অপারেশন নাফ রক্ষা: ফিরে দেখা
ডেট লাইন ২১ ডিসেম্বর, ১৯৯১। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর কক্সবাজার দেশের পর্যটন বিজ্ঞাপনের অনন্য এক 'পোস্টার গার্ল'। এবার শীত মৌসুমে এই পর্যটন শহরটির সমুদ্র তটে হাজার ভ্রমন পিপাসুর মিলন মেলা। কিন্তু এর পূর্ব দিকে বাংলাদেশ-বার্মা (মিয়ানমার) সীমান্ত এলাকায় তখন অন্য এক ধরনের উত্তেজনা। ঘুংধুম সীমান্ত বিওপিতে আজ বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) মহাপরিচালকের পরিদর্শন চলছে। এই পরিদর্শন চলাকালীন, সকাল প্রায় ১০ টার দিকে স্থানীয় ব্যাটালিয়ন কমান্ডার (অধিনায়ক) এক অপ্রত্যাশিত সংবাদ পেলেন। ওয়ারলেস সেটের মাধ্যমে মেজরকে জানানো হলো- "বার্মার সীমান্তরক্ষী লুনথিং বাহিনী রেজুপাড়া বিওপি আক্রমণ করেছে।" জেনারেলের নির্দেশে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার জিপ নিয়ে ছুটলেন উত্তরের রেজুপাড়ার দিকে। ...... এই ঘটনাই নাফ বা নে ম্রাই (বার্মিজ ভাষায়) নদীর দুই তীরে, দুই দেশের সেনাবাহিনীকে সম্ভাব্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মুখোমুখি করবে। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি কনভেনশনাল (প্রচলিত) যুদ্ধের সামরিক অভিযানে নিয়োজিত হবে। অভিযানের সাংকেতিক নাম "অপারেশন নাফ রক্ষা"।
১৯৯১ সালের ২১ ডিসেম্বর সকালে বার্মার লুনথিং বা লুন্টিন বাহিনী (বর্তমানে বর্ডার গার্ড পুলিশ) বান্দরবান জেলার নাইক্ষংছড়ি উপজেলাধীন বিডিআর এর (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি) একটি ব্যাটালিয়নের রেজুপাড়া বর্ডার আউট পোস্ট বা সীমান্ত চৌকি অতর্কিতভাবে আক্রমণ করে। অপ্রত্যাশিত এই আক্রমণে ঐ ব্যাটালিয়নের তিনজন সদস্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। লুনথিং বাহিনী ক্যাম্প থেকে বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে নেয়। এই ঘটনায় এলাকায় তীব্র অনিশ্চয়তা ও আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনী দৃঢ় ও অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করে এবং দ্রুত সামরিক ব্যবস্থার লক্ষ্যে সেনা মোতায়েন শুরু করে।
রেজুপাড়া বিওপি ঘটনার অব্যবহিত পরে বাংলাদেশ ও বার্মা উভয় রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সীমান্ত রেখা বরাবর তাদের সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করে। বার্মা অতি দ্রুত তাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করার লক্ষ্যে সীমান্ত জুড়ে সীমান্ত চৌকিতে বা সেগুলোর পশ্চাতে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেছিল। পরবর্তীতে জানা যায় যে, বার্মা কর্তৃপক্ষ এ ঘটনার আগে থেকেই এই অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছিল। এই সময় বার্মার পশ্চিম অঞ্চলের সামরিক কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার কে এন চিট পে। এদিকে ঘটনার পর পরই, বান্দরবান অঞ্চলের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে জরুরি ভিত্তিতে একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ও একটি আর্টিলারি ব্যাটারি কক্সবাজার-টেকনাফ অক্ষরেখায় মোতায়েন করা হয়। পদাতিক ব্যাটালিয়ানটি লেঃ কর্ণেল আবু শরাফত জামিলের অধিনায়কত্বে সীমান্ত এলাকায় অতি দ্রুত যুদ্ধকালীন প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিল। এই সময় নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীকেও বিশেষ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়।
পরবর্তীতে আরাকান সীমান্ত অঞ্চলের পরিস্থিতি বিবেচনায়, একটি পদাতিক ব্রিগেড গ্রুপ মোতায়েন করা হয়েছিল। এর ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মাহমুদ হাসান (প্রয়াত)। চট্টগ্রাম সেনানিবাসস্থ পদাতিক ডিভিশন সদরদপ্তর এই অভিযানের পরিকল্পনা, সৈন্য মোতায়েন, গমনাগমন এবং কার্য সম্পাদনের জন্য সার্বিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফর্মেশন ছিল। এর জিওসি ছিলেন মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান (প্রয়াত)। এই কনভেনশনাল সামরিক অপারেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার একটি ফর্মেশনকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষাপটে রণকৌশলগত গমনাগমন ও মোতায়েন সম্পন্নকরত একটি সম্ভাব্য সীমিত মাত্রার যুদ্ধ (লিমিটেড ওয়ার) শুরু করার পরিপূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল।
এ ঘটনার পর দুই দেশের সীমান্তে চরম উত্তেজনা বিরাজ করে। নিয়মিত সীমান্তরক্ষী ছাড়াও সীমান্তে অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশ করে যুদ্ধংদেহী মনোভাব ছিল দুদেশেরই। বার্মা সরকারের আগ্রাসী মনোভাব ও সীমান্তে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েনের ফলে আরাকানের রোহিঙ্গাদের মধ্যে তীব্র আতংক দেখা দেয়। বর্মী বাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন ও নির্বতনমূলক আচরণ শুরু করে। এর ফলে রোহিঙ্গা মুসলমানরা সীমান্ত অতিক্রম করে দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে।
সাপ্তাহিক বিচিত্রার তরুণ সাংবাদিক সেলিম ওমরাও খান, সীমান্ত অঞ্চলের সেই সব ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর রিপোর্টে উঠে এসেছে, সেই সময়ের সীমান্ত এলাকায় টান টান উত্তেজনার বিষয়টি। "কক্সবাজার থেকে দক্ষিণে টেকনাফের রাস্তায় পড়বে বালুখালি। সেখান থেকে পাকাঁ কাঁচা পথ আরাকান সড়ক ধরে ২ মাইল পূর্বে ঘুনদুম সীমান্ত। বাংলাদেশের শেষ একটি পাহাড়ের উপর বিডিআর ক্যাম্পের দৃশ্যপট থমথমে। তার আগে পাহাড়ের উপরে পড়বে একটি প্রাইমারী স্কুল। সেই স্কুলেও অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশী সৈন্যরা। ঘুনদুম সীমান্তের ২০০ গজ পূর্বে বার্মা সীমান্ত ডেকুবুনিয়া। বার্মার আধা-সামরিক লুন্টিন বাহিনী সেখানে তাদের অবস্থান জোর করেছে। তাদের ক্যাম্পের আশেপাশে অসংখ্য নতুন বাংকার খনন করা হয়েছে"। (বার্মা সীমান্তে সংঘাতের আশঙ্কা, সেলিম ওমরাও খান, বিচিত্রা, ১০ জানুয়ারী, ১৯৯২)।
রেজুপাড়ার ঘটনার পর, দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে বেশ কয়েকটি পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে দু'দেশের সীমান্ত উত্তেজনার মধ্যে বরফ গলতে শুরু করলেও বার্মা কর্তৃপক্ষ প্রথমদিকে বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে অস্ত্র লুট করার কথা স্বীকার করেনি। শুধু তাই নয়, প্রথম ফ্লাগ মিটিংয়ে (৩১ ডিসেম্বর, ১৯৯১) বার্মার প্রতিনিধি দল বলেছিল "রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশ সীমান্ত অনুপ্রবেশ করে অস্ত্র লুট করতে পারে"। তবে ২য় পতাকা বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার পর বার্মার প্রতিনিধি দল অস্ত্র লুটের কথা স্বীকার করে। এই পতাকা বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বিডিআরের চট্টগ্রাম সেক্টরের অধিনায়ক কর্ণেল আলী হাসান (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল)। ১৯৯২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি (৩য় বৈঠক) বার্মার মংডু শহরের টাউনশিপ হলে অনুষ্ঠিত ফ্ল্যাগ মিটিংয়ে লুনথিং বাহিনীর অধিনায়ক লেঃ কর্নেল সেন লুইন, বাংলাদেশ রাইফেলসের কক্সবাজার এলাকার ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের কাছে লুট করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেরত দেন। এই বিষয়ে কক্সবাজারের বিশিষ্ট সাংবাদিক মুহম্মদ নুরুল ইসলাম লিখেন- "অবশেষে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমরা টেকনাফ পৌঁছলাম। আমরা বার্মার আরাকান প্রদেশের মংডু টাউনশীপ থেকে ফিরে এসেছি এবং সাথে নিয়ে এসেছি বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করে লুটে নেয়া অস্ত্রশস্ত্র। একথা জানতে পেরে মানুষের মধ্যে আনন্দের দ্যুতি খেলে গেল"। (আরাকানের পথে পথে, মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম)। উল্লেখ্য সীমান্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যাপক মোতায়েন ও দৃঢ় মনোভাব বার্মিজ কতৃপক্ষকে অস্ত্র ফেরত দিতে বাধ্য করেছিল।
এই সব ঘটনা পরম্পরার এক পর্যায়ে বাংলাদেশের কূটনৈতিক, আন্তর্জাতিক এবং সামরিক চাপের কারণে বার্মার স্থানীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় ও রাষ্ট্রীয় উভয় পর্যায়ে আলোচনা শুরু এবং আন্তর্জাতিক সীমান্ত অঞ্চলে সামরিক উত্তেজনা হ্রাস করতে সম্মত হয়েছিল। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ও বার্মা উভয় রাষ্ট্র সফল কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে এই অঞ্চলে উত্তেজনা প্রশমিত হলে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর যুদ্ধংদেহী মনোভাব অনেকটাই কমে আসে।
এই অপারেশনে নিয়োজিত ব্রিগেড, ব্যাটালিয়ন, কোম্পানি ও প্লাটুন পর্যায়ের কমান্ডার (অধিনায়ক) ও সৈনিকগণের অনেকের কাছে সীমান্তের ফ্রন্ট লাইনের স্মৃতি প্রায় তিরিশ বছর পর এখনো জীবন্ত। তাঁদের চোখে এখনও ভাসে সেই সব দৃশ্যাবলি- দূর থেকে এসে সীমান্তে মোতায়েন হয়ে পুরোপুরি যুদ্ধের প্রস্তুতি, কখনো অস্ত্রে গোলা ভরে আদেশের অপেক্ষা, সীমান্তে আক্রমণাত্বক গোয়েন্দা তৎপরতা, লং রেঞ্চ টহলের স্মৃতি, সীমান্তে অজানা আশংকা, রুটিন ইন লাইন, প্রতিরক্ষা প্রস্তুতিতে এমনকি ট্রেঞ্চ খননেও স্থানীয় জনগণের অসাধারণ আন্তরিক সহযোগিতা......।
এ বিষয়ে, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অবসরপ্রাপ্ত) লিখেন- "১৯৯১ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে বাংলাদেশের তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের সীমান্ত চৌকি রেজুপাড়াতে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী নাসাকা বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালায় এবং কয়েকটি অস্ত্র লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। মিয়ানমারের অভিযোগ ছিল, তৎকালীন বিডিআরের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন নাসাকা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছিলো। আমার মনে হয়, স্বাধীন বাংলাদেশে ওই প্রথম একটি প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে সীমান্তে এত বৃহৎ আকারে সামরিক বাহিনী মোতায়েন হয়েছিল। শুধু সেনাবাহিনী নয়, মোতায়েন হয়েছিল তিনবাহিনী। ব্রিগেড অধিনায়ক হিসেবে আমি ওই বাহিনীর কমান্ডে প্রায় একমাস যুদ্ধাবস্থায় কাটিয়েছিলাম। পরে সীমান্ত থেকে সেনা অপসারণের পরপরই রাখাইন অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ব্যাপক আগমন ঘটে।" (সন্ত্রাস: দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন)
এই সময় সেনাসদরে ডাইরেকটর অফ মিলিটারি অপারেশন (ডিএমও), হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল)। তিনি 'মিশ্র কথন' বইতে এ বিষয়ে লিখেন- "পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, আমাদেরকে বেংগল রেজিমেন্ট এর একটি ব্যাটালিয়ন, আর্টিলারির একটি রেজিমেন্ট, একটি ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারসহ ছোট ছোট ইউনিটকে ঐ সীমান্তের নিকটবর্তী অবস্থানে যাবার জন্য আদেশ দিতে হয়। ঐ অপারেশনের নাম ছিল অপারেশন নাফ রক্ষা।"
রেজুপাড়ার ঘটনাটি দেশের দক্ষিন পূর্বাঞ্চলে আমাদের প্রতিরক্ষা চিন্তা ভাবনা বিশেষত হুমকি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল। এই অভিযান পরিচালনা কালে এই অঞ্চলে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বেশ কিছু দূর্বলতা ও ঘাটতি ধরা পড়ে। তবে পেশাগত মনোভাব ও উদ্যোগী ভূমিকার কারনে সেনাবাহিনী অল্প সময়ের মধ্যেই প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল।
পরবর্তীকালে, অপারেশন নাফ রক্ষার মূল্যায়ন, এই এলাকায় সামরিক শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখা ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, দক্ষিন বান্দরবান ও কক্সবাজার অঞ্চলের নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক উন্নয়ন ও পরিবর্তন আনা হয়েছে। বর্তমানে প্রতিরক্ষানীতির আলোকে 'ফোর্সেস গোল' বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর আধূনিকায়ন, সম্প্রসারন ও উন্নয়ন চলছে। অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প থেকে ২০১৫ সালে রামু অঞ্চলে একটি পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। নতুন এই ডিভিশনের পতাকা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে (১ মার্চ, ২০১৫) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন- "দেশের দক্ষিন পূর্ব অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রতি সকল হুমকি মোকাবিলায় নবগঠিত এই ডিভিশন কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আমি আশাবাদী"। এই অঞ্চলে সাবমেরিন ঘাঁটিসহ গড়ে উঠেছে নতুন নৌ ঘাঁটি। নৌবাহিনীতে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বড় কৌশলগত সংযোজন হলো সাবমেরিন। এটি বঙ্গোপসাগরের এই সমুদ্র এলাকার গেম-চেঞ্চার বলে মনে করা হয়।
এই অঞ্চলে নতুন বিমানঘাঁটি নির্মাণসহ বিমান বাহিনীর সক্ষমতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। পুনঃগঠিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পরিচালনায় সীমান্ত প্রতিরক্ষা ও ব্যবস্থাপনায়ও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়ও উন্নত হয়েছে। সার্বিক ভাবে গত ১০/১২ বছরে, দক্ষিন পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমুল বদলে গিয়েছে। তবে এটিই হয়তো যথেষ্ট নয়। এই অঞ্চলে প্রয়োজন আরো আধুনিক ও সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
এদিকে, কক্সবাজার জেলার সীমান্ত এলাকায় গত ৪ বছরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় ৩৪টি ক্যাম্পে প্রায় ১১ লক্ষেরও বেশী রোহিঙ্গার বাস। বাংলাদেশের জন্য যা অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। গোলাগুলি ও হামলায় রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে ক্যাম্পগুলোর পরিবেশ।
অন্যদিকে, কক্সবাজার ঘিরে মেগাপ্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে, আগামী কয়েক বছরে কক্সবাজার হতে চলেছে (মাতার বাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রেল যোগাযোগ, বৈদ্যুতিক হাব, পর্যটন পার্ক, অর্থনৈতিক অঞ্চল...) এক অর্থনৈতিক গেম-চেঞ্চার। সাধারণভাবে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের গুরুত্ব এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। এই অঞ্চল তাই বাড়তি মনোযোগ দাবি রাখে।
রোহিঙ্গা ইস্যু, সীমান্তে অস্থিরতা, বার্মার গৃহযুদ্ধ, কক্সবাজার এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন ও কৌশলগত বিষয় বিবেচনায় এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করা সময়ের দাবী। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বর্তমানে কূটনৈতিক ময়দানে রীতিমতো লড়ছে বাংলাদেশ। এই কূটনীতির সঙ্গে প্রয়োজন সামরিক সক্ষমতা। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে তাই 'ডেটারেন্স' (যে শক্তিশালী অবস্থান অন্য দেশকে বাংলাদেশ আক্রমণে নিরুৎসাহিত করবে) অর্জন করতেই হবে। এর সঙ্গে আরো প্রয়োজন সকল বাহিনীর সমন্বয় ও যৌথতা, সমন্বিত অনুশীলন, ড্রোনসহ উপযোগী অস্ত্র সরঞ্জামাদি সংযোজন, লজিসটিক সমর্থন, ব্যাপক গোয়েন্দা কার্যক্রম, বার্মার অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলী মনিটরিং করা ও স্মার্ট ব্যবস্থাপনা।
১৯৯১ থেকে ২০২১। এই ৩০ বছরে কালের স্রোতে নাফ নদী ও রেজুখাল দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। বাংলাদেশ- বার্মা সীমান্ত অঞ্চলের পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে গৃহযুদ্ধের ব্যাপকতায় বার্মা রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তেও পারে- এমন আশংকাও আছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের করনীয় কি, তাও ভাবতে হবে।
মনে রাখতে হবে, আমরা বর্তমানে মোকাবিলা করছি বা কাজ করছি বার্মা সামরিক জান্তা সরকারের সঙ্গে (মূলত তাতমাদো বা সামরিক বাহিনী)। যারা গণহত্যাকারী, বেপরোয়া ও জনবিচ্ছিন্ন। কিন্তু এটি অত্যন্ত শক্তিশালী, চতুর ও অত্যন্ত দক্ষ প্রতিষ্ঠান। (যার পেছনে রয়েছে একটি শক্তিশালী পরাশক্তি)। রেজুপাড়ার মতো ঘটনা আর নয়। সদা সতর্ক থাকাই স্বাধীনতার মূল্য। 'অপারেশন নাফ' রক্ষার আভিযানিক দিকগুলোর পূণঃমূল্যায়ন বা পূনঃপাঠ তাই এখনো প্রাসঙ্গিক। রেজুপাড়া ঘটনায় শহীদ সীমান্ত রক্ষীদের স্মরন করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়। অপারেশন নাফ রক্ষায় অংশগ্রহনকারী সেনা বাহিনীর সকল সদস্য ও বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদস্যদের অভিবাদন।
- লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক
- [email protected]