বাংলাদেশের স্বাধীনতা আমাদের বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথকে ত্বরান্বিত করেছে : আমিরুল হক
শনিবার সকাল ৫ টায় ঘুম থেকে ওঠেই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন মোহাম্মদ আমিরুল হক, যেখানে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেড়ে উঠেছেন।
"যখন আমি আমার কারখানা পরিদর্শন করি, মনে হয় আমি আমার বাগান পরিদর্শন করছি,"- বলেন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আমিরুল।
আমিরুল হক সপ্তাহের তিনদিন ঢাকায় থাকেন। সোমবার সন্ধ্যায় তিনি তাঁর চট্টগ্রাম অফিসের উদ্দেশ্যে ফিরে যান। শুক্রবারটা তিনি পরিবারের সাথে কাটান, এছাড়া অবসরে হাঁটতে বা সাঁতার কাটতে যান। তবে এর বাইরের অধিকাংশ সময় তিনি নিজের ব্যবসায়িক বিষয়গুলি দেখভালে ব্যস্ত সময় পার করেন।
করোনা মহামারি শুরুর পর আমিরুল হকের কোম্পানিকে ৫০ শতাংশ উৎপাদন কমাতে হয়েছিল, কিন্তু তিনি তার কর্মচারীদের মাসিক ১২ কোটি টাকার বেতন নিয়ে আপস করেননি।
দৃষ্টান্তমূলকভাবে উচ্চ বেতন দিয়েই তিনি প্রিমিয়ার সিমেন্ট, ডেল্টা শিপইয়ার্ড, রূপসা পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনারি, সিকম গ্রুপ, ডেল্টা এলপিজি এবং ডেল্টা এগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের মতো অন্তত অর্ধ-ডজন বিখ্যাত ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন।
আমিরুক হক এছাড়াও শিপিং, স্টিভডোরিং এবং লজিস্টিকস, উপকূলীয় জাহাজ পরিবহন এবং ট্যাঙ্ক টার্মিনালের ব্যবসায় জড়িত। উপরন্তু, তিনি ভোজ্য তেল শোধনাগার, এলপিজি টার্মিনাল, কৃষি ও উদ্যানপালন, ব্যাগ তৈরি, চিংড়ি হ্যাচারি এবং সর্বশেষ রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সঙ্গেও জড়িয়েছেন।
বর্তমানে, আমিরুল হকের ৩০ টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ৬ হাজার মানুষ সরাসরি কর্মরত। এছাড়া সেকেন্ড পার্টি কন্ট্রাক্টরদের অধীনে চুক্তিভিত্তিকভাবে কর্মরত আছেন আরও ৯ হাজার জন।
তাঁর কাছে ৩ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ২০০ ডেডওয়েট টনেজ (ডিডব্লিউটি) ধারণ ক্ষমতার ৬০টি লাইটার জাহাজ রয়েছে। গত ৩৬ বছরে, আমিরুল হকের ব্যবসা প্রসারের সাথে সাথে তাঁর ব্যবসায় ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ বেড়েছে, এখন যার পরিমাণ ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। সম্ভবত এখন বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু হক প্রায় কিছু ছাড়াই এই যাত্রা শুরু করেছিলেন।
একটি নীরব যাত্রা, কোভিড-১৯ এবং দেশপ্রেম :
১৯৮৫ সালের মার্চ মাসে আমিরুল হক মাত্র একজন অফিস সহকারী সঙ্গে নিয়ে ৬০০ বর্গফুটের একটি অফিস ভাড়া নেন। মধ্যস্থতাকারী হিসাবে স্ক্র্যাপ ভেসেল বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। বাবার আইন পেশায় না গিয়ে তিনি ব্যবসায়ী হওয়ার পথ ধরেন।
আমিরুল হক চট্টগ্রামের সরকারি কমার্স কলেজের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক এবং তারপর যুক্তরাজ্য থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
তাছাড়া, আমিরুল হক যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব পেট্রোলিয়ামের একজন ফেলো । পড়ালেখা শেষে তিনি প্রায় খালি হাতে দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন, যিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসার শুরুতে আমিরুল সাফল্যে হাতছানি পান। ভাগ্য যেন তাঁর সঙ্গী হয়। স্ক্র্যাপ ভেসেল বিক্রি করে আয় করেন ৩ লাখ ২৮ হাজার ৯৩ টাকা। দূরদর্শী এই উদ্যোক্তা, ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
আমিরুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমি আমার নিজের ব্যবসা শুরু করতে চেয়েছিলাম, প্রাথমিকভাবে আমার লক্ষ্য ছিল ব্যবসার মাধ্যমে দেশের মানুষের দারিদ্র্য দূর করা।"
১৯৮৪ সালে দেশে প্রথম প্রাইভেট ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মূলত অর্থনীতিতে উন্নতি শুরু হয়, তা উল্লেখ করে বলেন, "আমাদের কাছে সুযোগ আসতে শুরু করে। ১৯৮৫ সালের মার্চ মাসে, আমি আমার পরিধির মধ্যে স্ক্র্যাপ বিক্রি শুরু করি।"
হক সেই সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, এর আগে সবকিছু জাতীয়করণ করা হয়েছিল এবং বাজারে মাত্র কয়েকজন উদ্যোক্তা ছিল। স্ক্র্যাপ ভেসেল বিক্রি করে ৩ লাখ টাকা আয় ছিল তাঁর প্রথম আয়, যদিও তিনি ৬০০ বর্গফুটের অফিসে অল্প টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
হক বলেন, "আজ আমার অফিস ৬০,০০০ বর্গফুট।"
অর্ধ-ডজন বিখ্যাত ব্র্যান্ডের মালিক আমিরুল হক, ব্যবসায়ী হতে অনুপ্রাণিত করার জন্য তাঁর বাবাকে কৃতিত্ব দেন।
হক বলেন, "আমি যদি ব্যবসায়ী না হতাম, তাহলে শিক্ষক হতাম।"
হকের প্রধান ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলির মধ্যে একটি হল- প্রিমিয়ার সিমেন্ট, যা ২০০১ সালে শুরু হয়েছিল।
"১৯৯৯ সাল নাগাদ এটি স্পষ্ট ছিল যে, শাসনব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে এবং উন্নয়ন শুরু হয়েছে। তা সত্ত্বেও, কেউ আশা করেনি যে এদেশে ৩৫ মিলিয়ন টন সিমেন্ট ব্যবহার হবে, যা আজ ব্যবহার হচ্ছে। আমার স্বপ্ন ছিল, দেশের উন্নয়নের জন্য সিমেন্টের প্রয়োজন হবে। আমার সেই স্বপ্ন এখনও আছে,"- বলেন হক।
প্রাথমিকভাবে প্রিমিয়ার সিমেন্ট দৈনিক ৬,০০০ টন উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছিল, তবে যাত্রা শুরু করেছিল ২,০০০ টন দিয়ে। অবশ্য দুই-তিন বছরের মধ্যেই দৈনিক অতিরিক্ত দুই হাজার টন উৎপাদন হতে থাকে।
হক বলেন, "আমরা এখন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ২৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন।"
"আমাদের সিমেন্ট কারখানায় সরাসরি আড়াই হাজার জন কাজ করে। সিমেন্ট কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভার প্রায় অর্ধ-বিলিয়ন।"- যোগ করেন হক।
কৌশলী এই ব্যবসায়ী অবশ্য মহামারির প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন না। অন্য সবার মতো- তিনিও এর অসুবিধার মুখোমুখি হন।
তিনি বলেছেন, "বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হওয়ার কারণে আমরা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। আমাদের উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমাতে হয়েছিল। যেহেতু মহামারির লকডাউনের সময় সরকারি প্রকল্পগুলি চলমান ছিল, তাই এসব প্রকল্পের জন্য আমাদেরকে উৎপাদন চালিয়ে যেতে হয়েছে।"
"সঙ্কটকালীন সময়ে আমাদের ঢাকার কারখানায় ২,৫০০ কর্মী রেখেছিলাম এবং নিজস্ব উৎস থেকে তাদের খাবার সরবরাহসহ সব উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সংকটের সময় আমাদের কারখানায় কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। কোন বেতন কাটা হয়নি; আমরা তা নিয়ে চিন্তাও করিনি। কর্মীদের মানসিক শক্তি ও উদ্যম বজায় রাখার জন্য, বেতন এবং বোনাস সময়মতো দেওয়া হয়েছিল।"
আমিরুল হকের কারখানার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল- রঙ। যার পুরোটাই লাল এবং সবুজ রঙে সাঁজানো।
হক বলেন, "এই রঙ জাতীয় পতাকার প্রতিনিধিত্ব করে, কারণ আমি বিশ্বাস করি- দেশের জন্মের ফলে শিল্পের জন্ম হয়েছে। স্বাধীনতা আমাদেরকে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত করতে সাহায্য করেছে।"
কিশোর বয়সে মুক্তিযুদ্ধ দেখা আমিরুল হক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন স্বাধীনতা আমাদের অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটিয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে আসছে নতুন প্রকল্প:
আগামী মাসের শেষ দিকে ডেল্টা এগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি বৃহৎ এগ্রো কম্পোজিট শিল্পের উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছেন আমিরুল হক। নারায়ণগঞ্জে ৪৫ একর জমিতে ১,২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এটি নির্মিত হচ্ছে।
হক জানান, করোনা মহামারির মধ্যেই তাঁর এই কোম্পানিতে ১,২০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটিতে এক হাজার মেট্রিক টন পাম তেল, এক হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন তেল উৎপাদনসহ ময়দা মিল এবং বীজ ক্রাশিং জড়িত। দেশের অন্যতম বৃহত্তম সয়া-বীজ পেষাই কারখানা হতে যাচ্ছে এই প্রকল্প।
হক বলেন, "বিদ্যুৎ ও গ্যাসের জন্য আমাদের দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর আমরা ইউটিলিটি লাইন পেয়েছিলাম। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সরকারকে অবশ্যই আমাদের সাহায্য করতে হবে।"
২০১৮ সালের শেষের দিকে কারখানাটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মহামারির সময়েও এটি বন্ধ হয়নি। কিন্তু ইউটিলিটি লাইনের কারণে মারাত্মক বিলম্ব হয়েছে।
হক বলেন, "এখন আমরা উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছি।"
বাংলাদেশ প্রতি বছর বীজ এবং ভোজ্যতেল আমদানি করতে প্রায় ২০০ কোটি ডলার খরচ করে। তেলের চাহিদা মেটাতে অভ্যন্তরীণ তেলবীজ এবং ভোজ্য তেলের উৎপাদন ন্যূনতম।
ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের (এমজিআই) গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশ, মাথাপিছু তেলের ব্যবহার বার্ষিক ৯ দশমিক ৯ কেজি, বিশ্বব্যাপী যা গড়ে ২৫ দশমিক ২ কেজির বেশি।
ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মাথাপিছু গমের ব্যবহার বিশ্ব গড়ের অর্ধেকেরও কম । ২০২০-২১ এর পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৬ কেজি।
হক বলেন, "গম এবং সয়াবীজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা কারখানাগুলি স্থানীয় কৃষি-ভিত্তিক খাতকে উৎসাহিত করতে সহায়তা করবে। আমরা এমন বীজ বিদেশ থেকে আমদানিও করব।"
চট্টগ্রামে ব্যবসা:
টিবিএস আমিরুল হককে জিজ্ঞেস করেছিল অর্থনৈতিক গেটওয়ে হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরকে কিভাবে মুল্যায়ন করেন?
হক বলেন, "যদি চট্টগ্রাম বন্দরে বেসরকারি খাত সঠিকভাবে কাজ করতে পারে, তাহলে পরিষেবাগুলি ত্বরান্বিত হবে। তাই বলে আমি বন্দর বিক্রি করে দিতে বলছি না।"
"বন্দরে এমন কাউকে নিয়োগ দিতে হবে যিনি আধুনিক যন্ত্রপাতি পরিচালনা করবে। বিশ্বের কোনো বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেরাই যন্ত্রপাতি পরিচালনা করে না"- যোগ করেন আমিরুল হক।
হক বলেন, "তিনিই দেশের প্রথম বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা যিনি ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে বেসরকারি খাতের যন্ত্রপাতি চালু করেন।"
"চট্টগ্রাম বন্দরকে বেসরকারিকরণ করতে না চাওয়ায় বন্দর শ্রমিকদের বিরোধিতার কারণে আমার যন্ত্রপাতি ১৬ মাস আটকে ছিল," হক স্মরণ করিয়ে দেন।
এই ব্যবসায়ীর মতে, ২০০৭ সালে বার্থ অপারেটর ধারণাটি চট্টগ্রাম চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (সিসিসিআই) এবং ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পক্ষে তিনিই প্রবর্তন করেছিলেন।
আমিরুল হক বলেন, "আমি সাত বছর চেম্বারে সেবাদানের সুযোগ পেয়েছি। চট্টগ্রাম বন্দরে যদি বেসরকারি খাতকে আরও বেশি যুক্ত হয়, তাহলে তারা আরও ভালো সেবা দিতে পারত।"
বর্তমান পরিস্থিতি কি বিনিয়োগবান্ধব?- এমন প্রশ্নের জবাবে হক বলেন, "বাংলাদেশ সব সময়ই বিনিয়োগবান্ধব, কিন্তু এফডিআই-এর মতো বিদেশি বিনিয়োগের জন্য চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।"
হক আরও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত করতে ১০ লেনের পরিবেশবান্ধব মহাসড়ক প্রয়োজন। এমনকি ছয় লেন হলেও ঠিক আছে। যাতে মানুষ দুই ঘন্টার মধ্যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাতায়াত করতে পারে। হক বললেন, "কিন্তু আমাদের চার লেন কেন?"
"চট্টগ্রাম বন্দর এখনও নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের কাজ শেষ করতে পারেনি, যে কাজ ২০০৭-০৮ সালে শুরু হয়েছিলো। আমাদের মন্ত্রী বলছেন, তারা ২০২৪ সালে বে টার্মিনালটি চালু করবেন। আমি মনে করি এটা সম্ভব নয়।"
তিনি বলেন, "আপনি যদি অর্থনৈতির কথা চিন্তা করেন; আপনাকে মোংলা বা পায়রা বন্দর উন্নয়ন করতে হবে। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ নিরাপদ করতে হলে আমাদের শিগগিরই বন্দর উন্নয়ন করতে হবে।"