মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর: ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ
কক্সবাজারের মহেশখালীতে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পে লবণ মাঠ হিসেবে অধিগ্রহণকৃত ভূমির ক্ষতিপূরণ মূল্য পাচ্ছে প্রকল্প এলাকার প্রায় ২০০ পরিবার। এর আগে নাল জমি হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। একর প্রতি দেওয়া হচ্ছিল ২৪ লাখ টাকা ।
তবে স্থানীয়দের আপত্তির মুখে ভূমি মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে এবার লবণ মাঠ হিসেবে তাদের দেওয়া হচ্ছে ক্ষতিপূরণ। এখন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো পাবে একর প্রতি ৫৫ লাখ টাকা।
ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন হওয়ায় ক্ষতিপূরণ বাবদ চট্টগ্রাম বন্দরকে আরো প্রায় ৮৭ কোটি ৪৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অধিগ্রহণকৃত জায়গার মালিকানা রয়েছে ২২৯ জনের। সেখানে এখনও বসতি রয়েছে।
এর আগে গত ২ জুন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নাল জমি হিসেবে ভূমির অধিগ্রহণ মূল্য বাবদ কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে ৭৫ কোটি ১১ লাখ ৫৯ হাজার ২৭৫ টাকার চেক প্রদান করেছিলো। বর্তমানে ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে অধিগ্রহণ বাবদ ২৮৩ দশমিক ২৭ একর ভূমির ক্ষতিপূরণ মূল্য ১৬২ কোটি ৫৮ লাখ ১৪ হাজার ২৭১ টাকা পরিশোধ করতে হবে।
ইতোমধ্যে অধিগ্রহণ মূল্য বাবদ অতিরিক্ত আরো ৮৭ কোটি ৪৬ লাখ ৫৪ হাজার ৯৯৬ দশমিক শূন্য এক টাকা পরিশোধ করতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ আমিন আল পারভেজ টিবিএসকে বলেন, অধিগ্রহণের বাকি টাকা পরিশোধের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে ডিসেম্বরের ২য় সপ্তাহে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ টাকা পরিশোধের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। জেলা প্রশাসনকে টাকা পরিশোধের পর ভূমির মালিকদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এতে মাতারবাড়ি বন্দর প্রকল্পের ভূমি সংক্রান্ত আর কোন জটিলতা থাকবেনা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান টিবিএসকে বলেন, অধিগ্রহণ বাবদ বাকি টাকা পরিশোধে চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষ থেকে কোন সমস্যা নেই। যেহেতু মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দিয়েছে আমরা অধিগ্রহণের বাকি টাকা পরিশোধ করবো। জমির শ্রেণী নির্ধারণ সংক্রান্ত জটিলতায় প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যতটুকু অপচয় হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে যাতে এর প্রভাব না পড়ে তাতে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হবে।
ধলঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি সরেজমিন পরিদর্শনে এসে যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে প্রকল্প এলাকার ভূমি মালিকরা সন্তুষ্ট। শুরুতে নাল জমি হিসেবে অধিগ্রহণ করায় ভূমি মালিকরা পেত একর প্রতি ২৪ লাখ টাকা। এখন তারা পাবে একর প্রতি ৫৫ লাখ টাকা। এতে জমি হস্তান্তর করা পরিবারগুলো আর্থিকভাবে উপকৃত হবে।
শুরুতে নাল জমি হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দেওয়া ৭৫ কোটি ১১ লাখ ৫৯ হাজার ২৭৫ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। কিন্তু জমির মালিকরা জেলা প্রশাসনকে জানিয়ে আসছিলো অধিগ্রহণকৃত এই জমি নাল নয়। এগুলো লবণ মাঠ। তাই তারা কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ নাল জমি হিসেবে টাকা গ্রহণ করতে রাজি নয়। পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকরা ভূমিমন্ত্রীকে লিখিতভাবে জানান।
মাতারবাড়ি বন্দরের জমি অধিগ্রহণের শ্রেণী নিয়ে জটিলতায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধিগ্রহণ-২ এর উপসচিব মোঃ আসাদুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে গত আগস্টে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়। এ কমিটিতে সদস্য করা হয় কক্সবাজারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কানুনগো, সংশ্লিষ্ট প্রত্যাশী সংস্থার প্রতিনিধিকে। কমিটি গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে দুই দিন সরেজমিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন।
কমিটির প্রধান মোঃ আসাদুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, ১০ বছর আগের গুগল ম্যাপ পরীক্ষা এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে সরেজমিন পরিদর্শনে আমরা নিশ্চিত হয়েছি প্রকল্প এলাকার জমি লবণ মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেখানে ৬ মাস লবণ চাষ এবং বাকি ছয় মাস চিংড়ি চাষ হয়। তাই তদন্ত প্রতিবেদনে আমরা ওই জমি লবণ মাঠ হিসেবে চিহ্নিত করার সুপারিশ করেছি। আমাদের রিপোর্টের পর মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভূমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সে অনুযায়ী জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হয়। এই প্রেক্ষিতে ভূমির মালিকরা লবণ মাঠ হিসেবে অধিগ্রহণ মূল্য পাবে।
শুরুতে নাল জমি হিসেবে ক্ষতি্পূরণ বাবদ টাকা পরিশোধের পরও কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে জমির দখল বুঝে না পাওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষ থেকে বার বার চিঠি দিচ্ছিল মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মীর জাহিদ হাসান। ওই চিঠিগুলোতে উল্লেখ করা হয়, জমির দখলভার বুঝে না পাওয়ার কারণে ড্রেজিং কার্যক্রম সহ প্রকল্পের অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যন্ডার্ড পত্রিকায় গত ২৫ আগস্ট একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার ধলঘাট এলাকায় নির্মিত হবে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর বন্দর ভবন চত্বরে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধমে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার ঘোষণা দেয়।
২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণ কাজ শেষ হলে মাতারবাড়ি বন্দরের টার্মিনালে ভিড়তে পারবে ১৮.৫ মিটার গভীরতার জাহাজ। এই বন্দরে ৮ থেকে ১০ হাজার কন্টেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। প্রাথমিকভাবে ৮ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করার লক্ষ্যে ডিজাইন করা হচ্ছে। পরে জেটি বাড়লে সক্ষমতা আরো বাড়বে।
মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২,৮৯২ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২,৬৭১ কোটি টাকা। প্রকল্প নির্মাণের মেয়াদ ২০২১ সাল থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত।
মাতারবাড়িতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় চ্যানেল ও জেটি। ২০১৫ সালে শুরু হয় জেটি নির্মাণের কাজ। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রথম বাণিজ্যিক জাহাজ ভেনাস ট্রায়াম্প ভেড়ে মাতারবাড়ি চ্যানেলের জেটিতে। এরপর চলতি বছরের ১৫ জুলাই দ্বিতীয় জেটিতে প্রথমবারের মতো ভেড়ে বাণিজ্যিক জাহাজ এমভি হরিজন ৯। বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শেষে জেটি ও চ্যানেল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে।