‘এতেই বাঁচি এতেই মরি’: জলবায়ু সংকট বাংলাদেশের সুন্দরবনকে হুমকির মুখে ফেলছে
খোলপেটুয়া নদীতীরের মসজিদ থেকে বের হয়ে চারপাশের চিরচেনা দৃশ্যই দেখছিলেন মোহাম্মদ সাবুদ আলী। আজীবন দেখে আসলেও এই বাদাবনের গুরুত্ব এখন তার কাছে অনেক বেশি, জীবনে আর কখনোই এতটা অনুধাবন করেননি।
বিশাল সুন্দরবন তার বুক আগলে যুগ যুগ ধরে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের প্রচণ্ডতা থেকে রক্ষা করে আসছে বাংলাদেশের উপকুলীয় সম্প্রদায়গুলোকে। বঙ্গোপসাগর থেকে সৃষ্ট এসব সাইক্লোন থেকে রক্ষায় প্রকৃতির রক্ষাকবচ- বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শ্বাসমূলীয় বনভূমি। স্থানীয় মানুষও জীবিকার দায়ে বনের সম্পদ আহরণের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমান জলবায়ু সংকটের যুগে এই নির্ভরতা দিনে দিনে আরো বেড়েই চলেছে।
সুন্দরবন জন্ম দিয়েছে অসংখ্য চর ও দ্বীপের। গাবুরা এমনই একটি জনপদ, যেখানে সাবুদ আলী বাস করেন। সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু দুর্যোগে গাবুরার অনেক মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। অভ্যন্তরীণ অভিবাসী মানুষের জনপদ হিসেবেও পরিচিতি পাচ্ছে গাবুরা।
সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার এ ইউনিয়ন জলবায়ু সংকটের জন্য দেশ-বিদেশের সংবাদ শিরোনামে উঠে আসছে। সুন্দরবনের ঠিক প্রবেশমুখেই দ্বীপটির অবস্থান। প্রতিবছরই কোনো না কোনো সাইক্লোনে ভাঙছে গাবুরার তীর ও বেড়িবাঁধ। লোনা পানির জলোচ্ছাসে ডুবে যাওয়ায় বন্ধ্যা হয়ে পড়েছে এককালের উর্বর কৃষিজমি।
যারা এখনো সেখানে রয়ে গেছেন, তাদের অধিকাংশই নৌকায় মাঝিমাল্লার কাজ করে, দিনমজুরি করে নাহয় সুন্দরবনের সম্পদ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদক কামিল আহমেদকে ৫০-এ পা রাখা সাবুদ আলী বলেন, "আমরা নদী আর বনের ওপর নির্ভর করি। মধু সংগ্রহ, মাছ ও কাঁকড়া ধরতে সবাই বনে যায়"।
সুন্দরবনের ভেতর এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে বহু নদী ও খাল। গাবুরা যেন সেই বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ। বিশাল খোলপেটুয়া নদীর বুকে দেখা যায় ছোট ছোট অনেক ডিঙি নৌকা। কয়েকদিন ধরে সুন্দরবনের নদী খালে মাছ ধরে তা নিয়ে গাবুরার ছোট্ট ঘাটে ফেরে জেলেরা। এই ঘাটগুলো হলো সুন্দরবন থেকে আহরিত সম্পদ স্থলভাগে প্রবেশের দুয়ার। দিনমজুরেরাও এই পথে চলাচল করে। গরু থেকে মোটরসাইকেল সবই পার হয় এ নদীপথ ধরে।
তার সঙ্গেই চোখে পড়ে সবশেষ ঘূর্ণিঝড়ের ধবংস চিহ্ন- ভেঙে যাওয়া নদীর দুই পাড়। সেখানে সাড় বেঁধে থাকা নৌকার সাড়ি। সুন্দরবনে ঢোকার আগে এখানেই নৌকা বেঁধে রাখে জেলে, বাওয়ালি ও মাওয়ালিরা। নৌকা মেরামতের কাজও চলে।
সাগরের পানে বাংলাদেশের উপকূলে সুন্দরবনে আছে গাবুরার মতো অসংখ্য জনপদ। বেশিরভাগ অধিবাসী বন-নির্ভর। স্থানীয়রা জানান, বনের ওপর তাদের নির্ভরতা দিন দিন বেড়েই চলেছে, এতে বনের ওপর ব্যবসা ও পর্যটনের অসহনীয় চাপ সৃষ্টি হতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের, যা নাজুক বাস্তুসংস্থানকে বিপন্ন করবে।
সরকার পক্ষ থেকে অবশ্য বনবিভাগের লাইসেন্স নিয়ে বনজীবীদের সুন্দরবনে যেতে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু, দারিদ্র্যপীড়িত ও অনন্যোপায় মানুষ সব সময় এই ব্যবস্থা মেনে চলতে আগ্রহী নয়।
সাবুদ আলী বলেন, "কখনো হয়তো একসাথে ১০০টি লাইসেন্স দেওয়া হয়, অথচ তখন হয়তো অন্তত ১০ হাজার মানুষের বনে যাওয়া জরুরী। প্রকৃতি রক্ষার নামে তারা আমাদের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলছে।"
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চল আগের চেয়েও দরিদ্র হয়েছে। সাইক্লোনের উৎপাতে বেড়েছে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন। মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে অথবা স্থায়ীভাবে অন্যত্র চলে যাচ্ছে সুন্দরবন উপকূলের মানুষ।
অ্যান্টি-স্লেভারি ইন্টারন্যাশনাল নামক দাসত্ব বিরোধী সংস্থা গত বছরে প্রকাশিত তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, দারিদ্র্যের এই চাপে আধুনিক শ্রমদাসত্ব তৈরির ঝুঁকি বেড়ে চলেছে বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলে।
অনেক সময় সুযোগসন্ধানী মানব পাচারকারী চক্র বিদেশ যেতে ইচ্ছুক স্থানীয় মানুষকে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে সর্বস্ব লুঠ করে। আবার দুবলার চরের মতো সুন্দরবনের ভেতর অবস্থিত মাছ প্রক্রিয়াকরণ (শুঁটকি তৈরি) এলাকায় কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও মানুষকে আকৃষ্ট করে। দুবলার চরে হয়তো সেকারণেই অনেক শিশু শ্রমিক দেখা যায়।
জার্মানির ড্রেসডেন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির গবেষক বিশ্বজিৎ মল্লিক এই সুন্দরবন উপকূলেই বড় হয়েছেন। তিনি জানান, নিজ জীবদ্দশাতেই তিনি বনের ওপর স্থানীয় মানুষের নির্ভরশীলতা বাড়তে দেখেছেন। কিন্তু, বাণিজ্যিক স্বার্থে তা বহুগুণ বেড়ে গেছে।
যেমন আগে একটি গ্রামের নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষই বনের সম্পদ আহরণ করতো। মাছ ধরতো নিজেদের ছোট্ট ডিঙি নৌকার ধারণ ক্ষমতা অনুসারে। কিন্তু, বাংলাদেশের সড়ক নেটওয়ার্কের জাল বিস্তৃত হওয়ায় বড় ব্যবসায়ীরাও ক্ষুধার্তের মতো এই অঞ্চলের সম্পদের দিকে নজর দিয়েছে।
স্মৃতিচারণ করে মল্লিক বলেন, "মনে পড়ে ৩০ বছর আগেও সুন্দরবন থেকে এত আহরণের নজির ছিল না। নির্দিষ্ট কয়েকটি গোষ্ঠী নিজেদের চাহিদা মেটাতে বন থেকে মাছ ও কাঁকড়া ধরতো, গোলপাতা কেটে আনতো। কিন্তু, এত বেশি মানুষ কখনো যেত না"।
"বনজীবী এসব মানুষকে অন্যরা আলাদা করেই চিনতেন। যেমন আমার মনে আছে গ্রামের একজন নির্দিষ্ট লোকই বনে মধু সংগ্রহে যেতেন, মধু কিনতে হলে আমার দাদু তাকেই ডাকতেন।"
তিনি ব্যাখ্যা করেন, "এই সম্পর্ক ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ, বংশক্রমে এই পেশায় আসা মানুষ জানতেন তাদের বনের সবকিছু আহরণের দরকার নেই। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অন্যরা এতে জড়িত হয়েছে। তাদের কাছে সুন্দরবন শুধু পর্যটন এলাকা আর ব্যবসার উৎস। বনের সাথে সহাবস্থানের এই সম্পর্ক তখন থেকেই ছিন্ন হতে থাকে। বড় মহাজন ও ব্যবসায়ীদের দাপটে ছোট জেলেদের টিকে থাকায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।"
এখন অনেক জেলেকেই মহাজনের থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়, আবার পানির দরেই বিক্রি করতে হয় কষ্টে ধরা মাছ।
এজন্য নিম্ন শিক্ষার হারও অনেকাংশে দায়ী। দারিদ্রের কষাঘাতে সকরুণ দশা এ অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থার। গেল বছর একটি জরিপ ফলাফল প্রকাশ করেন মল্লিক। এতে অংশ নেয় সুন্দরবন এলাকার এক হাজার পরিবার। সেখানে উঠে এসেছে যে, শিক্ষাবঞ্চিত বা স্বল্পশিক্ষিত তরুণসহ প্রায় পুরো গ্রামের মানুষই এখন জীবিকার জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল।
জরিপ গবেষণার ফলাফলে মতপ্রকাশ করা হয় যে, বন-নির্ভরতা কমিয়ে জীবিকা উপার্জন বহুমুখী করার মাধ্যমেই কেবল টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করা সম্ভব। এতে স্থানীয় সমাজের দারিদ্র্য সহনশীলতা বাড়বে, আর একইসাথে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে অবৈধ অনুপ্রবেশ।
মল্লিক বলেন, "আমরা দেখি সুন্দরবনে এখনও অনেক গাছ ও সম্পদ উৎপন্ন হচ্ছে, কিন্তু বনের একদম কেন্দ্রে গেলে আপনি অনেক ফাঁকা জায়গা দেখতে পাবেন।"
"প্রকৃতির সহ্যসীমা যখন ছাড়িয়ে যাবে, যখন মানুষ (বন থেকে) খালি হাতে ফিরতে থাকবে, তখন এনিয়ে বড় আলোড়ন সৃষ্টি হবে। কিন্তু, ততোদিনে সাইক্লোনের রক্ষাকবচ সুন্দরবনও হারাবে চিরতরে।"
সুন্দরবনে আজো রয়েছে জলদস্যুর উৎপাত, মানুষখেকো বাঘের ভয় আর ডাকাতের উপদ্রুপ। তবু দরিদ্র মানুষকে ভাত-কাপড়ের সন্ধানে বনে নামতেই হয়। সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে মানুষের পদচারণা, বাঘে-মানুষে সংঘাতের ঘটনা।
৬১ বছরের অবসারপ্রাপ্ত শিক্ষক আবদুল হাকিম বলেন, "বনকে আমরা ভয়ও পাই। চিংড়ি ধরতে গিয়ে আমার বড় ভাই বাঘের হাতে প্রাণ হারায়। তখন থেকে আমার মনেও ভীষণ বাঘের ভয় জন্মেছে।"
কিন্তু, ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার পরিবার বনের ওপর আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
হাকিমের ভাষায়, "সব কিছুর জন্যেই আমাদের বনে যেতে হয়। নগদ টাকার বড় অভাব এখানে। তাই জ্বালানি কাঠ, মধু বা কাঁকড়া যা কিছু প্রয়োজন বন থেকে সংগ্রহ করে, সেগুলো বিক্রি বা ব্যবহার করি। আমরা পুরোপুরি সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল, এই বনেই বাঁচি আর মরি।"
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান