কেন নতুন চাকরিতে যোগ দিয়ে শুরুতে বেমানান লাগে?
নতুন চাকরিতে যোগদান করা মানে যেমন নতুন এক উত্তেজনা, তেমনই এটি আমাদের জন্য অস্বস্তিরও কারণ হয়ে ওঠে। আগেপরে যত চাকরির অভিজ্ঞতাই থাকুক না কেন, নতুন কর্মক্ষেত্রে এসে হুট করেই যেন নিজেকে ক্লাসের নতুন শিশুর মতো অনুভব হয়! সারাক্ষণ মনে হতে থাকে, কেউ না কেউ বোধহয় আমার উপর নজর রাখছে! তবে এমনটা শুধু চাকরির প্রথম কয়েক সপ্তাহেই হয়, এরপর আস্তে আস্তে আমাদের দ্বিধা-জড়তা কেটে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কর্মস্থলের প্রথম কয়েক সপ্তাহে কিভাবে নিজের এই অস্বস্তি কাটিয়ে উঠবেন? আবার আপনি যদি হন পুরনো কর্মী, তাহলে সদ্য যোগদান করা সহকর্মীর সাথে কেমন আচরণ করবেন এই সময়টায়?
কর্মস্থলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে হলে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা থাকা প্রয়োজন। কারণ এটি আপনার প্রাথমিক দুর্ভাবনা কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
অনুমানের সাথে বাস্তবের অমিল
নতুন কর্মস্থলে অস্বস্তি সৃষ্টি হওয়ার প্রাথমিক একটি কারণ হলো, আপনি জানেন না আপনার জন্য সামনে কী অপেক্ষা করছে! আমাদের মস্তিষ্ক একটা 'অনুমাননির্ভর ইঞ্জিন' এর মতো। ভবিষ্যতে কি হবে তা মস্তিষ্ক আগে থেকেই সঠিকভাবে অনুমানের চেষ্টা করে। কিন্তু এর পেছনে যখন পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাস থাকে না, তখনই দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ আরম্ভ হয়ে যায়। (ঠিক একই কারণে বিদেশ ভ্রমণের আগে আমাদের খুব আনন্দ-উত্তেজনা থাকে, যা বিদেশের মাটিতে পা রাখার পর খানিকটা দমে যেতে পারে!)
আর যখনই আমরা আগামীতে কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকি, তখনই আমাদের মস্তিষ্ক নিস্ক্রিয় হতে শুরু করে। এর পেছনে ২টি কারণ রয়েছে। প্রথমত, মনে উদ্বেগ থাকলে আমরা সমূহ বিপদ বা দুর্যোগ এড়িয়ে যেতে চাই। দ্বিতীয়ত, যখন আমরা খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হই, তখন নিজেদের ব্যর্থতাকে নয় বরং ওই কাজের সিদ্ধান্ত নেওয়াটাকে দোষারোপ করি। তখন মনে হয়, তাহলে ঝামেলা সৃষ্টি করার চেয়ে কিছু না করাই ভালো! কিন্তু এই অনিশ্চয়তার কারণে আমরা সহকর্মীদের সাথেও আলাপ শুরু করতে পারি না কিংবা অফিসের পরিবেশ বুঝে উঠতে পারি না।
আমি হয়তো কোনো ভুল মন্তব্য করে বসবো'- এই চিন্তাভাবনা থেকেও অনেকে অফিসে চুপ করে থাকেন। এমনকি অতি পরিচিত কারো সাথে কথা বলার সময়ও অনেকে চুপ করে থাকেন এই ভেবে যে, তার কথার হয়তো ভুল মানে দাঁড় করানো হবে। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, মানুষ আপনার কথার পেছনের উদ্দেশ্য ধরতে চেষ্টা করে, কোন শব্দ ব্যবহার করে কথা বলছেন তা নয়! তাই নতুন সহকর্মীরা আপনাকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করবে না বললেই চলে। কারণ আপনি যেসব বিষয়ে উদ্বিগ্ন, তারা হয়তো সেগুলো লক্ষ্যই করছে না! তাই নতুন সহকর্মীদের সাথে আলাপ করা বা কিছু জানতে চাওয়া একেবারেই স্বাভাবিক।
এবার আপনার টিমের নতুন সদস্যটির জন্য আপনি কী করতে পারেন, সে প্রসঙ্গে আসা যাক। সদ্য যোগদান করা সহকর্মীর সাথে আলাপ করতে গেলে এমনভাবে কথা বলুন যেন তিনি সুনির্দিষ্ট উত্তর পান। অফিসের অন্যদের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিন। তাকে বুঝিয়ে দিন কীভাবে অফিসের কাজের গতিতে জোয়ার-ভাঁটা আসে। যদি দূরে কোথাও কাজ করতে যান, তাহলে সহকর্মীর জন্য নোট রেখে যান, যেন তিনি কাজের খেই না হারিয়ে ফেলেন।
কাজের ভাষা অজানা
নতুন কর্মস্থলে যদি আপনি কথা বলতে আগ্রহী হন, দেখা যায় এমন কিছু শব্দ চলে আসছে যা আপনার অজানা। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই আলাদা আলাদা শাখায় আলাদা আলাদা জারগন ব্যবহার করা হয়। কাজের ধরন, স্থান ও মানুষের ক্ষেত্রে এসব ভাষা ব্যবহার করা হয়। পুরনো কর্মীরা সেগুলো চট করে বুঝে উঠলেও, নবীনদের পক্ষে অনেক সময় তা বোঝা মুশকিল। কাজের প্রথম কয়েক সপ্তাহে মনে হতে পারে আপনি ভিনদেশে চলে এসেছেন, যেখানের ভাষাও আপনি বুঝতে পারছেন না।
কিন্তু প্রতি লাইনে লাইনে ব্যাখ্যা করার জন্য কাউকে কথার মাঝে থামানোও অশোভন। সেক্ষেত্রে আপনি একজন দোভাষীর সাহায্য নিতে পারেন অথবা পুরনো কোনো কর্মীকে সেসব জারগনের অর্থ বোঝাতে অনুরোধ করতে পারেন। অনেক প্রতিষ্ঠানে এসব তথ্যাদি শুরুতেই সরবরাহ করা হয়। তবে কর্মক্ষেত্রের ভাষা বোঝা খুবই জরুরি, তা নাহলে আপনি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাবেন।
আর আপনি যদি দলে নতুন কাউকে স্বাগতম জানান, তাহলে নিজে যা যা জানেন তা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করুন। আপনি যে প্রতিষ্ঠানটির জারগন বা নিয়মকানুন সম্পর্কে সরগড়, তা ভুলে যাওয়া একটু কঠিন। কিন্তু যখনই কোনো স্থানীয় পরিভাষা কর্মক্ষেত্রে ব্যবহার করবেন, তখনই তা নতুন সহকর্মীকে ব্যাখা করুন যেন সেও অভ্যস্ত হয়ে যায়।
বন্ধুবিহীন কর্মস্থল
নতুন চাকরিতে অস্বস্তি অনুভব হওয়ার সবচেয়ে বড় একটি কারণ হলো, সেখানে আপনার কোনো বন্ধু না থাকা। গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে অনেকের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ বজায় থাকলে তা নিজের মধ্যে সন্তুষ্টি ও আনন্দ আনে। আপনি হয়তো দেখলেন অফিসের একদল লোক মিলে গল্প করছে, নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে; তখন আপনার নিজেকে বহিরাগত মনে হতে পারে কিংবা বিচ্ছিন্ন অনুভব করতে পারেন। অনেকেই এসব দলে সহজে ভিড়ে যেতে পারেন না বা মিশতে পারেন না।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, নতুন অফিসে এসেই হুট করে কোনো দলে ভিড়ে যাওয়া বা বন্ধুত্ব করা সহজ ন্য, এতে সময় লাগে। আপনি বরং কয়েকজনের সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে শুরু করতে পারেন। তাদের সাথে পরিচিত হন, তাদের মনমানসিকতা বোঝার চেষ্টা করুন। তারা কোনো দলের সাথে নিয়মিত আড্ডা দেয় কিনা তা জানার চেষ্টা করুন। কফি ব্রেক বা লাঞ্চের সময় সহকর্মীদের সাথে খাবার শেয়ার করতে পারেন এবং তখন গল্প করতে পারেন। একটা দলে যুক্ত হওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, আপনার কোনো একজন সহকর্মী যদি তাদের সাথে আপয়াঙ্কে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে সাহায্য চাইতে দ্বিধা করবেন না, কারণ মানুষ সাধারণত হাসিমুখেই এসব বিষয়ে সাহায্য করে থাকে, বিশেষ করে নবাগত কাউকে।
আপনার কর্মস্থলে যখন নতুন কেউ সহকর্মী হিসেবে আসবেন, তাকে সেখানকার সামাজিক দৃশ্যপটে যুক্ত হতে সাহায্য করুন। এর জন্য তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হতেই হবে তা নয়, শুধু তাকে অন্যদের সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করুন, অন্যদের আলোচনায় তাকে যুক্ত করুন। বিশেষ করে, দূরবর্তী অঞ্চলে কাজ করার সময় এ ধরনের সাহায্য না পেলে দ্রুতই কেউ নিজেকে লেফট-আউট মনে করতে পারে, যা তার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
মনে রাখবেন, নতুন কর্মস্থলে অন্য যে কারো চাইতে আপনিই আপনাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। বাকিরা স্রেফ নিজেদের রুটিনমাফিক কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সুখবর হলো এই যে, প্রায় ছয় সপ্তাহের মধ্যেই নতুন কর্মী হিসেবে এসব প্রতিবন্ধকতা-দ্বিধাবোধ কেটে যায়। এই সময়ের মধ্যে আপনার মধ্যে নতুন কিছু অভ্যাস গড়ে উঠবে, আপনি অফিসের পরিবেশ-ভাষা ও মানুষদের বুঝতে শিখে যাবেন এবং বেশকিছু বন্ধুও পেয়ে যেতে পারেন।
সূত্র: হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ