নতুন রূপে আসছে ১৭ বছরের পুরোনো ‘দেশাল’
প্রায় ১৭ বছর আগে দেশের পোশাক শিল্পের বাজারে প্রবেশ করেছিল 'দেশাল', সাথে ছিল একগুচ্ছ ভিন্নধর্মী আইডিয়া। তাঁত বা হ্যান্ডলুমের সুতি শাড়ি, কুর্তিতে হাতে আঁকা মুখাবয়ব, পোশাকের নকশায় কাঠের বিডস-পুঁতি ব্যবহার এবং দেশীয় উপকরণ দিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে পোশাক শিল্পে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছিল দেশাল।
সে পথ চলার হাত ধরে রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে দেশালের ছোট্ট শোরুমটি হয়ে ওঠে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণ-তরুণীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। কারণ তখন দেশাল মানেই ছিল- কম দামে ভালো পণ্য। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই ব্র্যান্ড।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর ২০০৫ সালে সবুজ সিদ্দিকীর সাথে 'দেশাল' প্রতিষ্ঠা করেন কনক আদিত্য-ইশরাত জাহান জুটি।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশালের প্রধান লক্ষ্য ছিল- দেশীয় উপকরণের সাথে সমসাময়িক আধুনিকতার মিশেলে পণ্য তৈরি। নারী, পুরুষ ও শিশুদের পোশাক ছাড়াও দেশালে রয়েছে গৃহসজ্জা সামগ্রী ও লাইফস্টাইল সম্পর্কিত নানান পণ্য।
'দেশাল' নামের অর্থ দেশীয় বা নিজ দেশের কোনো বস্তু। বলাই বাহুল্য, ব্র্যান্ডটি বরাবরই তাদের নামের সাথে কাজের মিল বজায় রেখেছে। কারণ দেশালের সব পোশাকই তৈরি হয় বাংলাদেশে সহজলভ্য তন্তু দিয়ে এবং কাপড়গুলো বোঁনেন দেশীয় তাঁতিরা; অন্তত ২০১৫ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলছিল দেশালের যাত্রা।
কিন্তু এরপর বাধ্য হয়ে মেশিনে তৈরি সুতার কাপড়ও নিজেদের সংগ্রহে রাখতে শুরু করে তারা।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে দেশের ঐতিহ্যবাহী এই ব্র্যান্ড। এমনকি প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে টিকে থাকার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে তাদের। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় আর দশটা ব্র্যান্ডের মতো দেশালের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে পড়ে। সেসময় দেশালের মালিকানা স্বত্ব বিক্রি করার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেন কনক ও ইশরাত।
দেশালের ব্যর্থতার কারণ উল্লেখ করে বলেন কনক আদিত্য বলেন, "যেকোনো ব্যবসায়ের মূল বৈশিষ্ট্য হলো, ব্যবসাকে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে দিতে হবে। আমি এবং ইশরাত, দুজনেই শিল্পী। আমাদের অবশ্যই সেই শিল্পে সময় দিতে হয়। কিন্তু ব্যবসায়ও তো মনোযোগ ও সময় দেওয়া চাই!"
কিন্তু দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি গোষ্ঠী যখন জানতে পারলো দেশাল বিক্রি হওয়ার পথে, তখন তারা বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসে মালিকপক্ষের কাছে।
বিনিয়োগকারীরা বুঝেছিলেন, কনক এবং ইশরাত তাদের ব্র্যান্ডের অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে চান। তবে তাদের দুজনের ব্যবসায়িক দক্ষতার অভাব রয়েছে। এজন্য তারা প্রস্তাব রাখেন, দেশালের ক্রিয়েটিভ কন্ট্রোল ইশরাত-কনকের হাতেই থাকবে। অন্যদিকে ব্র্যান্ডের কার্যক্রম চাঙা করে তুলতে প্রয়োজ়নমাফিক ব্যবসায়িক পরামর্শ ও পুঁজি দিয়ে যাবে অংশীদার গোষ্ঠী।
২০২১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের ব্র্যান্ড অংশীদারের নাম ঘোষণা করে দেশাল। বনানীর এইচ ব্লকের ১২ নম্বর রোডের ২৭ নম্বর বাড়িতে গত ১ ফেব্রুয়ারি নতুন অবতারে হাজির হয়েছে দেশাল।
"এখন আমাদের অংশীদার থাকায় দায়দায়িত্বের বোঝা অনেকখানি হালকা হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, এবার দেশাল আরও একবার জেগে উঠবে"- বলেন কনক।
দেশালের উত্থান-পতন ও পুনর্জন্ম:
দেশাল যে কনক আদিত্য ও ইশরাত জাহানের মস্তিষ্কপ্রসূত আইডিয়া, সে সম্পর্কে পাঠক ইতোমধ্যেই অবগত।
এর আগে একটি অনলাইন প্রকাশনাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কনক-ইশরাত জানিয়েছিলেন, দেয়ালে ঝোলানো ও ফ্রেমে বাঁধাই করা ভাবলেশহীন মূর্তির বদলে তারা মানুষকেই জীবন্ত ক্যানভাসে রূপ দিতে চান। তাই কাপড়ই হয়ে ওঠে তাদের ক্যানভাস।
কোনোরকম ব্যবসায়িক প্রশিক্ষণ ছাড়াই দেশালের যাত্রা শুরু করেছিলেন কনক ও ইশরাত। কিন্তু তারা বুঝতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চারুকলায় শিখে আসা বিদ্যা একটা ব্যবসা দাঁড় করানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়।
ইশরাত-কনক দম্পতি যে শুধুই ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন তা নয়, বরং দেশের শিল্প ও ফ্যাশনের মধ্যে জোরাল সম্পর্ক তৈরিতেও ভূমিকা রেখেছেন।
দেশালের একটি প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় তাঁতি-শিল্পীদের কল্যাণে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং তাদেরকে অনুপ্রাণিত করা।
দেশালের স্পন্সরশিপের মাধ্যমে বাংলাদেশের তাঁতশিল্প গ্রামগুলো নিয়ে তিন বছর গবেষণা করেছেন চারুকলার আরেক শিক্ষার্থী শাওন আকন্দ। গবেষণা শেষে ২০১৮ সালে 'বাংলাদেশের তাঁত শিল্প' নামে একটি বই প্রকাশ করেন তিনি।
২০০৯ সালে দেশি দশের সাথে যুক্ত হয় দেশাল। অঞ্জন'স, বিবিয়ানা, প্রবর্তনা, নগরদোলা, সাদাকালো, কে ক্রাফট, নিপুণ, বাংলার মেলা ও রঙ এর মতো দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো নিয়ে তৈরি হয় 'দেশি দশ'। দেশি দশের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশজ শিল্পকে তুলে ধরা এবং এর প্রসারে কাজ করা।
কনক জানান, ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের হস্তশিল্প খাত ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। বর্ষাকাল দেরিতে আসা এবং স্থানীয় অর্থনীতির দোদ্যুলমান অবস্থা এর পেছনে দায়ী। এমনকি ২০১৮ সালের দিকেও দেশাল তাদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছিল।
দেশালের বিজনেস অফিসার ও বর্তমান পরিচালক তাশাফি খান বলেন, "কোভিড-১৯ মহামারির পর আমাদের ব্র্যান্ডের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে পড়ে। তখনই কনক ও ইশরাত এটা বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।"
তবে নতুন বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখানোর পর পরিস্থিতি বদলে যায়। ব্র্যান্ডটি কিনে নেওয়ার বদলে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বিনিয়োগকারীরা দেশালের অংশীদার হতে চায়। এর তিন মাসের মধ্যেই দেশাল এবং তাদের নতুন বিনিয়োগকারীরা আনুষ্ঠানিক অংশীদার হন।
তাশাফি খান জানান, চুক্তি অনুসারে ৬০ শতাংশ শেয়ারের মালিক হবে নতুন বিনিয়োগকারীরা এবং বাকি ৪০ শতাংশ থাকবে কনক-ইশরাতের হাতে।
এই মুহূর্তে বিনিয়োগকারীরা দেশালের ব্যবসায়িক লাভক্ষতির দিকটি দেখছেন এবং কনক-ইশরাত ব্যস্ত আছেন এর সৃজনশীল (ক্রিয়েটিভ) দিকটি নিয়ে। ইশরাতই দেশালের প্রধান নকশাকার এবং ১২ জনের একটি দলের নেতা। অন্যদিকে ডিজাইন প্রোডাকশনের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছেন কনক।
নতুন রূপে দেশাল:
তাশাফি খান বলেন, "দেশাল সারা বাংলাদেশে দুই শতাধিক শিল্পী-তাঁতিদের নিয়ে কাজ করছে। সেই দিকটি বিবেচনায় রেখেই আমরা এখন ফাস্ট ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়ে পণ্যসম্ভার সাজাচ্ছি। কিন্তু আমাদের মূলমন্ত্র হলো আরামদায়ক, টেকসই ও সুলভ মূল্যের পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়া।"
আরও জানালেন, এই মুহূর্তে নতুন টেক্সটাইল প্রযুক্তি, আরএমজি-মেইড ফেব্রিক, নতুন প্রিন্টিং প্যাটার্ন ও পদ্ধতির সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে নিজেদের কাজের ধরন উন্নত করছে দেশাল। এছাড়া বয়স-অনুসারে অভিষ্ট ভোক্তাগোষ্ঠীর পরিধিও বাড়াচ্ছেন তারা।
"আগে আমাদের টার্গেট গ্রুপ ছিল তরুণ-তরুণী, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী এবং মধ্যবিত্তরা। কিন্তু এখন বাজারেও পরিবর্তন আসছে; তাই আমরা আরও বড় পরিসরে ভোক্তাদের জন্য কাজ করবো। যেমন এবারই প্রথমবারের মতো দেশাল জেনারেশন জেড-কে (১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত যারা জন্মগ্রহণ করেছে) টার্গেট করে নিটওয়্যার পণ্য নিয়ে আসছে। সামর্থ্যবানদের জন্য আমরা সিল্ক, বেনারসি, জামদানির মতো প্রিমিয়াম ম্যাটেরিয়াল এবং অন্যান্য উচ্চ মানের পণ্য নিয়ে আসব।"
বর্তমানে দেশজুড়ে দেশালের ৭টি আউটলেট রয়েছে, যার মধ্যে একটির উদ্বোধন হয়েছে গতকাল। তাছাড়া ঢাকার মোহাম্মদপুর এবং বগুড়ায় আরও দুটি আউটলেট চালুর কথা ভাবছে তারা। ২০২৩ সালের শেষার্ধের মধ্যেই দেশজুড়ে আরও ২০টি আউটলেট চালু করতে চায় দেশাল।
তাশাফি খান বলেন, "সরাসরি আউটলেটের পাশাপাশি আমাদের ই-কমার্স এবং অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং কার্যক্রম চালু থাকবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমরা ধীরে ধীরে সারা দেশে রিটেইল ফুটপ্রিন্টের প্রসার ঘটাতে চাচ্ছি।"
নতুন এই বিজনেস মডেলে দেশাল কি 'দেশি দশে'র সাথে যুক্ত থাকবে কিনা এমন প্রশ্নে কনক আদিত্য বলেন, "অবশ্যই থাকবে। আরও ১০টি দেশীয় ব্র্যান্ডের সাথে থাকা মানেই তো নিজের হাত শক্তিশালী করা। এই সুযোগ আমরা ছাড়ব কেন!"
আসন্ন পহেলা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস ও ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে নতুন নতুন ডিজাইনের হরেক রকম পণ্য নিয়ে আসার জন্য কাজ করে চলেছে দেশাল।