ট্রাক চাপায় রাবি শিক্ষার্থীর মৃত্যু সজীব হিমেলের ধূসর বিদায়!
মঙ্গলবার রাতে ট্রাকের ধাক্কায় নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব হিমেল। এভাবে তার করুণ বিদায় মানতে পারছেন না কেউই। প্রিয়জন ও বন্ধুরা যেন শোকের ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। বুধবার (২ ফেব্রুয়ারি) সকালে হিমেলের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে ক্যাম্পাসে আনা হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সহপাঠীরা। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ বিধবা মা মনিরা আক্তার।
এদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ক্যাম্পাসের কেন্দ্রীয় মসজিদে হিমেলের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। হিমেলকে বিদায় দিতে জানাজায় সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। এর আগে তার মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণ ও পরে শহীদমিনার মুক্তমঞ্চে আনা হয়। সেখানে বিভিন্ন সংগঠন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে।
হিমেল চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের দপ্তর সম্পাদক। কয়েক বছর আগে তার বাবা মারা গেলে তিনি মায়ের সঙ্গে নানার বাড়ি নাটোরের কাপড়পট্টি এলাকায় থাকা শুরু করেন। জানাজা শেষে তার লাশ নাটোরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং গাড়িখানা গোরস্থানে দাফনকার্য সম্পন্ন হয়।
অভিযুক্ত ট্রাকচালক ও হেলপার গ্রেপ্তার, মামলা দায়ের:
মাহমুদ হাবিব হিমেলকে চাপা দেওয়া ট্রাকের চালক মো. টিটু (৪২) ও হেলপার হামিম হোসেন ওরফে কালুকে (২০) আটক করেছে পুলিশ। বুধবার দুপুর ১টার দিকে রাজশাহী নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। তারা দু'জনই ওই এলাকার বাসিন্দা। এরপর দুপুরে রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি জানান।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আরিফুর রহমান বাদী হয়ে নগরীর মতিহার থানায় মামলা করেছেন। সেই মামলায় আটককৃতদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
হিমেলের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর:
হিমেলের মরদেহ দাফন শেষে তার পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, 'হিমেলের পরিবারের কাছে পাঁচ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরা নাটোরে তার নানার বাড়িতে গিয়ে চেক দিয়েছি। ভুক্তভোগী পরিবারটিকে ধাপে ধাপে আরও সহযোগিতা করা হবে। হিমেলের মায়ের আজীবন চিকিৎসা খরচ বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে।'
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সবক'টি দাবিই পূরণ করা হবে: উপাচার্য
মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় হিমেল নিহতের ঘটনায় ক্ষতিপূরণসহ শিক্ষার্থীদের ছয়টি দাবির সবকটির সাথে সহমত জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার। হিমেলের জানাজায় উপাচার্য এ ঘোষণা দেন।
উপাচার্য আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, সন্তানহারা পিতার জন্য এই মুহূর্তে কিছু বলা সত্যিই কঠিন। পিতার পিঠে সন্তানের লাশের বোঝা যে কতটা ভারি। কথা ছিল আমার লাশ আমার সন্তানের কাঁধে উঠবে। কিন্তু পিতাকেই সন্তানের লাশ কাঁধে নিতে হচ্ছে। আামার শোক জানানোর ভাষা নেই।
তিনি বলেন, আমি তো আর আমার ছেলেকে ফেরত আনতে পারব না। কিন্তু আমরা তার পরিবারের ক্ষতিপূরণসহ শিক্ষার্থীরা অন্যান্য যেসব দাবি জানিয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে সহমত পোষণ করছি। তাদের প্রত্যেকটি দাবিই পূরণ করা হবে। আমরা হিমেলের মায়ের সাথে কথা বলেছি। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছি। আজকেই পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হবে এবং পর্যায়ক্রমে ক্ষতিপূরণের আরো টাকা প্রদান করা হবে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা করা হবে বলেও জানান উপাচার্য।
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো, নিহতের পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহতের বোনকে চাকরি দিতে হবে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাল্টাতে হবে, প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগ, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং হিমেল নিহতের ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিচার করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হিমেলের দাদার বাড়ির স্বজনদের হাতাহাতি:
হিমেলের জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে নাটোরের উদ্দেশে রওনা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, শিক্ষকসহ শিক্ষার্থী ও সহপাঠীরা। এতে আপত্তি জানায় হিমেলের দাদার বাড়ির স্বজনেরা। বগুড়ার শেরপুরে হিমেলের দাদার বাড়ি। হিমেলের সহপাঠীরা জানান, যেহেতু হিমেলের বাবা নেই, তাই তার মায়ের কাছেই লাশ পৌঁছানো হবে। তার মা-ই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। অপরদিকে, হিমেলের চাচা মো. মিরাজ জানান, 'হিমেলের বাবার ইচ্ছা ছিল তার পাশের কবরটি যেন তাদের স্বজনের মধ্যে কারো হয়। হিমেল দাদার বাড়িতে বড় হয়েছে। সেখানে হাজার হাজার মানুষ হিমেলের জানাজা পড়ার জন্য অপেক্ষা করছে।'
এরই একপর্যায়ে হিমেলের চাচাত ভাই পরিচয় দেওয়া এক স্বজন শিক্ষার্থীদের সাথে উদ্ধতপূর্ণ আচরণ শুরু করে। শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ শুরু করলে তাদের মধ্যে দুয়েকবার হাতাহাতি হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে তার স্বজনেরা মাইক্রোবাসযোগে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মাইক্রোবাসটি ভাঙচুরের চেষ্টা চালায়। সেখানে উপস্থিত শিক্ষক আতাউর রহমান ও কাজী মামুন হায়দার শিক্ষার্থীদের শান্ত করেন।
হিমেলের সহপাঠীরা জানান, হিমেলের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে হিমেল তার নানার বাড়ি নাটোরে মায়ের কাছেই থাকতেন। এতদিন তার চাচারা বা দাদার বাড়ির পক্ষের কেউই হিমেলদের কোনো রকম সহযোগিতা তারা করেনি। হিমেল টিউশনি করে মায়ের জন্য কিছু টাকা পাঠাত। হিমেল এ বিষয়গুলো নিয়ে খুব কষ্টে থাকত।
দায়িত্বে অবহেলায় প্রক্টর লিয়াকত আলীকে প্রত্যাহার:
এদিকে হিমেল নিহতের ঘটনায় প্রক্টরিয়াল বডির প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা প্রক্টর লিয়াকত আলীকে প্রত্যাহারের দাবি জানান। ঘটনার পর মঙ্গলবার রাতেই প্রক্টরকে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার করা হয়। তার স্থলে বুধবার দুপুরে গণিত বিভাগের অধ্যাপক আসাবুল হককে প্রক্টরের দায়িত্ব দেয় রাবি প্রশাসন।
ক্যাম্পাসের ২০ তলা বিজ্ঞান ভবনের নাম হবে হিমেলের নামে:
এদিন বিকেলে পুনরায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মুক্ত আলোচনায় বসেন উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার। শিক্ষার্থীরা নানা দাবি উৎত্থাপন করলে উপাচার্য সকল দাবি মেনে নেন এবং তিনি ঘোষণা করেন হিমেলের নামে আমাদের নব নির্মিত ২০তলা বিজ্ঞান ভবনের নামকরণ করা হবে।
উল্লেখ্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য দু'টি আবাসিক হল ও একটি বিশতলা একাডেমিক ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। বিশতলা একাডেমিক ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছে শহীদ হাবিবুর রহমান হলের দক্ষিণ পাশে।
মঙ্গলবার রাতে শহীদ হাবিবুর রহমান হলের দিক থেকে মোটরসাইকেলে ক্যাম্পাসের দিকে যাচ্ছিলেন হিমেল ও রায়হান রিমেল। এ সময় নির্মাণাধীন ভবনের গেটের সামনে পৌঁছুলে নির্মাণ সামগ্রী বহনের কাজে নিয়োজিত একটি ট্রাক তাদেরকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই হিমেল মারা যান। আহত হন রায়হান রিমেল। তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি সিরামিক ও ভাস্কর্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। এ ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা নির্মাণকাজে ব্যবহৃত পাঁচটি ট্রাকে অগ্নিসংযোগ, উপাচার্য ভবন ঘেরাও এবং ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে অবস্থান নেয়। তারা নির্মাণাধীন ভবনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করে ও তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়।