শাড়ি পরে স্কাইডাইভিং করেছেন!
শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখে ক্লাবটির প্রশিক্ষক প্রথমে বলেন, "অন্য কিছু পরুন। এই ধরনের পোশাক পরা এবং ১৩ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে লাফ দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।" কিন্তু আফসানা শাড়ি পরেই ডাইভ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এমনটা শুধু স্কাইডাইভিংয়ের ক্ষেত্রেই নয়, বরং আফসানা নিখুঁতভাবে শাড়ি পরে আরও বহু কাজই করে থাকেন। যার মধ্যে শাড়ি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে যান, হাইওয়ে ধরে আত্মবিশ্বাসের সাথে স্কেটিং করেন, এমনকি বরফে আবৃত পথে স্নোবোর্ডও চালান।
নিজের মতো করে কিছু করার স্বাধীনতা আফসানাকে ক্ষমতায়ন ও নিজস্বতার এক আলাদা অনুভূতি দেয়। একইসাথে পাশাপাশি নারীত্বের বিষয়টি গভীরভাবে লালন করেন তিনি।
এই সম্পর্কে আফসানা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ইতিহাসের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কখন কী পরতে হবে সেটা পুরুষেরা ঠিক করে দিয়েছিল। আর নারীরা তা মেনে চলেছে। এক্ষেত্রে পিতৃতন্ত্রের এজেন্ট সবসময় পুরুষ নয়; অনেক সময় এমন অনেক নারীও ছিল যারা কখনও লড়াই করার তাগিদ অনুভব করেনি। কিন্তু আমি তাদের একজন হতে চাইনি।"
আফসানা ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতক পাশ করেন। ২০১৮ সালে তিনি 'হাউ মাইগ্রেশন প্লেইস অ্যা ক্যাটালিস্ট টু চেঞ্জ ম্যাসকুলিনিটি কনস্ট্রাকশন' শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকল্পে কাজ করতে জাপানে যান।
২০২১ সালে আফসানা জাপানের চিবা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি প্রোগ্রাম শুরু করেন। তিনি বলেন, "যদিও এটি প্রথম বিশ্বের দেশ তবুও জাপানে লিঙ্গ সমতা সূচকে উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে গেছে।"
২০২৩ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১২৫ তম স্থানে রয়েছে জাপান। যা দেশটিকে অন্যান্য জি৭ ভুক্ত দেশগুলির তুলনায় অনেক পিছিয়ে রেখেছে।
আফসানা বলেন, "জাপানের সমাজ অত্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক। দেশটিতে নারী-পুরুষের বেতনের ব্যবধানও প্রায় ২১ শতাংশ। সবজায়গায় শাড়ি পরা এবং এটি পরেই সব কাজ করা আমার দেশ ও জাপানের নারীদের জন্য নিজের অবস্থান তুলে ধরার অন্যতম উপায়।"
শাড়ি কখনো বাধা নয়
আফসানা মনে করেন, শাড়ি কখনো নারীর অগ্রগতির সঙ্গে যুক্ত নয়। কিন্তু এটিকে প্রায়ই বাধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একটি পোশাক হিসাবে এটিকে খুব একটা আরামদায়ক বলে মনে করা হয় না।
আফসানা বলেন, "আমি সবসময় শাড়ি পরার প্রতি আগ্রহী। স্নাতকে পড়াশোনার সময় নারী সহপাঠীদের প্রেজেন্টেশনে এটি পরতে উৎসাহিত করতাম। যদিও তারা প্রায়শই খুব সকাল, গরম বা বৃষ্টির কথা বলে সেটি পরতে রাজি হতো না।"
আমাদের উপমহাদেশে সভ্যতার সূচনাকাল থেকেই শাড়ি নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। ঐতিহাসিক দলিল থেকে জানা যায়, সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতার নারীরা কাপড় হিসেবে দেহে লম্বা টুকরো পরতেন। এটি পরেই তারা ঘরের সমস্ত কাজ করতেন।
সময়ের সাথে সাথে পছন্দের পরিবর্তনের সাথে সাথে নারীরা সালোয়ার-কামিজ এবং পশ্চিমা পোশাক পরতে শুরু করে। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক যুগে এই প্রবণতা দেখা যায়; দেশভাগের পরে তা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। আজকাল আমাদের দেশের বেশিরভাগ নারীরা শুধু বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানের শাড়ি পরেন।
আফসানা বলেন, "নারীরা যে পোশাক পরতে চান তা পরলে দোষের কিছু নেই। তবে আমার কথা হচ্ছে, শাড়িকে বাধা হিসেবে মনে করার যে রীতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেটিকে ভাঙা। কারণ এটি বাধা নয়। প্রকৃতপক্ষে, সেলাই ছাড়া এই কাপড়টি যে মসৃণতা দেয় তা অতুলনীয়।"
আফসানা আরও বলেন, "বিদেশে, বিশেষ করে জাপানে বাংলাদেশের খুব একটা পরিচিতি নেই। লোকেরা যখন কাউকে শাড়ি পরা দেখে, তখন তারা প্রায়শই তাদের ভারতীয় বলে ভুল করে। তখন পোশাকটি সম্পর্কে আরও জানতে কথোপকথন শুরু করে। আমার দেশ নিয়ে গর্ব করে কথা বলার এটাই সুযোগ।"
আফসানা মনে করেন শাড়ি নিজের পরিচয় ও সাংস্কৃতিক শিকড় সম্পর্কে বেশ শক্তিশালী বার্তা দেয়। তিনি বলেন, "শাড়ি সবসময় আমার কাছে শক্তির প্রতীক। আমাদের ইতিহাস জুড়ে, দেশের সমস্ত উল্লেখযোগ্য আন্দোলনের সময়, তা প্রতিবাদ হোক, যুদ্ধ হোক বা জাতিগঠনে নারীদের সবসময় শাড়ি পরতে এবং অংশ নিতে দেখা গেছে।"
শাড়ি পরার কোন 'সঠিক' উপায় আছে কি?
আফসানা মনে করেন, এটি একটি বিতর্কিত বিষয়।
তিনি অনেকটা জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে বলেন, "শাড়ি পরার সঠিক উপায় কী এবং কে তা নির্ধারণ করে? উপনিবেশের আগে ভারতীয় উপমহাদেশের নারীরা ব্লাউজ বা পেটিকোট ছাড়াই শাড়ি পরতেন। ঐতিহাসিক নথি অনুসারে, ঔপনিবেশিক শাসকরা নৈতিকতার নামে এই ধরনটিকে অশ্লীল বলে অভিহিত করে। অবশেষে উপনিবেশের ছোঁয়া শাড়ির উপরেও পড়ে। এখন আমরা সাধারণত যে ঐতিহ্যবাহী ব্লাউজ ও পেটিকোটের সাথে শাড়ি পরে থাকি, আমরা কি সত্যিই এটিকে আদর্শ উপায় বলতে পারি?"
শাড়ি পরার প্রথাগত পদ্ধতির মধ্যে আটকে না থেকে আফসানা বিভিন্ন স্টাইলে এটি পরেন। যা বিভিন্ন কাজের জন্য উপযুক্ত হয়। তিনি এই পদ্ধতিতে শাড়ি পরাকে ভুল মনে করেন না। যদিও অনেক লোক প্রায়শই 'প্রকৃত পদ্ধতি' থেকে বিচ্যুত হওয়ার জন্য তার সমালোচনা করে।
উদাহরণস্বরূপ, স্নোবোর্ডিংয়ের সময় আফসানা ব্লাউজ হিসাবে তাপপ্রতিরোধী টি-শার্টসহ একটি শাড়ি পরতেন। এক্ষেত্রে সাথে পেটিকোটের পরিবর্তে তিনি স্নোবোর্ডিং প্যান্টও ব্যবহার করেন।
এই সম্পর্কে আফসানা বলেন, "মাইনাস-ডিগ্রি তাপমাত্রায় আমি অন্য কোনো উপায়ে এটি করতে পারিনি। আমরা যদি প্রধান পোশাক হিসাবে শাড়ি পরার অভ্যাস করতে চাই তবে আমাদের অবশ্যই প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তনগুলোকে গ্রহণ করতে হবে।"
প্রকৃতপক্ষে, স্কাইডাইভিংয়ের সময় আফসানা শাড়িটি দক্ষিণ ভারতীয় স্টাইলে ধুতির মতো করে পরেছিলেন। সাথে আচলটি নিরাপত্তার জন্য বেল্টের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল।
"প্রথমে প্রশিক্ষক সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে স্কাইডাইভিংয়ের সময় আমাকে জোরালোভাবে শাড়ি পরার বিরুদ্ধে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে আমি এই পোশাকটি পরতেই সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। এমতাবস্থায় সিকিউরিটি প্রোটোকল অনুসরণ করতে আমার শাড়ি পরার ধরনে পরিবর্তন আনতে হয়েছিল।"