স্মার্টফোনই ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র!
রুশ সেনাদের হাতে অবরুদ্ধ কিয়েভ থেকে একের পর এক ফোন কল করে যাচ্ছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। শহর ত্যাগ করবেন না সেই সিদ্ধান্ত আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ফোনের মাধ্যমেই পশ্চিমা নেতাদেরকে রাশিয়ার উপর লাগাতার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে রাজি করিয়ে ফেলেছেন তিনি!
ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতে ইউক্রেনের জনসাধারণের অসীম সাহসিকতাকে বেশ ইতিবাচকভাবে নিয়েছে ইউরোপের জনগণ। আর তা বুঝতে পেরেই পশ্চিমা নেতাদের সাথে এক মুহূর্তের জন্যও ফোনে যোগাযোগ বন্ধ করেননি জেলেনস্কি। এছাড়া, টুইটারে নিজের মিত্রদের প্রশংসা, নিন্দা বা সাহস যোগানো- সবকিছুতেই যেন স্মার্টফোনকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। এক সপ্তাহ আগেও রাশিয়ার উপর যেসব নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, এখন তা ই বাস্তবে রূপ নিয়েছে। প্রতিনিয়ত যেভাবে পশ্চিমারা নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করছে, তাতে হাঁপিয়ে উঠছেন আইনজীবি, কর্মকর্তা ও ব্যাংকাররা। কারণ খবরের পাতার শিরোনামকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চাপে আছেন তারাও!
এ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত এক নেতার কার্যালয় বলে, "আমরা তাকে সম্মান করি। তিনি হয়তো ইউক্রেনকে বাঁচাতে পারবেন না কিংবা রাশিয়াকেও বদলাতে পারবেন না। কিন্তু তিনি ইউরোপকে বদলে দিচ্ছেন।"
শনিবারের কথাই ধরা যাক। জেলেনস্কি জানান, তিনি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁকে কল দিয়েছেন কূটনৈতিক আলোচনার জন্য। একই দিনে তিনি ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন, ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি, সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ইগনাজিও ক্যাসিস, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল আন্তোনিও গুতেরেস, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলজ, পোপ, চেক প্রশানমন্ত্রী পেটর ফিয়ালা, পোলিশ প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে দুদার সাথে ফোন কলে এবং রাতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সাথে ভার্চুয়ালি কথা বলেছেন।
এর একদিন আগেও প্রায় সমান সংখ্যক ফোন কল করেছেন ভলোদিমির জেলেনস্কি। সবগুলো ফোনকলেরই উদ্দেশ্য ছিল অস্ত্র সহায়তা ও রাশিয়ার উপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের অনুরোধ। দেশে চলমান যুদ্ধ ও রুশ সেনাদের কিয়েভে প্রবেশের টালমাতাল সময়ে কিভাবে এতগুলো ফোন কল করলেন জেলেনস্কি, তা বোঝা খানিকটা কঠিনই বটে! বোঝাই যাচ্ছে, এই কদিন আক্ষরিক অর্থেই দুই চোখের পাতা এক করেননি তিনি!
প্রেসিডেন্টকে কথা বলা অবস্থায় দেখা এক ব্যক্তি বলেন, "তিনি স্পষ্টভাষী, সোজাসাপ্টা কথা বলেন এবং খুবই বাস্তবমুখী।" তবে ফোনকলগুলো যে কাজে লেগেছে তা নিঃসন্দেহে স্বীকার করা যায়!
বেশিরভাগ যুদ্ধেই সামাজিক পরিবর্তন অনেক দ্রুত হয়। কিন্তু সপ্তাহের ব্যবধানে জার্মানির ইউটার্ন নিয়ে ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দেওয়া, প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির দুই শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং সুইফট থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করতে সম্মত হওয়াটা শুধু নীতি পরিবর্তনের ধারা নয়। এগুলো ইউরোপের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী মানসিকতারই ধারক।
একইভাবে, ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি এ সপ্তাহে রাশিয়ার গ্যাস থেকে ইতালিকে মুক্ত করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন।
কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রাশিয়াকে সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে প্রথমে আপত্তি জানিয়েছিলেন দ্রাঘি। এ দাবিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। তার দাবি, গত সপ্তাহে জি-সেভেন এর বৈঠকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি বিষয়টি।
তবে দ্রাঘি স্বীকার করেছেন, জেলেনস্কির দক্ষ নেতৃত্ব ও রাশিয়ার দাম্ভিক আচরণ দেখে বিশ্বের সিংহভাগ দেশের নেতৃবৃন্দ রাশিয়াবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। এ কারণেই রাশিয়াকে সুইফট পেমেন্ট সিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং ফ্রান্সের মতো দেশগুলো বাকিদের সমর্থন আদায় করতে সম্মত হয়েছে।
জেলেনস্কি নিরলস লবিং করে যাচ্ছেন। কিন্তু রাশিয়ার উপর সবচেয়ে বড় যে আঘাতটি আসতে যাচ্ছে তাতে এই ইউক্রেনীয়র কোনো হাত নেই। রাশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে হিমায়িত করে দিচ্ছে পশ্চিমা শক্তিগুলো। এই নিষেধাজ্ঞা পুতিনের অর্থনীতিকে ভেঙে দিতে পারে বলে মনে করছেন অনেক ইউরোপীয় নেতা।
একজন ইউরোপীয় নেতা বলেন, রাশিয়ান বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে ইউক্রেন সফল হবে, সেই সম্ভাবনা খুবই সীমিত। (পশ্চিমা শক্তিদের) মূল লক্ষ্য হচ্ছে, পুতিনকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে এতটাই একঘরে করে দেওয়া যাতে তিনি বুঝতে বাধ্য হন, নিজের মতো এই যুদ্ধ জেতা হচ্ছে না তার।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান