সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়ই বন্ধ স্কুল ফিডিং
বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা ভোলা থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে, মেঘনার মোহনায় অবস্থিত দ্বীপ চর কুকরি মুকরি। এখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত শিশুরা আসে সকালের খাবার না খেয়েই। তাদের মধ্যে আবার অনেক শিশুই স্কুল থেকে দেওয়া দুপুরের খাবার না খেয়ে বাড়িতে নিয়ে যায়।
এই শিশুরা স্কুলে আসেই বিনামূল্যে দেওয়া খাবারের জন্য।
তারা সর্বশেষ এই বিনামূল্যের খাবার পেয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে।
চর কুকরি মুকরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রহিমা খানম বলেন, 'বাচ্চাদের বিস্কুট দেওয়া বন্ধ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।' তিনি বলেন, মহামারির কারণে এমনিতেই আয়-সংকটে আছে মানুষ; এর মাঝে শিক্ষার্থীদের স্কুলে খাবার দেওয়া বন্ধ করে দিলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও বাড়বে।
মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এর মাঝে দেশজুড়ে স্কুলে খাবার দেওয়ার কর্মসূচি বন্ধ করে দিলে অনেক শিক্ষার্থীই স্কুলে ফিরতে উৎসাহ পাবে না। প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান যখন শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফেরাতে এবং পড়াশোনার ঘাটতি পোষাতে তাদের স্কুলগুলোতে খাবার দেওয়ার কর্মসূচি বাড়াচ্ছে, সে সময়ই উল্টো পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিল বাংলাদেশ।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানানন, 'স্কুল খাওয়ানোর কর্মসূচি ফের চালু করার কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই।' কর্মসূচিটি কেন আর চালানো হচ্ছে না, সে ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সীমিত পরিসরে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালু করা হয়। ৩১ দশমিক ৬০ লাখ শিশুকে খাওয়ানোর পর গত বছরের ডিসেম্বরে এ কর্মসূচির সমাপ্তি টানা হয়।
সহকারী প্রকল্প পরিচালক হিসাবে প্রকল্পটি পরিচালনা করছিলেন একেএম রেজাউল করিম। বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত এই কর্মকর্তা বলেন, এই কর্মসূচি স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তির হার বাড়িয়েছে এবং ঝরে পড়ার হার কমিয়েছে।
রেজাউল জোর দিয়ে বলেন যে, মহামারির মধ্যে প্রকল্পটি চালিয়ে যাওয়া আগের চেয়েও বেশি দরকার ছিল।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতো কয়েকটি সংস্থা গবেষণার ফলাফল উল্লেখ করে বাংলাদেশে এ প্রকল্প চালানোকে সমর্থন দিয়েছিল। সংস্থাগুলো বলেছে যে, শিক্ষা-সংক্রান্ত সূচকগুলোর ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি। এছাড়াও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পুষ্টি অবস্থার উন্নতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই প্রকল্প।
দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য আশীর্বাদ ছিল স্কুল মিল
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন-এর (সিএএমপিই) নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, স্কুল ফিডিং প্রকল্পটি চর, হাওর ও পার্বত্য জেলার মতো সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলের শিশুদের জন্য আশীর্বাদ ছিল।
তিনি টিবিএসকে বলেন, সরকারের দুপুরের খাবার দেওয়ার প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অত্যন্ত দুঃখজনক। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ঠেকানোর, এবং ভর্তি ও উপস্থিতি বাড়ানোর ভালো উপায় ছিল এই কর্মসূচি। দুপুরের এই খাবার শিশুদের পুষ্টির বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, 'অনেক অভিভাবকই খাবারের জন্য বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতেন। অভুক্ত অনেক শিশু ছিল, তারাও বিস্কুটের জন্য স্কুলে আসত। আমরা মনে করি প্রকল্পটি স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেলে কোভিড-পরবর্তী সময়ে ঝরে পড়া এবং শিশুশ্রম বাড়বে।'
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ বলেন, 'করোনা মহামারির কারণে আয় কমে যাওয়ায় অনেক পরিবারই এখন আর্থিক সমস্যায় পড়ছে। অভিভাবকরা, বিশেষ করে চর ও উপকূলীয় এলাকার অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে বাইরে কাজ করতে পাঠাতে পারে।'
তিনি বলেন, শিশুশ্রম রোধ করার অন্যতম কৌশল হতে পারে স্কুলে খাবার দেওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান টিবিএসকে বলেন, অতি প্রয়োজনীয় এই প্রকল্পটি কেন বন্ধ করে দেওয়া হলো, সরকারের তা স্পষ্ট করা উচিত।
গুঁড়া দুধ থেকে খিচুড়ি
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার কিছু দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুলের শিশুদের গুঁড়া দুধ দেওয়া শুরু করে। ১৯৯৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুলের জন্য খাদ্য কর্মসূচি চালু করা হয়। এ কর্মসূচির আওতায় শিক্ষার্থীদের চাল, ডাল ও নগদ অর্থ দেওয়া হতো।
পরে ২০০০ সালের পর থেকে এসবের বদলে ভিটামিনসমৃদ্ধ বিস্কুট দেওয়া হতে থাকে।
২০০২ সালে যশোরে বন্যাকবলিত পরিবারগুলোর জন্য জরুরি সাহায্য হিসেবে বৃহৎ পরিসরে স্কুলে খাওয়ানো কর্মসূচি চালু করা হয়। ২০১০ সালে ডব্লিউএফপির সহায়তায় কর্মসূচিটি প্রোগ্রামটি জাতীয় পর্যায়ে শুরু হয়। ২০১৪ সাল পর্যন্ত চলে এ কর্মসূচি।
২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ একাধিকবার বাড়ানো হয়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ফিডিং কর্মসূচিতে ৪ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ১৯৯০ সাল থেকে প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থী স্কুল ফিডিং কর্মসূচি থেকে উপকৃত হয়েছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয় সূত্র।
১৪টি উপজেলায় শিশুরা রান্না করা খাবার পেত। বাকি সব এলাকায় তাদের ৭৫ গ্রাম ওজনের ভিটামিনসমৃদ্ধ বিস্কুট দেওয়া হতো।
হঠাৎ ধাক্কা
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০২১ সালের ১ জুন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার হিসেবে খিচুড়ি দেওয়ার ১৭ হাজার ২৯০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাতিল করে দেয়।
ওই সময় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী বাস্তবায়ন নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকায় প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়নি।'
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, প্রতিবেশী ভারত ও অন্যান্য দেশ যদি একই কাজ চমৎকারভাবে করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন স্কুল প্রাঙ্গণে খাবার রান্না করা নিয়ে সমস্যায় পড়বে, তা বোধগম্য নয়।
তিনি বলেন, প্রকল্প চালু না যাওয়ার ব্যাপারে সরকারের ব্যাখ্যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের একটি স্কুল মিল পলিসি দীর্ঘদিন ধরে কার্যকরভাবে চলে আসছিল। দেশে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা দেখছি না আমি।'
- প্রতিবেদনটি ইংরেজিতে পড়ুন: School meals taken away when they are needed most