পাহাড়ি গ্রামের দুই যমজ বোনের সেরার মুকুট জেতার গল্প
আঁকাবাঁকা পথ, দুই পাশে পাহাড়। সেই পাহাড়ের বুকে বাড়ি। সেখানে জন্ম, বেড়ে ওঠা। একটা টেলিভিশনই যেখানে স্বপ্নের মতো, সেখানে ইন্টারনেট রীতিমতো অষ্টমাশ্চর্য। এমন পাহাড়ি গ্রাম থেকে উঠে এসে বিজয়ের মালা গলায় জড়নো কতোটা কঠিন? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আনাই মগিনি ও আনুচিং মগিনির চেয়ে যোগ্য আর কে হতে পারে!
নাম দুটি এতক্ষণে সবারই জানা হয়ে গেছে। দেশের ফুটবলের খোঁজ রাখাদের কাছে অবশ্য নাম দুটি আগে থেকেই পরিচিত। বুধবারের পর আনাই ও আনুচিংয়ের নাম পৌঁছে গেছে দেশের সবখানে। টেলিভিশন থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম; সবখানে আলোচনায় যমজ এই দুই বোন, তুলে ধরা হচ্ছে তাদের বিজয়গাঁথা।
মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। গর্বিত দলটির অন্যতম সদস্য পাহাড়ি গ্রাম থেকে উঠে আসা এই দুই তরুণী। আনাই মগিনি আবার ফাইনাল জয়ের কাণ্ডারী। ডিফেন্ডার হলেও তার একমাত্র গোলেই ভারতকে হারিয়ে শেষ্ঠত্বের মুকুট জেতে স্বাগতিক বাংলাদেশ।
দলকে শিরোপা জেতানোয় আনাইয়ের মুখে সব সময় লেগে আছে চওড়া একটা হাসি। শিরোপা জয়ের পথে অবদান রাখা আনুচিংও তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। আলো ঝলমলে চারপাশ, টেলিভিশনের পর্দা, ইন্টারভিউ; সব মিলিয়ে স্বপ্নের মতো সময় কাটছে যমজ দুই বোনের। কিন্তু জীবনের এই মোড়টায় আসতে তাদেরকে কেমন পথ পেরোতে হয়েছে, কতোটা বাধা-বিপত্তি জয় করতে হয়েছে?
এক কথায় উত্তর দিলে, সেটা বন্ধুর পথ। কাটা বেছানো দুর্গম পথ পেরিয়ে আজকের এই অবস্থায় আসতে হয়েছে আনাই-আনুচিংদের। খাগড়াছড়ির সাতভাইয়াপাড়া পাহাড়ি গ্রামে জন্ম তাদের। ২০০৪ সালে আনাইয়ের জন্মের পাঁচ মিনিট মধ্যে আনুচিং পৃথিবীর মুখ দেখেন। সন্তানের জন্মে খুশির জোয়ার বয়ে যাওয়ার বদলে সে সময় তাদের বাবা-মা ছিলেন দুশ্চিন্তায়। অভাবের সংসারে দুই কন্যা সন্তানের আগমনে রিপ্রু মগিনি ও আপ্রমা মগিনি যেন মাঝ দরিয়ায় পড়ে যান।
তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে কীভাবে সংসার চলবে বুঝে উঠতে পারছিলেন না তারা। দুশ্চিন্তায় দিন থেমে থাকেনি, বেড়ে উঠেছেন আনাই-আনুচিংরা। সময় গড়ানোর সাথে সাথে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন তারা। এরপর স্বপ্নের পথে পা বাড়িয়ে দেওয়া আর ছন্দময় এগিয়ে চলা। যাদের আগমনে চিন্তার শেষ ছিল না রিপ্রু-আমপ্রার; সেই তারাই এখন সংসারের আশার প্রদীপ। তাদের আয়ে সুখে-শান্তিতে চলছে রিপ্রু-আমপ্রার সংসার।
ফুটবল খেলে বাবা-মায়ের সংসার আলোকিত করেছেন আনাই-আনুচিং। দুই মেয়ের আয়ে কয়েক বছর আগেই অভাব দূর হয়ে গেছে রিপ্রু-আমপ্রার সংসারের। ২০১৮ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ, পৌঁছায় দ্বিতীয় পর্বে। ওই দলের সবাইকে ১০ লাখ টাকা করে পুরস্কার দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আনাই ও আনুচিং মিলে পান ২০ লাখ টাকা। এই টাকা বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেন তারা, যা দিয়ে জমি কেনা হয়।
২০১১ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল দিয়ে যাত্রা শুরু আনাই-আনুচিংয়ের। খাগড়াছড়ি থেকে স্বপ্ন পূরণের উপায় ছিল না তাদের। সেখানে মেয়েদের দল না থাকায় নতুন পথ খুঁজতে হয় তাদের, চলে আসেন ঢাকার নারায়ণগঞ্জে। ২০১৩ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা দলের হয়ে খেলেন তারা। ২০১৫ সালে গিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা দলের হয়ে খেলার সুযোগ পান এই দুই যজম বোন। জেলা দলের হয়ে আলো ছড়িয়ে অনূর্ধ্ব-১৪ দলে জায়গা করে নেন তারা।
জন্ম কয়েক মিনিটের ব্যবধানে, প্রায় একই চেহারা, দুজনই ফুটবলার, খেলার শুরুও একই সঙ্গে। কিন্তু একটি জায়গায় তাদের অমিল। আনাই ডিফেন্ডার আর আনুচিং ফরোয়ার্ড। দুই বোন মাঠের দুই অংশে দাপট জারি রেখে কয়েক বছর ধরে জাতীয় দলে খেলে আসছেন, পাশাপাশি খেলে যাচ্ছেন বয়সভিত্তিক দলেও।
২০১৮ সালে ভুটানে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়, সেই দলের সদস্য ছিলেন আনাই-আনুচিং। দুটি আসরের শিরোপা জিতে আনাই-আনুচিংয়ের দৃষ্টি এবার আরও দূরে, যেখানে নিজেদের সেরার কাতারে দেখতে চান তারা।