আজো কেন মানুষ ‘একদিন প্রাণ সখার দেখা পাওয়ার’ মিথে বিশ্বাস করে?
বহুকাল ধরে যুগে যুগে মানুষ তাদের মনের মানুষের কামনা করে আসছে। কবি সাহিত্যিকরা মনের মানুষ নিয়ে তাইতো লিখে গেছে হাজারো উপাখ্যান। রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছিলেন, "আয় আরেকটিবার আয়রে সখা প্রাণের মাঝে আয়।" লালন তার গানে বলেছেন "মিলন হবে কতো দিনে আমার মনের মানুষেরও সনে।" এই লাইনগুলোই আমাদের বলে দিচ্ছে, মনের মানুষকে খুঁজে পেতে সবসময় মরিয়া হয়ে থাকে মানুষ।
প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী মানুষ যেমন একে অপরের প্রেমে পড়ে, তেমনি অন্য প্রাণিরাও তাদের জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়। একদল মানুষের বিশ্বাস তাদের ভালোবাসার মানুষটিকে সৃষ্টিকর্তা শুরু থেকেই তাদের জন্য পূর্বনির্ধারিত করে পাঠিয়েছে। অবাক হলেও সত্যি- বহু আগ থেকে প্রায় প্রতিটি সমাজের মানুষেরা এমন বিশ্বাস লালন করে আসছে। ইতিহাসে এমন অনেক ভালোবাসার উদাহরণ রয়েছে যারা একে অপরের জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যেমন; রোমিও-জুলিয়েট, লাইলি-মজনু, শিরিন-ফরহাদ।
অনেক মানুষ আবার 'এক প্রেমে' বিশ্বাসী। অর্থাৎ তাদের ধারণা একবারই তারা প্রেমে পড়েবে। আর সেটি হবে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রেম, কারণ ঐ ব্যক্তির সাথে সৃষ্টিকর্তা নিজে হাতে তার ভাগ্য লিখে রেখেছেন। জন্ম থেকেই ভাগ্য নির্ধারিত হওয়ায় জীবনে তারা একে-অপরকে খুঁজে পাবে। তাদের বিশ্বাস তাদের দেখা ও মনের মিলন হওয়ার পেছনে মূল কারণ প্রকৃতি। প্রকৃতিই তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে তাদের মিলন ঘটায়।
রবীন্দ্রনাথ তার গানে বলেছিলেন, "ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে।" তাহলে কি সৃষ্টিকর্তা এভাবেই প্রাণের সখাদের একে-অপরের মনের মন্দিরে নাম লিখে দেন? নাকি এসব কেবলই আমাদের ভ্রান্ত-বিশ্বাস।
২০২১ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির মানুষেরা একজন ব্যক্তির প্রেমে পড়ায় বিশ্বাস পোষণ করেন। তারা বিশ্বাস করেন, তাদের প্রাণের সখা/সখী হবে একদম তাদের মনের মতো। গত ৫০ বছর ধরে মানুষের এই বিশ্বাসগুলো আরও বেড়েছে।
এই বিশ্বাস প্রবল হওয়ার পেছনে অনেক কারণও রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মানুষ 'প্রাণের সখায়' (সোলমেট) বিশ্বাস করুক আর না করুক- পারিপার্শ্বিকতা এবং মনস্তত্ব তাদের মধ্যে এই ধারণাগুলো ঢুকিয়ে দেয়। তবে যারা এই ধারণায় বিশ্বাসী এবং পূর্বনির্ধারিত সঙ্গীকে খুঁজে পাওয়ার আশা করেন, তারা শুরু থেকেই তাদের সম্পর্কটাকে তেমন গুরুত্ব দেন না। তাই একটা সময় পড়ে তা হারিয়ে যেতে শুরু করে।
'মনের মানুষ' ধারণার উৎপত্তি যেভাবে
'মনের মানুষ' ধারণাটির ইতিহাস হাজার বছরের পুরানো হলেও এই শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৮২২ সালে। কবি স্যামুয়েল টেয়লর প্রথম একটি চিঠি লেখার সময় এই শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি তার চিঠিতে লিখেছিলেন, 'আপনার বিবাহিত জীবন তখনই সুখী হবে যদি আপনি আপনার মনের মানুষটিকে বিয়ে করেন'। স্যামুয়েল বৈবাহিক জীবনে সুখী ছিলেন না এবং তিনি ও তার স্ত্রী পরবর্তীতে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। নিয়তির কি অদ্ভূত লীলা-প্রথম যিনি এই 'সোলমেট' শব্দটি সৃষ্টি করলেন তার নিজের জীবনেই ছিল না কোনো মনের মতো মানুষ!
তারও বহুকাল আগে বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক প্লেটো লিখেছিলেন, "একসময় মানুষের ৪টি হাত, ৪টি পা ও ২টি মাথা ছিল। মানুষকে শাস্তি দিতে সৃষ্টিকর্তা তাদের ছিঁড়ে দুভাগ করে দিয়েছেন। আর তাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাদের দেহের বাকি অর্ধেক খুঁজে বের করতে।
৩৮৫ খ্রীস্টাব্দে প্লেটো তার বিখ্যাত বই 'সিমপোসাম' লিখেছিলেন। বইটি মানুষকে ভালোবাসা, সম্পর্কের বন্ধন এই ধারণাগুলোকে অনেকটা ভিন্নভাবে ভাবতে শিখিয়েছিল।
এখনো অনেক সমাজ ও ধর্মমতে বিশ্বাস করা হয়, মানুষের শরীরের বাকি অর্ধেক দিয়ে অন্য একজন মানুষকে বানানো হয়েছে। আর তাদের সাথেই ভাগ্য লিখে রাখা হয়েছে। হিন্দু শাস্ত্রমতে, নির্দিষ্ট কিছু মানুষের সাথে আত্মার সম্পর্ক রয়েছে, তাই তারা একে-অপরের ঘনিষ্ঠ হয়। ইউরোপীয় ইহুদিদের ভাষা ঈদিস-এ একটা শব্দ আছে "ব্যাসহার্ত" (যার অর্থ ভাগ্য), বিয়ে হওয়া দম্পতিদের এই কথাটি বলা হয়। যেখানে ধরে নেওয়া হয়, তাদের ভাগ্যে মিলন লেখাই ছিল তাই তারা বিয়ে করছেন।
তেরো শতকের বিখ্যাত ফার্সি কবি রুমির মতে, "প্রেমিকরা শেষ পর্যন্ত মিলিত হয় না, তবে তারা সর্বদা একে-অপরের মধ্যে থাকে।" এমনকি পাশ্চাত্য সাহিত্যেগুলোতে রয়েছে রোমিও-জুলিয়েট থেকে শুরু করে হিথক্লিফ এবং ক্যাথির মতো যুগল প্রেমিকদের প্রেমকাহিনি, যাদের সৃষ্টি হয়েছিল শুধু একে-অপরের জন্যে।
'মনের মানুষ' ধারণাটি কি কল্পকাহীনির মতো?
মনের মানুষ সৃষ্টি করে তা পূর্বনির্ধারণ করে রাখা হয়েছে এই ধারণা সম্পর্কে সন্দিহান হওয়ার প্রচুর কারণ রয়েছে। একটি কারণ বলা যায়, বেশিরভাগ লোকেরা তাদের সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার জন্য বেশি দূরে যায় না। তাদের আশশেপাশের বা যাদের সাথে তাদের পরিচয় তাদেরকেই বেঁছে নেয়। বেশিরভাগ আমেরিকানদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একই রাজ্যে বসবাস করা কাউকে তারা বিয়ে করছে। এবং ৪৩ শতাংশ আমেরিকান এমন কাউকে বিয়ে করে যার সাথে তারা হাইস্কুল বা কলেজে পড়েছে।
প্রায় আট বিলিয়ন লোকের একটি গ্রহে এটি অবশ্যই কাকতালীয় ঘটনা যে, এতো সংখ্যক লোকের 'মনের মানুষ' তাদের সহপাঠী বা বন্ধু হবে। তবুও সবার জন্য একজন করে 'মনের মানুষ' বরাদ্দ আছে যাদের সাথে আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠবে-এই ধারণাটি অসংখ্য সমাজে রয়েছে এবং বহু সময়কাল ধরে চলে আসছে।
শতাধিক সম্পর্কের ওপর গবেষণা করে বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, যখন কেউ মনের মতো সঙ্গী পাওয়ার প্রত্যাশায় থাকে এবং কারো সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়, তখন তারা ওই সঙ্গীর মধ্যে নিজেদের কল্পনায় ভাবা মনের মানুষটিকে খুঁজতে থাকে। তখন কল্পনার সাথে না মিললে এক সময় তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। যেহেতু তারা একজন মনের মতো ব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করছে তাই তারা সম্পর্কে থাকলেও সন্দেহ করা শুরু করে-হয়তো এটা আমার সেই ভাগ্য নির্ধারিত প্রেম না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো মানুষই পুরোপুরি ত্রুটিহীন বা সর্বগুণ সম্পন্ন হয়না। তাই জীবন সঙ্গীর সাথে সুখী হতে চাইলে আপনাকে 'মনের মতো' হতে হবে এই ধারণাটি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।
সময়ের সাথে সাথে এখন সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার মাধ্যমগুলোতে পরিবর্তন এসেছে। আগে যেখানে মানুষ প্রথম দেখায় প্রেমে পরতো এবং চিঠিএ আদান-প্রদান করে প্রেম করতো- সেখানে আধুনিক ডেটিং অ্যাপগুলো এসে প্রেম ও সঙ্গী খুঁজে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে।
- সূত্র: বিবিসি