রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে সাধুবাদ জানাই
রাষ্ট্রপতি নিজেও নির্বাচন কমিশন নিয়োগের জন্য আলাদা আইন চান। নির্বাচন কমিশন নিয়োগের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির ডাকা চলমান সংলাপে তরিকত ফেডারেশন ও খেলাফত মজলিসের সঙ্গে পৃথক সংলাপে তিনি (রাষ্ট্রপতি) নির্বাচন কমিশন নিয়োগর জন্য আইন থাকা দরকার বলে মন্তব্য করেন। গতকাল ১৪ দলের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে সংলাপেও রাষ্ট্রপতি একই মনোভাব ব্যক্ত করেন। নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আইনের কথা রাষ্ট্রপতি এমন সময় বলেছেন, যখন তিনি রাষ্ট্রপতি কার্যকালের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষের দিকে অবস্থান করছেন।
বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল, এমনকি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলও উক্ত আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। ক্ষমতাসীন দল জানিয়েছে, আসছে বছরের গোড়াতেই তারা এই আইন তৈরি করাবে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি জানিয়েছে, সরকার চাইলে সংসদ একদিনের মধ্যেই আইন তৈরি করতে পারে যার ইতিহাস বহুবার বাংলাদেশের সংসদের আছে।
৩০ ডিসেম্বর ২০২১ প্রধান বিচারপতির শেষ কর্মদিবস। বিদায়ের সময়টাতে আদালত শীতকালীন অবকাশে থাকবে। ফলে বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা সারতে হলো আদালত অবকাশ ছুটিতে যাবার আগে। সুপ্রিম কোর্টের রেওয়াজ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আয়োজিত বিদায় সংবর্ধনায় প্রধান বিচারপতি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। তিনি বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও দ্রুততার কথা উল্লেখ করেছেন। বর্তমান মামলার সংখ্যা উল্লেখ করে বিচারপতির সংখ্যা দ্বিগুণ করার কথা বলেছেন। সংবিধানের আলোকে বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন জরুরি এবং এটা হলে বিচারপতি নিয়োগে স্বচ্ছতা ও জনমানসে বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণা দুর হবে।
দীর্ঘ চল্লিশ বছর আইন অঙ্গনের মানুষ আজকের প্রধান বিচারপতি, ১৯৮১ সালে আইনজীবী হিসেবে জেলা বারের সনদ প্রাপ্ত হয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯৯ সালে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ২০০১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে এবং এর দুই বছর পর ২০০৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি একই বিভাগে স্থায়ী নিয়োগ পান। এরপর ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি আপীল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম দীর্ঘ মেয়াদি প্রধান বিচারপতি।
প্রধান বিচারপতির সময়ে অনেকগুলো ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যার মধ্যে কোম্পানি ও অ্যাডমিরালটি মামলার ই-ফাইলিং অন্যতম। বিচার অঙ্গনের অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়াও অনেকগুলো উন্নয়ন কাজ সাধিত হয়েছে এই সময়ে। করোনার সময়ে ভার্চুয়াল আদালত গঠন ও পরিচালনা এক জরুরি উদ্যোগ।
সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়ে উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি আড়াল হয়ে যায়।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এই সমস্যা নিরসনের জন্য সার্কিট বেঞ্চ গঠনের কথা জানি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও তাদের পশ্চিম দিনাজপুরবাসীর পশ্চিমবাংলা হাইকোর্ট বিভাগের সার্কিট বেঞ্চ রয়েছে। বিচার প্রত্যাশি মানুষকে কলকাতা আসার প্রয়োজন হয় না। এই একই দাবি আমাদের এখানেও অনেক পুরাতন। আমাদের ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে চট্টগ্রামে সার্কিট বেঞ্চ গঠনের কথা বলা হয়েছিল। ক্ষমতাসীনদের তিন মেয়াদ এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতির প্রায় চার বছরের মেয়াদকাল শেষ হতে চললো। জনসাধারণের দুর্ভোগ, হয়রানি ও আর্থিক ক্ষতির কোন সুরাহা হয়নি। আজকের প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের জনসভায়, 'ক্ষমতায় গেলে' চট্টগ্রামে হাইকোর্টের একটা সার্কিট বেঞ্চ গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। নির্বাচনে জয়লাভের পর এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল বলে আমরা জানি। কিছু অবকাঠামোগত অসুবিধার কথা উল্লেখ করে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির দপ্তর থেকে জানানো হয়েছিল, 'এখন চালু করার পর্যায়ে নেই'। প্রধান বিচারপতির দপ্তরের এই মতামতের মধ্য দিয়ে সরকারের উদ্যোগকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। একটু আন্তরিক হলে বা জনসাধারণের ক্ষতির দিকটি সহানুভুতির সঙ্গে দেখলে ঢাকার বাইরে সার্কিট বেঞ্চ গঠন সম্ভব ছিল। চট্টগ্রাম দিয়ে শুরু করে পর্যায়ক্রমে দেশের দুর বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের বেঞ্চ চালু করা গেলে, মানুষ বিচার প্রার্থণার কারণে-অকারণ অর্থ ব্যয়, হয়রানি ও ভোগান্তি থেকে রক্ষা পেত। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, প্রধান বিচারপতি লম্বা সময় (প্রায় ৪ বছর) পেয়েছেন দায়িত্ব পালনের জন্য। তিনি কার্যকর উদ্যোগ নিলে ঢাকার বাইরে বেঞ্চ গঠন সম্ভব ছিল।
রাষ্ট্রপতি প্রায় প্রতিদিন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে যে সংলাপ করছেন। কোন কোন দিন একাধিক দলের সঙ্গে সংলাপ করছেন। পত্রিকায় দেখলাম সংলাপে অংশ নেওয়া কোন নেতা তার স্ত্রী'র নাম রাষ্ট্রপতির কাছে দিয়েছেন, যেন তার স্ত্রীকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে (সার্চ কমিটির সদস্য নয়) বিবেচনা করা হয়। এই হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন। নির্বাচন কমিশনকে কুক্ষিগত করা বা যে কোন উপায়ে প্রভাব বিস্তার করার মানসিকতা থাকলে এই সংলাপ কোনো আলোর মুখ দেখাতে ব্যর্থ হবে। এর আগের সংলাপগুলোতেও একই ঘটনা ঘটেছে। সবাই চেষ্টা করেছেন, যেন তার পক্ষের কেউ নির্বাচন কমিশনে থাকেন। সবাই নিজের লোকের নাম পকেটে নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নিয়েছেন। ফলে এই জাতীয় সংলাপের ফলাফল কী হতে পারে?
সামগ্রিকভাবে একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কেবলমাত্র নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। কমিশনকে নির্ভর করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনের উপর। সেই প্রশাসন এখন ভীষণভাবে দলবাজিতে আচ্ছন্ন। ফলে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ হলেই সমস্যার সমাধান হবে না। প্রয়োজন দৃঢ়তা ও দক্ষতা। দলবাজ প্রশাসনকে আইন অনুযায়ী দলনিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে বাধ্য করা। আমরা ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশনের কথা জানি। যিনি তাদের সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে বাধ্য করেছিলেন। রাষ্ট্রপতির চলমান সংলাপ কেবলমাত্র সার্চ কমিটির সদস্য কারা হবেন, তার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমগ্র নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। যার প্রতিফলন নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আইন প্রণয়নের সময় সন্নিবেশিত করা যেতে পারে।
সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠনের রীতি শুরু হয়েছিল প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সময় হতে। ২০১২ সালে কাজী রকিবউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন কমিশন গঠনের আগে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান করে চার সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সদস্য হিসেবে ছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, তৎকালীন মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এবং সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান। বর্তমান কে এম নুরুল হুদা কমিশনের আগেও ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি করেছিলেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
যেকোনো হতাশা ব্যক্ত করার আগে বলতে চাই, রাষ্ট্রপতির উদ্যোগটি গণতান্ত্রিক। এই চর্চা অন্যান্য ক্ষেত্রে থাকলে আমরা আরো এগুতে পারতাম। তবে আমাদের সংবিধান সবকিছুতে 'প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে'র এই ধারণাটি গণতান্ত্রিকতার প্রতিবন্ধক বলে মনে হয়। এখানে সামষ্টিকতার ধারণা ব্যাহত হয় বলে ধারণা করা যায়। তারপরও রাষ্ট্রপতির সদিচ্ছাকে সাধুবাদ জানাই। আগের সার্চ কমিটির সুপারিশেই বর্তমান নূরুল হুদা কমিশন গঠিত হয়েছিল। এই হুদা কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা শূন্যের কোঠায়। গোটা নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেবার অভিযোগে রয়েছে হুদা কমিশনের বিরুদ্ধে। তারপরও আমরা রাষ্ট্রপতির তৃতীয়বারের এই উদ্যোগের ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখতে চাই। বিদায়ের বেলায় হোক তবু যে প্রত্যাশা জনগণের সামনে এসেছে তার জন্য আমরা সাধুবাদ জানাই দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে।