এ মাসেও কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে আরেকটি ভাষা
সাক্ষরতা হার বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, স্থল যোগাযোগে উন্নতি ও এরকম নানা কারণে এ শতাব্দীর শেষে বিশ্বের সাত হাজার ভাষার ২০ শতাংশই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, এ শতাব্দীতে প্রতি মাসে হারিয়ে যাবে একটি করে ভাষা।
ক্যানবেরার অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য। লিন্ডেল ব্রোমহামের নেতৃত্বে এ গবেষণায় অংশগ্রহণ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী, গণিতবিদ এবং ভাষাবিদদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল।
প্রাণিজগতের বিভিন্ন প্রজাতি হারিয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিতে যে মডেল ব্যবহৃত হয়, তার অনুরূপ একটি মডেল ব্যবহার করে পরিচালিত হয়েছে এ গবেষণা। এতে উঠে এসেছে, কার্যকর সংরক্ষণ ছাড়া ২১০০ সালের মধ্যে ভাষার ক্ষতি বাড়বে পাঁচগুণ।
গবেষণায় যেসব অনুমান দাঁড় করানো হয়েছে সেগুলো "রক্ষণশীল" দাবি করে গবেষণা দলের প্রধান ব্রোমহাম বলেন, "ভয় পাওয়ার মতো পরিসংখ্যান এটি।"
"একটি ভাষা হারিয়ে গেলে তার সঙ্গে হারিয়ে যায় আরও অনেক কিছু। আমরা সংস্কৃতির একটি সমৃদ্ধ উৎস হারাই, আমরা মানুষের সৃজনশীলতার একটি অনন্য এবং সুন্দর অভিব্যক্তি হারাই," যোগ করেন তিনি।
ভাষা হারিয়ে যাওয়া নিয়ে পূর্বে একাধিক গবেষণা হয়েছে। কিছু কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে, সামনের শতাব্দীতে বিশ্বের মোট ভাষার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বিলীন হয়ে যেতে পারে।
তবে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী ব্রোমহাম এবং তার সহকর্মীরা মনে করেন জীববৈচিত্র্য কমে আসা ও ভাষার বৈচিত্র্য কমে আসার ধরনটি অনেকাংশেই একরকম। তাই জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির উপর হওয়া গবেষণা থেকে মডেলিং কৌশল ধার করলে ভাষা বৈচিত্র্যের ক্ষতির পরিসংখ্যান আরও সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে বলে ধারণা করেন তারা।
বিলীন হয়ে গেছে বা এখনও মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে এমন ৬৫১১টি ভাষার উপর গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। এসব ভাষা বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনার মাত্রা নির্ণয় করেন তারা। নির্ণায়ক হিসেবে ভাষার আইনি স্বীকৃতি, জনসংখ্যা, শিক্ষা নীতি, পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার মতো মোট ৫১টি সূচক নির্ধারণ করা হয়।
গবেষণায় উঠে আসে, কাছাকাছি অন্যান্য ভাষা থাকলে সেটি একটি 'ছোট' ভাষার বিলীন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় না। বড় কোনো ভাষার সান্নিধ্যে থাকলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো সাধারণত বহুভাষী হয়ে ওঠে।
তবে ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা যেকোনো ভাষার জন্য ঝুঁকির। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, বা উঁচু পাহাড়ের উপত্যকায় বসবাস করা মানুষদের জন্য তাদের নিজস্ব ভাষা ধরে রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ে।
ব্রোমহ্যাম বলেন, স্থল যোগাযোগের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হওয়ায় বিশ্বজুড়ে অনেক ভাষা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কারণ, এসব রাস্তা গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে বৃহত্তর শহরগুলোর যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। যার ফলে বাণিজ্য বাড়ছে এবং কেন্দ্রীভূত সরকার ও তার সঙ্গে যুক্ত ভাষাগুলোর প্রভাব বাড়ছে।
শিক্ষার হার বৃদ্ধিও বিশ্বজুড়ে স্থানীয় ভাষাগুলোকে শঙ্কটাপন্ন করছে বলে জানান ব্রোমহ্যাম।
তিনি বলেন, "এটা খুবই উদ্বেগজনক। কিন্তু তার মানে এই না যে শিক্ষা খারাপ বা বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া উচিত নয়। আমরা বলতে চাই, এ সমস্যা এড়াতে স্কুলে একাধিক ভাষার চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে করে শিশুরা তাদের নিজস্ব আদিবাসী ভাষাকে বিসর্জন না দিয়েই শিক্ষার সুযোগ পায়।"
আদিবাদী ভাষাকে শঙ্কটাপন্ন করার জন্য অনেক আগে থেকেই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করে আসা হচ্ছে। ভাষাবিদ এবং নৃবিজ্ঞানী মেরিবেথ নেভিনস বলেন, স্কুল ব্যবস্থা যে ভাষাকে শঙ্কটাপন্ন করে, গবেষণায় উঠে আসা এই দাবিটি 'উদ্বেগজনক' হলেও 'বোধগম্য'।
তিনি বলেন, শুধু এক ভাষার ব্যবহার রয়েছে এমন "ঐতিহাসিকভাবে সীমাবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে ধাবিত করার জন্য" স্কুলে শিক্ষার্থীদের সাধারণত একমুখী শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে।
তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আধুনিক শিক্ষাক্রমের আওতায় স্কুলে শিক্ষার্থীদের এখন একাধিক ভাষা শেখানো হচ্ছে। বাংলাদেশেও মারমা, চাকমা, ত্রিপুরাসহ বেশ কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিশুদের নিজ ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে শিক্ষাবোর্ড।
কিন্তু দেশে আদিবাসী ভাষা রয়েছে ৪০টিরও বেশি। এরমধ্যে সিংহভাগ ভাষার কোনো স্বীকৃত বর্ণমালাই নেই।
আঞ্চলিক স্তরের ঝুঁকির কারণগুলোও উঠে এসেছে এই গবেষণায়। যেমন, আফ্রিকার কিছু অংশে ভাষার সংখ্যা হ্রাসের জন্য বড় বড় চারণভূমিকে কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবার ইউরোপে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধি ভাষাকে বিপদগ্রস্থ করছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কিছু অংশে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধিকেই "ভাষা ক্ষয়"-এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
কেন চরণভূমি ও তাপমাত্রার মতো বিষয়গুলো ভাষাকে বিপদগ্রস্থ করছে তা নিয়ে আরও ভবিষ্যৎ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান ব্রোমহাম।
ভাষাকে বিপদগ্রস্থ করার জন্য পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থাও একটি বড়সড় কারণ বলে দাবি করেন নেভিনস। তিনি বলেন, এই বিশ্বব্যবস্থা আদীবাদীদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার কারণেই নিজেদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। বিশ্বায়নের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ভাষাগুলো।
সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট।