করহার না বাড়িয়ে নেট বাড়ানোর পরামর্শ থিংক ট্যাঙ্কদের
করোনার সময়ে ব্যবসায়ীদের জন্য দেওয়া সরকারের বিদ্যমান আর্থিক সহায়তা আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত রাখা ও নতুন করে কর আরোপ না করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
এর বিপরীতে করের পরিধি বৃদ্ধি এবং এনবিআরের ভিত্তি বাড়িয়ে ট্রেড ভিত্তিক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ, সম্পদ কর নির্ধারণ, ইলেকট্রনিক কর ব্যবস্থার প্রবর্তণ ও ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে কর ফাঁকি বন্ধ করে রাজস্ব বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বুধবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে এক আলোচনায় এসব সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), পলিসি রিসার্চ ইনন্সটিটিউট (পিআরআই), বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, পিডব্লিউসিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রাক-বাজেট আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এনবিআর।
বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, "সবার আগে এনবিআরের ভিত্তি মজবুত করতে হবে। রাজস্ব আহরণের প্রক্রিয়াটিকে অনলাইন ভিত্তিক করতে হবে। অর্থপাচার কিভাবে বন্ধ করতে পারি সেদিকে নজর দিতে হবে। উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আমদানিতে নজর দিয়ে ব্যবসায়ীদের সুযোগ করে দিতে হবে। ভিত্তি বাড়িয়ে ও করফাঁকি রোধ করে রেভিনিউ বাড়াতে হবে।"
২০২৬ সালে দেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হলে নতুন সেটি চ্যালেঞ্জ আসবে জানিয়ে তিনি বলেন, "এলডিসি পরবর্তী সময়ে অন্য দেশকে ট্যারিফ সুবিধা দিতে হবে।"
এর ফলে শুল্কখাতে রাজস্ব কমে যাবে উল্লেখ করে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, "কর্পোরেট কর হার কমিয়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। গত দুই বাজেটে কমানোর পরও দেশের কর্পোরেট কর হার ৩০ শতাংশ। অথচ চীন, ভারত ও ভিয়েতনামসহ আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর করপোরেট কর হার ক্ষেত্রবিশেষে ১৫ শতাংশেরও নিচে।"
এখনো বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব হার ১০ শতাংশের নিচে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "কর জিডিপির হারে অন্যদেশের তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে। তাই আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। তবে এর জন্য করহার বাড়ানো যাবে না।"
করোনায় সরকারের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় জাতীয় বাজেটের জন্য সম্পদ আহরণ করতে ধনী, বিত্তবান, সম্পদশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারী বাড়িয়ে কর আহরণ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
বাজেট তৈরিতে সরকারকে চারমাত্রিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ওপর জোর দিতে বলেছে তারা। অর্থনৈতিক মহামন্দা ও কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বের সব দেশই এখন অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, স্বাস্থ্যগত ও রাজনৈতিক মহাবিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে।
অর্থনীতি সমিতির সেক্রেটারি অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, "রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে দরিদ্রদের ওপর প্রত্যক্ষ করের বোঝা না বাড়িয়ে ধনী-বিত্তশালীদের ওপর সম্পদ কর আরোপ করতে হবে, অতি ধনীদের ওপর করের হার বাড়াতে হবে।"
"৮০ শতাংশ শেয়ার-বন্ডের মালিক গুটিকয়েক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বড় বড় বিনিয়োগের ওপর সম্পদ কর আরোপ করতে হবে," যোগ করেন তিনি।
আগামী বাজেটে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ -সিপিডি। একই সাথে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার বিধান বাজেট থেকে উঠিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেয় তারা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মুনতাসির কামাল বলেন, "বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিগুলো থেকে কিভাবে এই সুবিধাটা নেওয়া যায় অর্থাৎ তাদের ছাড়টা কিভাবে কমিয়ে আনা যায় সেটি বিবেচনায় রেখে ছোট ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে কিভাবে লম্বা সময় সুবিধা দেওয়া যায়, তা বিবেচনা করার জন্য আমরা অনুরোধ জানাচ্ছি।"
সিপিডি বলছে, মানি লন্ডারিং এবং করফাঁকি বন্ধ করতে পারলে কর জিডিপি অনুপাত বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ীদের ওপর নতুন করে করারোপের প্রয়োজন হবে না। এজন্য এনবিআরের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলটি শক্তিশালী করার প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি।
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ থেকে অংশ নেন সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মোহাম্মদ ইউনুস।
তিনি বলেন, "আমাদের ৭০ লাখ টিআিইএনধারীর মধ্যে ২৪ লাখ করদাতা আয়কর রিটার্ন জমা দেন। বাকি করদাতারা কেন রিটার্ন দিচ্ছে না তা এনবিআরকে খুঁজে বের করতে হবে। করযোগ্য সব মানুষকে ট্যাক্সের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।"
গ্রামীণ পর্যায় থেকে ভ্যাট আদায়ে এনবিআর পৌরসভাগুলোর সঙ্গে রেভিনিউ শেয়ারিংয়ে চুক্তি করতে পারে বলে পরামর্শ দেন তিনি।
পিডব্লিউসির ব্যবস্থাপনা অংশীদার মামুন রশিদ বলেন, "বাজেট আলোচনায় আসার আগে আমরা অনেক ফার্মের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সবচেয়ে বড় কর্নসার্নের জায়গা হলো- উইথহোল্ডিং ট্যাক্স ও কোম্পানির অপারেশনাল এক্সপেন্সেস। রয়্যালিটি ও টেকনিক্যাল এক্সপেন্সের ক্ষেত্রেও একই বিধান যোগ করে এনবিআর।"
উৎপাদন খাতের কোম্পানিগুলোর মার্কেট রিসার্চ ও প্রমোশনে অনেক খরচ করতে হয় উল্লেখ করে আয়কর আইনের এ বিধানটি পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন তিনি।
মামুনুর রশীদ বলেন, "আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের বিভিন্ন প্রজেক্টের পরামর্শক হিসাবে কাজ করছে। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের পর উইথ হোল্ডিং ট্যাক্স ৪৩ শতাংশ হয়ে যায়। ফলে তারা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হয়।"
পিডব্লিউসির পক্ষে আয়কর আইনের সংশোধন তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটির ডিরেক্টর কপিল বসু বলেন, "বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান অস্থায়ী ভিত্তিতে বাংলাদেশে কাজ করলে তাদের জন্য রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থা আয়কর আইনে নেই। এ বিষয়টি সংযোজনের প্রস্তাব করেন তিনি।
এছাড়া আইটিইএস ভিত্তিক কোম্পানি বাংলাদেশে শাখা খুলে দেশে তথ্য প্রযুক্তি বিকাশে কাজ করলে তাদের জন্য ট্যাক্স মওকুফের প্রস্তাব করেন তিনি।
ভ্যাট প্রদানের ক্ষেত্রে নন রেসিডেন্সিয়াল প্রতিষ্ঠানকে ডাবল ট্যাক্সসেশনের শিকার হতে হয় জানিয়ে এ সংক্রান্ত জটিলতা দূর করার প্রস্তাব করেন পিডব্লিউসির লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স পরিচালক ইয়ামিন জাহাঙ্গীর।
আলোচনায় স্নেহাশিষ মাহমুদ কোম্পানির পার্টনার স্নেহাশিষ বড়ুয়া দেশের সিটি কোর্পোরেশনগুলোতে হোল্ডিং ট্যাক্সের সাথে টিআইএন বাধ্যতামুলক করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, "হোল্ডিং ট্যাক্সের সাথে টিআইএন বাধ্যতামূলক করলে তারা অবশ্যই কর দিতে বাধ্য।"
এছাড়া, জমির খাজনা দেওয়ার ক্ষেত্রে ই-টিআইএন এর ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি মৌজা রেট যৌক্তিকরণ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, "ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুনাফার ওপর কর (ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স) আদায় নিশ্চিত করতে পারলে দেশের স্বচ্ছতা বাড়বে। সম্পদ শতভাগ বৈধ হওয়ায় সম্পদশালীদের অস্থিরতা কমবে।"
আলোচনায় উঠে আসা পরামর্শগুলো আগামি বাজেট প্রণয়নের সময় বিবেচনায় রাখা হবে বলে জানান কর্মকর্তারা।
প্রাক-বাজেট আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস সদস্য (শুল্ক নীতি) মাসুদ সাদিক। আলোচনায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সদস্য (আয়কর নীতি) সামস উদ্দিন আহমেদ ও (ভ্যাটনীতি) জাকিয়া সুলতানা।