‘লঞ্চে থাকলে আগুনে মরা লাগবে, ঝাঁপ দিলে নদীতে’
আব্দুর রাজ্জাক (৬৫) বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার দাখিল মাদ্রাসার গণিত বিভাগের শিক্ষক। দিন দশেক আগে ঢাকায় আসেন অসুস্থ স্ত্রী হনুফা বেগমের চিকিৎসার কাজে। রাজধানীর এই হাসপাতাল, ওই হাসপাতাল ঘুরে গত বৃহস্পতিবারের লঞ্চ ধরেন বাড়ি ফিরবেন বলে। সাথে স্ত্রী হনুফা আক্তার আর মেয়ে রুবি আক্তার। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে লঞ্চে তিলধারণের জায়গা ছিল না। শেষমেষ একটা কেবিন জোগাড় করে পাথরঘাটার উদ্দেশে রওনা দেন। ভোরেই পৌঁছার কথা গন্তব্যে; কিন্তু লঞ্চের আগুনে শেষ হয়ে গেল সব।
গণিতের শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাকের বাড়ি ফেরা হয়নি। শুক্রবার ভোরে ঝালকাঠির নলছিটি এলাকায় লঞ্চ 'এমভি অভিযান-১০' তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারেনি, ঠাঁই হয়েছে কাঠের কফিনে। স্ত্রী হনুফা আক্তার আর মেয়ে রুবি আক্তার আগুনে পুড়ে লড়ছেন বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে। তারা এখনো জানেন না আব্দুর রাজ্জাকের পরিণতি।
স্ত্রী হনুফা বেগম মুঠোফোনে তার আত্মীয়দের জানান, ভোর রাতে লঞ্চের ইঞ্জিনরুমের দিকে আগুন দেখে দ্রুতই কেবিন থেকে বের হয়ে যান।
"পুরো লঞ্চে মানুষের ছুটাছুটি, মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের কান্নাকাটি আর কাঠ-লোহা পোড়ার শব্দে একাকার। এর মাঝেই আমাদের শরীরে আগুন লাগার পর আমাকে ও মেয়ে রুবিকে লঞ্চের সামনের দিকে ঠেলে দেন তিনি (আব্দুর রাজ্জাক)। পরে তাকে আর দেখতে পাইনি। এরপর জ্ঞান ফিরলে দেখি আমরা হাসপাতালে," বলতে বলতেই মূর্ছা যান হনুফা বেগম।
তিনি আরও বলেন, "আমার স্বামী কোন হাসপাতালে আছে আপনারা বলেন। আমার স্বামীর কাছে যাবো। একমাত্র মেয়ে রুবি পাশেই যন্ত্রণায় ছটফট করছে, ও বাবাকে খুঁজছে।"
আব্দুর রাজ্জাক পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘা দাখিল মাদরাসার ইংরেজি শিক্ষক। তার বাড়ি পাথরঘাটা পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। মেয়ে রুবি আক্তার বরিশাল বিএম কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।
হনুফা বেগমের মেয়েজামাই রানা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আগুনে হনুফা বেগমের দুই হাত এবং পা পুড়ে গেছে। রুবি আক্তারের অবস্থা আরো ভয়াবহ, তার শরীরের প্রায় পুরোটাই পুড়ে গেছে। দুইজনই চিকিৎসাধীন রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর খবর তাদের জানানো হয়নি।
লঞ্চের আগুনে ঝলসে যাওয়া জেসমিন আক্তার (৩৫) ও ছেলে মো. তানিম হাসানকে (০৮) শুক্রবার বিকালে বরিশাল থেকে ঢাকার শেখ হাসিনা ন্যাশনাল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিউটে আনা হয়। ঢাকায় আসার পথেই মৃত্যুর কাছে হার মানে জেসমিন আক্তারের আট বছরের ছেলে। শেখ হাসিনা বার্ন ইন্সটিটিউটের শয্যায় ঝলসে যাওয়া শরীর নিয়ে জেসমিন কাতরাতে কাতরাতে নিজের ছেলেকে খুঁজছেন আর মূর্ছা যাচ্ছেন।
যখন লঞ্চে আগুন লাগলো তখন কিছু বুঝে উঠতে পারেনি কেউ। অল্প সময়ের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পরলে অনেকেই লঞ্চ থেকে লাফ দেয় মাঝ নদীতে।
১৩ বছরের ছেলে ইমরান হোসেনকে নিয়ে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া যাচ্ছিলেন, অভিযান-১০ লঞ্চের ডেকের যাত্রী রিনা বেগম। ভোররাতে আগুন দেখে ছেলেকে নিয়ে দোয়া-দরুদ পড়া শুরু করে দেন।
"জাহান্নামের আগুনের কথা শুনেছি, আজ নিজের চোখে দেখলাম আগুন কত ভয়াবহ। ছেলেকে বলেছি, বাবা পড়াশুনা আর রেজাল্টের জন্য তোমাকে অনেক মেরেছি, বকাঝকা করেছি, মাফ করে দিও। দেখা হবে কেয়ামতে, এই বলে ছেলেকে চুমু দেই। তখন সেও আমার গালে চুমু দেয়।"
রিনা বলেন, "ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় আমাদের বসবাস, বাবার বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় আর শ্বশুরবাড়ি বরগুনার পাথরঘাটায়। তিন দিনের ছুটিতে ছেলেকে নিয়ে তার নানার বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিলাম।"
"লঞ্চে ওঠার সময়েই দেখি পুরো লঞ্চে যাত্রী পরিপূর্ণ, কেবিনও পাইনি তাই নীচতলার ডেকের মাঝামাঝি একটু জায়গা পেয়ে সেখানে বসে পড়ি। এরপর রাতে ছেলে ঘুমালেও আমি ঘুমাতে পারিনি। হঠাৎ করে যখন ডেকের ভেতরে ধোঁয়া আর আগুন আসতে থাকে, তখন ছেলেকে টেনে অপরদিকে নিয়ে যাই। ততক্ষণে দেখি অনেকেই নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছে। কিন্তু আমার ছেলে তো সাঁতার জানে না, তাই নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। আর তখন লঞ্চটি মাঝনদীতে। এ যেন উভয় সংকট, লঞ্চে থাকলে আগুনে মরা লাগবে, ঝাঁপ দিলে নদীতে।"
তিনি বলেন, "শেষ পর্যন্ত উপায়ন্তর না দেখে ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেই। এরপর দেখি ছেলের মাথা ভাসছে। তখন আমিও বোরকা ছিঁড়ে ফেলে নদীতে ঝাপ দেই। ছেলেকে ধরে কোনভাবে খুব কষ্টে সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হই। এরপর নদীতীরের লোকজন সহায়তায় এগিয়ে আসেন।"
এদিকে তাইফা আফরিন (১০)-কে পাগলের মত খুঁজছেন তার বাবা বশির উদ্দিন। বশির গুরুতর দগ্ধ হয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
তাইফার স্বজনরা জানান, তাইফার নানা আলী শিকদার ক্যান্সারে ভুগছিলেন। তাকে ডাক্তার দেখাতে ঢাকায় ছিলেন তাইফা ও তার বাবা বশির। বৃহস্পতিবার ফিরছিলেন নিজেদের বাড়ি বরগুনার কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নে। লঞ্চে আগুনের উত্তাপ বাড়লে তাইফার নানা জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দেন। ডেকে আটকা পড়েন তাইফা ও তার বাবা। তাইফা অগ্নিদগ্ধ হয়ে লঞ্চেই মারা যায়, আর তার বাবা বশির এখন গুরুতর দগ্ধ। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন তাইফার নানা আলী শিকদার।
ঝালকাঠি জেলার সুগন্ধা নদীতে গত বৃহস্পতিবার (২৪ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ৩টার দিকে চলন্ত লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৪০ যাত্রী নিহত হয়েছেন। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
'এমভি অভিযান-১০' নামের লঞ্চটি ঢাকা থেকে বরগুনা যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে।