বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে শুরু করে কর্পোরেট এসপিওনাজে বাংলাদেশের শার্লক হোমসেরা
উত্তরা, ঢাকা। ভোরবেলা। মধ্য ত্রিশের এক ব্যক্তি বাইকে চেপে একটি প্রাইভেট কারের পিছু নিয়েছেন। একটু পর গাড়ি থেমে গেল, ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন মহিলা। খানিক দূর থেকে ওই নারীর অজান্তে তার ছবি তুলতে থাকেন লোকটি! অবশেষে প্রমাণ জোগাড় হয়ে গেছে। প্রমাণ পেয়ে গেছেন যে ওই নারী তার কর্মস্থল, মোহাম্মদপুরের একটি ব্যাংকে নেই, আছেন শহরের অন্য প্রান্তের একটি রেস্তোরাঁয়।
নাজমুল হোসেন (ছদ্মনাম) ইতালি প্রবাসী। তার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঢাকার মোহাম্মদপুরে থাকেন। নাজমুলের সন্দেহ ছিল, তার স্ত্রী বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। এই সন্দেহের কারণ, নাজমুল সম্প্রতি জানতে পেরেছেন তার স্ত্রী প্রতিদিন সকালে অফিসে না গিয়ে মাঝে মাঝে অন্য কোথাও যান। তাই নাজমুল এই রহস্য ভেদ করার দায়িত্ব দেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ 'সুলতান'—ফুয়াদ ইবনে সুলতানকে।
উত্তরার একটি আবাসিক ভবনের নিচতলায় নিজের অফিসে বসে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ ঘটনা শোনাচ্ছিলেন সুলতান। তার অফিসটা খোলামেলা, আলো ঝলমলে; আয়তনে একটা কোচিং সেন্টারের প্রায় দ্বিগুণ হবে। পাল্প ডিটেকটিভ উপন্যাসে যেরকম দেখা যায়—ধোঁয়ায় ভর্তি, প্রায়ান্ধকার অফিস—তার সঙ্গে সুলতানের অফিসের কোনো মিল নেই।
ক্লায়েন্ট সুলতানকে অগ্রিম সম্মানী দিয়ে দিয়েছিলেন। ছোট কাজটি থেকে এই গোয়েন্দার আয় হয়েছে ১০ হাজার টাকা। অঙ্কটা বেশি না হলেও প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে সুনাম বাড়ানোর জন্য কাজটা করতে হয়েছে সুলতানকে।
প্রায় ২০ জন ব্যক্তি ও সংস্থা এখন ঢাকা শহরে বেসরকারি গোয়েন্দা ব্যবসা চালাচ্ছে। মানুষের ওপর চোখ রাখা থেকে শুরু করে কর্পোরেট জগতে গুপ্তচরবৃত্তি পর্যন্ত তাদের 'মিশনে'র পরিধি।
গত দুই বছরে সুলতান আটটি কেস সামলেছেন। বেশিরভাগই কেসই পরিবার-সম্পর্কিত। এখন তিনি মাসে গড়ে দুটি কেস পান। সুলতানের দাবি, তার সাফল্যের হার প্রায় ৬০ শতাংশ।
সুলতান জানান, একজন স্ত্রী বা স্বামী যখন সন্দেহ করেন তার জীবনসঙ্গী বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, তখন তিনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ নিয়োগ করেন। কখনও কখনও খোঁজ নিয়ে দেখতে হয় ক্লায়েন্টের স্ত্রী বা স্বামী আগে বিবাহিত ছিলেন কি না। সুলতানের সমাধান করা ৯৫ শতাংশ কেসেই দেখা যায়, স্বামী বা স্ত্রী সন্দেহ করছেন যে তার সঙ্গি/সঙ্গিনী বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িত।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ ঢাকা নামে একটি ফেসবুক পেজ চালান সুলতান।
গত বছর একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার কেস আসে সুলতানের কাছে। ওই কর্মকর্তা একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। মেয়েটি তাকে ব্ল্যাকমেইল করে ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। সুলতানের কাজ ছিল মেয়েটির গ্রামের ঠিকানা খুঁজে বের করে- তা ওই সরকারি কর্মকর্তার পরিবারকে জানানো। কাজটি সফলভাবে শেষ করেন এই গোয়েন্দা।
কোম্পানির গোপনীয়তা নিয়েও কাজ করেন সুলতান। তিনি জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ট্রেড সিক্রেট জানতে চায়।
কর্মজীবনের শুরুর দিকে সুলতানের সঙ্গে একটি ব্যাংক যোগাযোগ করে। তবে সে সময় এ পেশায় তিনি একেবারেই নবাগত ছিলেন বলে ওই ব্যাংকের কর্মকর্তারা তার ওপর ভরসা করতে পারেননি। এ কারণে ব্যাংকটির সঙ্গে আর কাজ করা হয়ে ওঠেনি তার। যেসব কোম্পানি প্রাইভেট গোয়েন্দা নিয়োগ করে, তারা চূড়ান্ত গোপনীয়তা বজায় রাখে বলে জানান সুলতান।
প্রাইভেট ডিটেকটিভের পেশা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ পেশায় প্রচুর সময় দিতে হয়। তাছাড়া ধৈর্য থাকতে হয় পাহাড়সম। যেমন, কারও ওপর নজর রাখার জন্য গোয়েন্দাদের প্রায়ই এক জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
হত্যা ও মাদক-সংক্রান্ত কেস নিয়ে কাজ করেন না সুলতান, কারণ এসব কেস তদন্তের জন্য সরকারের নিজস্ব গোয়েন্দা আছে।
শার্লক হোমসের বাউন্ডুলে ছেলেগুলোর কথা মনে আছে? এই ভবঘুরে ছেলেগুলোকে হোমস ব্যবহার করত নিজস্ব তথ্যের নেটওয়ার্ক হিসেবে। হোমসের ভাষ্যে, এরা 'যেকোনো জায়গায় যেতে পারে, যেকোনো কিছু শুনতে পারে'।
সুলতানেরও এই নেটওয়ার্কের নিজস্ব সংস্করণ রয়েছে। সাহায্য পাওয়ার জন্য তিনি কেয়ারটেকার, গৃহকর্মী ও নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাদের খুশি রাখার জন্য টাকাও দেন। এই মানুষগুলো সুলতানকে বিভিন্ন কেসে সাহায্য করে।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র সুলতান এই পেশায় আসার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন জেমস বন্ড ও শার্লক হোমসকে দেখেই।
তবে নিজের হিরোদের চেয়ে সুলতানের কাজকর্ম আলাদা। তিনি রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে কাজ করেন না, তবু তার পেশায় ঝুঁকি আছে। সুলতান জানান, তিনি যখন কারও ছবি তোলেন বা কারও ব্যাপারে খোঁজখবর নেন, তা সেই ব্যক্তি জানতে পারলে তাকে (সুলতানকে) মারধর করার একটা সম্ভাবনা থাকে।
তার ভাষায়, 'কারও কাছে তথ্যের জন্য গেলে তারা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারে- সেই তথ্য দিয়ে আমি কী করব। আমি কেন তথ্য চাইছি, তার আসল কারণ জানতে পারলে তারা আমাকে মারধর করবে। এ কারণে আমাকে প্রতিটা পদক্ষেপ নিতে হয় খুব সাবধানে।'
সাংবাদিক থেকে প্রাইভেট ডিটেকটিভ:
রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র গ্রিনরোডে গত চার বছর ধরে প্রাইভেট ডিটেকটিভ বাংলাদেশ নামে একটি গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন মোস্তাফিজুর রহমান।
২০০১ সালে কাজের সন্ধানে রাজধানীতে আসেন তিনি। এরপর শুরু হয় তার সাংবাদিক জীবন।
এরকম একটা ব্যবসা শুরুর চিন্তা কীভাবে এলো- তা এখন আর তার তেমন একটা মনে নেই। ৪৩ বছর বয়সি মোস্তাফিজের শুধু মনে আছে, 'আমি ক্রাইম রিপোর্টার ছিলাম। একদিন ভাবলাম, একটা প্রাইভেট কোম্পানি খুললে কেমন হয়?'
তার এজেন্সি মূলত নজরদারি সেবা দেয়। 'ধরুন, আপনি কারও ওপর নজর রাখতে চান। তাদের পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটা দল নিয়োগ করতে পারি আমি'- বলেন তিনি।
মোস্তাফিজ আরও জানালেন, 'আপনার ওপর যদি নজর রাখা হয়, তাহলে তাদের কাজ হবে আপনাকে অনুসরণ করা। আপনি সারাদিন কী করছেন—কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন, কার সাথে কথা বলছেন এবং কার সাথে দেখা করছেন—এরকম ব্যাপারগুলোর ওপর তারা নিবিড় নজর রাখবে।'
সেবা দেওয়ার জন্য মোজস্তাফিজের এজেন্সি ঢাকা শহরের ভেতরে প্রতিদিন ৩ হাজার টাকা ও পরিবহন খরচ নেয়। ঢাকার বাইরের কাজের জন্য অতিরিক্ত আবাসন ফি যোগ হয়। 'ধরুন, আপনি রাজশাহীতে থাকেন। আমি তো ঢাকায় বসে আপনার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে পারব না,' বলেন তিনি।
কল্পনা করতে পারেন, ফেলুদা বা ব্যোমকেশ ক্লায়েন্টদের নানা রকমের প্যাকেজ অফার করছে! প্রাইভেট ডিটেকটিভ বাংলাদেশ এজেন্সি কিন্তু করে। তাদের প্রথম প্যাকেজটি ১০ দিনের—খরচ ৩০ হাজার টাকা। তার সঙ্গে যোগ হয় পরিবহন খরচ।
মোস্তাফিজ জানান, তার বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট সাধারণত অন্য কারও কাছ থেকে শুনে তার কাছে আসেন। গোয়েন্দা কাহিনির ভক্তমাত্রই জানেন, মানুষের মৌখিক প্রশংসা যেকোনো গোয়েন্দা সংস্থার জন্য অপরিহার্য—সেটা বাস্তবই হোক বা কাল্পনিক।
পাল্প ডিটেকটিভ সিনেমাপ্রেমী যখনই 'প্রাইভেট ডিটেকটিভ' শব্দটি শোনেন, চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওভারকোট পরা রহস্যে ঘেরা কোনো মানুষের ছবি। লোকটি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের নিচে, চোখে সানগ্লাস, চেহারা অস্পষ্ট। কিন্তু বাস্তবজীবনের গোয়েন্দা মোস্তাফিজুর রহমান এমন কল্পনায় জল ঢেলে দেন। তিনি বা তার দলের সদস্যদের কেউই সানগ্লাস পরেন না, এমনকি রহস্যময় দেখায় এমন কোনো পোশাকও পরেন না।
মোস্তাফিজুরের কয়েকজন স্থায়ী কর্মী আছে। আছে কয়েকজন ফ্রিল্যান্সারও। তাদের সবাইকে সার্বক্ষণিক নিয়োগ দিয়ে লাভজনকভাবে ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়। মোস্তাফিজদের তথ্য সরবরাহকারী কিছু উৎসও রয়েছে।
তার এজেন্সি প্রতি মাসে গড়ে ১০-১৫ জন নতুন ক্লায়েন্ট পায়। এ পেশায় অনেকেই একা একা কাজ করেন, তাছাড়া প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কোনো সমিতিও নেই। এ কারণে ঢাকায় কয়টি প্রাইভেট ডিটেকটিভ কোম্পানি কাজ করছে, তা জানেন না মোস্তাফিজ।
মোস্তাফিজের ট্রেড লাইসেন্সও নেই, কারণ বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য কোনো সরকারি গাইডলাইন নেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো গাইডলাইন না থাকাটাই ভালো বলে মনে করেন মোস্তাফিজ। এখন যেভাবে আছে, সেভাবে থাকাই ভালো।
মানুষের মধ্যে প্রতারণার প্রবণতা বাড়ার কারণে দেশে নজরদারির চাহিদা বাড়ছে বলে মনে করেন মোস্তাফিজ। প্রসঙ্গত, দেশে প্রতারণার মামলা ক্রমেই বাড়ছে।