লোকে কেন ম্যারাথনে দৌড়ায়?
১৮৯৬ সালে এথেন্স অলিম্পিকে প্রথম ম্যারাথন আয়োজিত হয়। সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন মাত্র ১৭ জন অ্যাথলেট।
এমনই গুটি গুটি পায়ে, প্রায় শূন্য থেকে শুরু হয়েছিল ম্যারাথনের পথচলা। কিন্তু তারপর থেকে গত ১২৫ বছরে এই ম্যারাথনই পাড়ি দিয়েছে অনেকটা পথ।
প্রথমবার আয়োজিত সেই ম্যারাথনে বিজয়ী অ্যাথলেট তার দৌড় শেষ করেছিলেন ২ ঘণ্টা ৫৮ মিনিট ৫০ সেকেন্ডে। কিন্তু আজকের দিনে নিতান্ত অ্যামেচার কারো পক্ষেও এই সময়ে হেসে-খেলে দৌড় শেষ করা সম্ভব। আর সবচেয়ে দ্রুতগতির রানাররা দৌড় শেষ করতে পারেন এর প্রায় এক ঘণ্টা কম সময়ে!
তাছাড়া সময়ই একমাত্র বিষয় নয়, যেখানে বদলের হাওয়া লেগেছে। বর্তমানে আমরা লম্বা দূরত্বের দৌড়ের পেছনের বিজ্ঞান সম্পর্কেও অনেক কিছুই জানি ও বুঝি। যেমন এ ধরনের দৌড় শরীরের উপর কেমন প্রভাব ফেলে, কিংবা এই দৌড়ের নেপথ্যে কী ধরনের মনস্তাত্ত্বিক উদ্দীপনা কাজ করে।
তবে, ম্যারাথনে দৌড়ানোর উপকারিতাগুলো আসলে কী কী? আর কেনই বা এ ধরনের দৌড় প্রতিযোগিতা বর্তমানে এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে?
অনেকেই হয়তো ভেবে অবাক হন, কোনো স্বর্ণপদক জয় কিংবা ক্রীড়া ইতিহাসের রেকর্ড বইয়ে নাম ওঠানোর ন্যূনতম সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও কেন শয়ে শয়ে মানুষ যোগ দেয় ছোট-বড় যেকোনো ম্যারাথনে।
এ তো আর পার্কে দৌড়ানো নয়। ছেলের হাতের মোয়াও নয়। ম্যারাথনে দৌড়ের জন্য শরীরকে উপযোগী করে তুলতে দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিতে হয়। বিনিয়োগ করতে হয় নিজের মূল্যবান সময় ও শক্তি। ঝরাতে হয় ঘাম, করতে হয় অমানুষিক পরিশ্রম।
এতকিছুর পরও, ১৯৮০ সালের পর থেকে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই ম্যারাথনে অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ২৫৫ শতাংশ। অন্যদিকে ১৯৮১ সালে ৭,৭৪৭ জন রানার নিয়ে যাত্রা শুরু করা লন্ডন ম্যারাথনেও প্রতি বছর অংশগ্রহণের জন্য আবেদনকারীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে। বর্তমানে সর্বসাকুল্যে ৫০,০০০টি 'আসন'-এর জন্য আবেদন করেন আড়াই লাখ রানার!
যদি সামগ্রিক চিত্রটা বুঝতে চান, সে ব্যবস্থাও রয়েছে। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী ম্যারাথন ফিনিশারের সংখ্যা ছিল ১২ লক্ষ ৯৮ হাজার ৭২৫!
ম্যারাথনে অংশগ্রহণের পেছনে মানুষের নানাবিধ কারণ তো রয়েছেই। তবে সবচেয়ে নিশ্চিত কারণটি হলো শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এ ধরনের দৌড়ের ইতিবাচক প্রভাব। কেউ কেউ হয়তো দুশ্চিন্তা করেন যে অপ্রস্তুত অবস্থায় ম্যারাথনে নামার ফলে শরীর অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। কিন্তু যদি কেউ যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে তারপর রাস্তায় নামেন, তাহলে নিঃসন্দেহে সম্ভাব্য ক্ষতির চেয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে থাকবে সম্ভাব্য লাভের তালিকা।
ওজন কমানো কিংবা হৃদপিণ্ড ও রক্ত সংবহন তন্ত্রকে সুস্থ রাখতে ম্যারাথন কতটা কার্যকরী, তা তো আর কারো জানতে বাকি নেই। এছাড়াও গবেষণায় প্রতিনিয়ত উঠে আসছে নিত্যনতুন আরো অনেক উপকারিতা।
ম্যারাথনে দৌড়ানোর ফলে নাকি পিছিয়ে যায় 'আর্টারি এজ'-এর আগমন। অর্থাৎ, যে বয়সের পর থেকে একজন মানুষের করোনারি হৃদরোগের আশঙ্কা সবচেয়ে সর্বাধিক হয়। এদিকে ইউনিভার্সিটি অব অগসবার্গে অ্যাস্ট্রিড রোয়েহর নেতৃত্বে এক নতুন গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, ম্যারাথনে দৌড়ানোর সঙ্গে নাকি মস্তিষ্ক ও দৃষ্টিশক্তির উন্নতিরও সম্পর্ক রয়েছে।
কিন্তু ম্যারাথনে দৌড়ানোর পেছনে মনস্তাত্ত্বিক উদ্দীপনাগুলো কী কী? এ ব্যাপারে একেকজন রানার আপনাকে একেকরকম জবাব দেবেন।
শুরুতেই জানা যাক ম্যাট হাফের বক্তব্য। তিনি বাস করেন নিউ ইয়র্কে। 'ম্যারাথনার: হোয়াট টু এক্সপেক্ট হোয়েন ট্রেইনিং ফর অ্যান্ড রানিং আ ম্যারাথন' নামের একটি বইও লিখে ফেলেছেন তিনি। তবে এই আলোচনায় তাকে টেনে আনার সবচেয়ে বড় প্রাসঙ্গিকতা হলো, গেল বছরেই তিনি বার্লিনে নিজের নবম ম্যারাথনটি সম্পন্ন করেছেন।
দুই অঙ্ক ছোঁয়ার আগে তিনি জানাচ্ছেন, ম্যারাথন রেসিংয়ের পেছনে তার প্যাশনটা নাকি এসেছে 'বিলম্বিত পরিতৃপ্তি'-র আকাঙ্ক্ষা থেকে। সহজ কথায়, অল্পতেই কোনো কাজে সন্তুষ্ট হতে চান না তিনি। বরং চান মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সাফল্য অর্জন করতে। আর তার এই চাওয়া পূরণে ম্যারাথনের যে জুড়ি মেলা ভার!
"ফিনিশ লাইন পেরোনোর পর লক্ষ্য অর্জন বা কার্যসিদ্ধির যে অনুভূতিটা আমি পাই, সেটির আশাতেই আমি বারবার ম্যারাথনে দৌড়াতে ফিরে আসি," বলছিলেন ম্যাট।
"ম্যারাথন দৌড়ে এমন একটা তাড়না রয়েছে, সেটি আপনি আর কোনো খেলাতেই পাবেন না। কেননা শুধু একটি ম্যারাথনের পেছনেই যে পরিমাণ সময় ও উদ্যম আপনাকে ব্যয় করতে হয়, তার সামনে খাটো হয়ে যায় যেকোনো ফুটবল বা টেনিস ম্যাচের পরিশ্রম। এখানে কেবল একটি প্রশ্নই রয়ে যায় যে ফিনিশ লাইনে পৌঁছানোর জন্য আপনি নিজেকে সর্বোচ্চ কষ্টের মুখেও ঠেলে দিতে পারবেন কি না।"
আবার এমন অনেক রানারও রয়েছেন, যাদের কাছে শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সম্ভাবনা হয়ে উঠেছে ম্যারাথনে দৌড়ানোর প্রধানতম অনুপ্রেরণা।
সেরকমই একজন টম এলার। জার্মানির এসেনে বসবাসরত এই মানুষটি জন্ম থেকেই বধির। অথচ এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাকে থামাতে পারেনি। ইতোমধ্যেই দৌড়ে ফেলেছেন ১১টি ম্যারাথনে। ২০১৯ সালের বার্লিন ম্যারাথনে তিনি দৌড় শেষ করেছেন ২ ঘণ্টা ৪৭ মিনিট ১১ সেকেন্ডে। এর মাধ্যমে বনে গেছেন জার্মানির দ্রুততম বধির ম্যারাথন রানার।
বধিক ও অন্ধ শিক্ষার্থীদের পাঠদানকারী টম জানান, "আমি নিজের জীবনকে চ্যালেঞ্জ করি। যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয় আমাকে। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে ম্যারাথনে দৌড়ানোর মাধ্যমে আমি মানুষকে দেখাই যে এমনকি প্রতিবন্ধকতার শিকার ব্যক্তিদের পক্ষেও অসাধারণ সব সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। স্কুলে আমার বধির শিশু-কিশোরদের জন্য আমি একজন রোল মডেল।"
কাইলি বেনেটের গল্পটা ব্যতিক্রমী। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির একজন ফ্যাকাল্টি অ্যাসিস্ট্যান্ট তিনি। ম্যারাথন তাকে সাহায্য করে মৃগীরোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।
"আমার জীবনে এমন বেশ কিছু সময় এসেছে যখন আমি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছি যে কোনো ধরনের শারীরিক কার্যক্রমই চালাতে পারিনি। তাই প্রত্যেকবার যখন আমি ফিনিশ লাইন পার হই, সাফল্য লাভের কৃতজ্ঞতায় ছেয়ে যায় আমার মন।"
তবে এই জাদুকরী অনুভূতি লাভের পাশাপাশি তিনি দৌড়ান আরো একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। সেটি হলো ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা অর্জন।
"এভাবেই আমি পৃথিবীটাকে এক্সপ্লোর করি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কোনো নতুন শহরকে অনুভবের সবচেয়ে ভালো সময়গুলোর একটি হলো সেই শহরের ম্যারাথন ডে।"
বিভিন্ন গবেষণা মতে, ম্যারাথন চলাকালীন গতি নিয়ন্ত্রণে পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি দক্ষ। সবসময় একটা ধারাবাহিক গতিও তারা ধরে রাখতে পারে অনায়াসে।
জেনস অ্যান্ডারসেন কোপেনহেগেন বিজনেস স্কুলের একজন পরিসংখ্যানবিদ তো বটেই, সেই সাথে নিজেও একজন রানার। তিনি ১৩১টি ম্যারাথনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সেগুলো বিশ্লেষণ করেন। এতে ধরা পড়ে, 'স্লো ডাউন'-এর সময়গুলোতে নারীদের তুলনায় অনেক বেশি গতি কমিয়ে ফেলে পুরুষরা। অর্থাৎ, দৌড়ানোর গতিতে সামঞ্জস্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় তারা।
তাছাড়া সাধারণ ম্যারাথনের দূরত্ব অতিক্রমে পুরুষদের রেস-টাইম তুলনামূলকভাবে দ্রুতগতির হলেও, আল্ট্রা-ম্যারাথনের মতো অনেক বেশি দূরত্ব অতিক্রমে নারীদের কিছু বাড়তি সুবিধা লাভের সম্ভাবনা রয়েছে। এর কারণ, তাদের শরীরে স্লো-টুইচ মাসল ফাইবারের বণ্টন হয় বেশি, ফলে লম্বা দৌড়ে তারা সহজে ক্লান্ত বা অবসাদ্গ্রস্ত হয়ে পড়বে না।
অবশ্য, প্রত্যেক রানারের ম্যারাথনে নাম লেখানোর পেছনে আলাদা আলাদা ব্যক্তিগত কারণ থাকলেও, গবেষকরা একটি সাধারণ মনস্তত্ত্ব চিহ্নিত করতে পেরেছেন।
পোল্যান্ডের জেরজি কুকুজকা অ্যাকাডেমি অব ফিজিক্যাল এডুকেশনের গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন, ম্যারাথন রেসে দৌড়ানোর সক্ষমতা প্রমাণ করতে পারাকে প্রায় সকলেই তাদের জীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে মনে করেন। আর তাই এই সক্ষমতা প্রমানের ফলাফল হয় সুদূরপ্রসারী। সফল রানাররা ম্যারাথন শেষ করে যে আত্মবিশ্বাস অর্জন করেন, সেটি তাদের ভবিষ্যতের যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ জয়ের পথ প্রশস্ত করে।
সুইডেনের লান্ড ইউনিভার্সিটির ক্যারিস এগান-ওয়াইজার তার গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, ম্যারাথন দৌড়ে ব্যক্তিজীবনের দৈনন্দিন নানা বিষয়েরই বাস্তবসম্মত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিফলন ঘটে। এর মাধ্যমে নিজের উন্নতির খতিয়ান যেমন রাখা যায়, তেমনই উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতার প্রয়োজনীয়তাও ফুটে ওঠে।
ক্যারিস বিভিন্ন রানারের সাক্ষাৎকার নিয়ে জানতে পেরেছেন, বেশিরভাগ রানারেরই তিনটি প্রাথমিক অনুপ্রেরণা থাকে : স্বাধীনতা, সাফল্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
তবে তিনি আরো একটি ব্যাপারও উদ্ঘাটন করেছেন যা বলতে গেলে অপ্রত্যাশিতই ছিল। দৌড়ের সহ্যক্ষমতা অর্জনকে অনেকে নাকি সামাজিক স্বীকৃতি লাভের উপায় বলেও মনে করে। বিষয়টা এমন যে আপনি যদি লম্বা দূরত্বে দৌড়ের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে পারেন, তাহলে এর মাধ্যমে অন্যদের সামনে আপনার সুস্বাস্থ্য, উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতাও প্রতীয়মান হবে। এতে করে আপনার একটি ইতিবাচক 'পারসোনাল ব্র্যান্ডিং' হবে, যা পরবর্তীতে চলার পথে নানাভাবে আপনাকে সাহায্য করবে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, আজকালকার বিভিন্ন সোশ্যাল ফিটনেস অ্যাপ্লিকেশন এসে এই গোটা বিষয়টিকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। এসব অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে নিজেদের সাফল্যগুলোকে সবার সামনে 'শো অফ' করা রানারদের এক প্রিয় নেশা হয়ে উঠেছে।
ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর জেনা গিলক্রিস্ট ও তার সহকর্মীরা গবেষণার মাধ্যমে শারীরিক প্রস্তুতি ও রেসের পেছনে আত্ম-গৌরবের ভূমিকাও খতিয়ে দেখেছেন। এবং অনুমিতভাবেই, যারা নিজেদের দৌড়ের ব্যাপারে বেশি গৌরব অনুভব করেছে, তারা প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি শ্রম ও সময়ও ব্যয় করেছে।
তবে কিছু প্রমাণ মিলেছে যে লিঙ্গভেদে অনুপ্রেরণাদায়ক বিষয়বস্তুর তারতম্য থাকতে পারে। যেমন পোল্যান্ডের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, নারী ম্যারাথন ফিনিশাররা ওজন কমানো, জীবনের অর্থ অনুসন্ধান, আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, মানসিকভাবে শক্তপোক্ত হওয়ার মতো ব্যাপারগুলোতে পুরুষদের চেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা-প্রতিযোগিতাকে তারা পুরুষদের চেয়ে কম গুরুত্ব দেয়।
যা-ই হোক, 'রানার'স হাই' বলেও কিন্তু একটি ব্যাপার আছে, যেটি সম্পর্কে না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। লম্বা দূরত্বে দৌড়ানোর ক্ষেত্রে প্রায় সময়ই এক বিশেষ ধরনের উদ্দীপনা হিসেবে উঠে আসে এই 'রানার'স হাই'-এর নাম। ম্যারাথন রানারদের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাপার এটি।
ম্যারাথন রানারদের মাথার মধ্যে আসলে কী চলে? তাদের মস্তিষ্কে কী ধরনের বিক্রিয়া চলে?
সাধারণত ভাবা হয়ে থাকে, এন্ডরফিন নামক একটি হরমোনের নাকি এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তবে অনেক মানুষই যে ম্যারাথনে দৌড়ানোর পর শান্ত-সৌম্য, আরামদায়ক অনুভূতির কথা জানায়, সেটির পেছনে সম্ভবত রক্তপ্রবাহে এন্ডোকানাবিনয়েডের পরিমাণ বৃদ্ধির অবদান রয়েছে। এন্ডরফিনের সঙ্গে এটির পার্থক্য হলো, এটি মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারে।
লম্বা দূরত্বের দৌড়ের ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক সম্ভবত যন্ত্রণার স্মৃতিকেও ধোঁকা দিতে পারে। ২০১৯ সালে পোল্যান্ডের জাগিয়েলোনিয়ান ইউনিভার্সিটির ডোমিনিকা ফারলি ও তার সহকর্মীরা সন্তান জন্মদানের যন্ত্রণার সঙ্গে ম্যারাথনে দৌড়ানোর কষ্টের তুলনার চেষ্টা করেন। সেখানে দেখা যায়, পরবর্তী সময়ে মনে করার ক্ষেত্রে উভয় যন্ত্রণাকেই বাস্তবের চেয়ে কম দুঃসহ বলে মনে হয়।
এর কারণ সম্ভবত এই যে, মস্তিষ্কে যে অক্সিটোসিনের নিঃসরণ ঘটে, সেটিই মস্তিষ্ক একটি ঘটনাকে কীভাবে মনে রাখবে তা নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া একটি যন্ত্রণায়ক অভিজ্ঞতাকে মনে রাখার ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপটও একটি বড় ভূমিকা পালন করে। যদি ম্যারাথনে দৌড়ানোর পর পদক পাওয়া যায়, কিংবা তীব্র প্রসব যন্ত্রণা সহ্যের পর সুস্থ-স্বাভাবিক শিশুর জন্ম দেওয়া যায়, তাহলে অতীতের কষ্টকে আর খুব বড় কোনো কষ্ট বলে মনে হয় না। তার মানে হলো, একটি কাজ চরম যন্ত্রণাদায়ক হওয়ার পরও যদি কাজ শেষে সেটির সুফল পাওয়া যায়, তাহলে সেই যন্ত্রণা অনেকাংশেই লাঘব হয়ে যায়।
সম্ভবত এ থেকেই 'রিপিট ম্যারাথনারস' বা বারবার ম্যারাথনে অংশগ্রহণকারীদের মনস্তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করা যাবে।
১৮ বার অংশ নেওয়া শিক্ষক এরিন ম্যাকব্রাইডের প্রথম ম্যারাথনটি ছিল ২০০৫ সালে। তখন তার বয়স সবে ১৮। তিনি ভেবেছিলেন, এই একবার ম্যারাথনে অংশ নিয়ে শখ পূরণ করেই থেমে যাবেন তিনি। কিন্তু না, তা হয়নি।
"২০০৫ সালের নভেম্বরের সেই দিনটি আমার জীবনকে চিরতরে বদলে দেয়," এরিন বলেন। "তখন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করি, প্রতি বছর অন্তত একটি ম্যারাথনে যোগ দেবোই। এবং বেশ কয়েক বছর আমার সঙ্গে আমার পরিবারের কোনো একজন সদস্যও ছিল।"
তবে ম্যারাথন পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে লিভারপুলের ৫৮ বছর বয়সী অ্যান্ডি গ্লেন যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তাকে হার মানানো আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব। ৪২টি দেশে মোট ১৭৬টি ম্যারাথন সম্পন্ন করেছেন তিনি। তার বর্তমান লক্ষ্য হলো ৫০টি দেশে ২০০টি ম্যারাথনে দৌড়ানো।
"আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করা হয়, এতবার ম্যারাথনে দৌড়ানোর ফলে কাজটি সহজ হয়ে যায় কি না। আমার সোজাসাপটা উত্তর হলো : না। শেষ ছয় মাইল ঠিক ততটাই চ্যালেঞ্জিং, যতটা আমার প্রথম ম্যারাথনের সময় মনে হয়েছিল।"
- (সূত্র: বিবিসি)