বিদায় নাসির ভাই, জাপানের বাজার নিয়ে আর কথা হলো না আমাদের
চট্টগ্রামের পেনিনসুলা হোটেলে খেতে বসেছিলাম আমি আর নাসির ভাই। যতোদূর মনে পড়ে সময়টা ছিল ২০১১ সাল। বেশ রুচিশীল মানুষ ছিলেন, খাদ্যরসিকও। বড়সড় লবস্টার অর্ডার করেছিলেন, এর আগে এতো বড় লবস্টার দেখিনি আমি।
রেস্টুরেন্টে বসে সবসময়কার মতোই শান্তভাবে কথা বলছিলেন। তার সেই চিরায়ত হাসি মুখে লেগেই ছিল। যখনই তার না থাকার কথা মনে পড়বে, তার এই প্রতিচ্ছবিই মনে পড়বে আমার। একজন প্রকৃত বন্ধু, জীবন ও লক্ষ্য নিয়ে নিবেদিতপ্রাণ একজন মানুষ হারালাম। একজন মানুষ যিনি জানতেন কীভাবে স্বপ্ন দেখতে হয় আর কাজ করে সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়।
সে রাতে আমি নাসির ভাইকে প্রশ্ন করেছিলাম, "আপনার জিনস কান্ডের রহস্য বলুন তো"।
"২৭ বছর আগে কলম্বোতে এর শুরু," বলেন তিনি, "আপনি তো জানেন ইনাম ভাই, আমার জন্মও ব্যবসায়িক পরিবারে। আমার বাবা আর দাদা ছিলেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী। তো ব্যবসাটা আমার রক্তেই আছে"।
গ্রীষ্মের সেই রাতে এক বিজনেস ট্রিপে কলম্বো গিয়েছিলেন তিনি। জাহাজ ভাঙ্গার কিছু বিষয় দেখভাল করতে আর দামী কোনো রেস্টুরেন্টে স্থানীয় বিজনেস পার্টনারদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া আর আলাপ করতেই গিয়েছিলেন।
এক শ্রীলঙ্কান তাকে তৈরি পোশাক খাতের এক বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
"আপনি কি জানেন তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসা শুরু করার জন্য বাংলাদেশ আদর্শ জায়গা। শ্রমিকদের কম মজুরি বড় ভূমিকা রাখবে," পোশাক খাতের ওই উদ্যোক্তা বলছিলেন।
তখনই নাসির ভাইয়ের ব্যবসায়িক ইন্সটিংক্ট মাথাচাড়া দেয়। তিনি ওই উদ্যোক্তাকে তৈরি পোশাকের ব্যবসা কীভাবে চলে, বায়ার কারা, সাপ্লায়ার কারা এ নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকেন।
সে রাতে তিনি হোটেল থেকেই তৎক্ষণাৎ জাপানে তার এক পরিচিতকে কল করেন, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাত নিয়ে একটা সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন বানাতে বলেন।
"এক মাস পর প্রতিবেদন চলে আসে, দেখা যায় ওই কলোম্বিয়ান ঠিক বলেছিলেন। বাংলাদেশের একটি গার্মেন্ট হাব হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনা আছে," বলছিলেন নাসির ভাই। "আমি সাথে সাথে কোথায় আমার কারখানা হবে সে পরিকল্পনা শুরু করি। যোগ্য মানুষের সন্ধানে হংকং আর শ্রীলঙ্কায় যাই,
দুজন ফ্যাক্টরি ম্যানেজারকে রাজি করাই, জাপান থেকে যন্ত্রপাতি অর্ডার করি আর ৬০০ জন শ্রমিক নিয়োগ দেই। তারা সেলাই মেশিনের ব্যাপারে কিছুই জানতো না। তাই তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়"।
অবশেষে, ১৯৮৪ সালে তার কারখানা উৎপাদন শুরু করতে প্রস্তুত হয়। মিনেসোটার একজন বায়ারও পান, তিনি ২৪ হাজার বেসিক শার্ট অর্ডার করেন।
"আমরা সবাই বিপুল উৎসাহে দিন-রাত কাজ করছিলাম। অর্ডার মূল্য বেশ ভালো ছিল, আমরা এয়ার কারগো বুক করে ১৫ হাজার শার্ট পাঠিয়ে দেই," একটু থামলেন নাসির ভাই।
"ওয়াও, শুরুটা তো অসাধারণ। বেশ সহজই ছিল দেখা যায়," এভাবেই তাকে বলেছিলাম আমি।
"এরকম মনে হতে পারে ইনাম ভাই। কিন্তু সহজ ছিল না। এই অর্ডার আমাকে প্রায় নিঃস্ব করে দিয়েছিল। অনেক বেশি দুর্ভোগে ফেলেছিল ওই অর্ডার"।
হয়েছিল কী, অর্ডার ঠিকমতোই পৌঁছে যায়, কিন্তু সেই অর্ডারের পেমেন্ট আসেনি আর। কয়েক ডজন মেইল লেখার পর, ফোনকলের পর জানা যায় ওই মার্কিন কোম্পানিটি দেউলিয়া হয়ে গেছে। ওই চালান একেবারেই মাঠে মারা যায়।
"আমার এই স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়," বলছিলেন নাসির ভাই। "আমাদের জন্য অনেক কঠিন এক যুদ্ধ ছিল এটি, প্রতি মাসে ৬০০ শ্রমিককে বেতন দিতে হতো। প্রথম বছর একদমই ভালো যায়নি। কিন্তু আমি হাল ছাড়তে চাইনি"।
কলম্বোতে তার মেন্টর আর জাপানি পরামর্শদাতা তাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাগুলো ঘুরে ভালো বায়ার খুঁজে বের করতে বলেন।
এর পরের তিন বছর তিনি কোলনের ইন্টারজিনস ফেয়ার থেকে শুরু করে লাস ভেগাস ম্যাজিক শোয়ের মতো প্রধান প্রধান তৈরি পোশাকের মেলাগুলো ঘুরে দেখেন।
কিন্তু এতেও খুব বেশি লাভ হয়নি কারণ তখনও তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের পরিচিতি গড়ে ওঠেনি। এ খাতে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য সঠিক সময়ে ডেলিভার করাই সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ।
অবশেষে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। সে সময়কার বড় একটি ব্র্যান্ড জরডেশ থেকে অর্ডার পান তিনি।
তখন থেকেই আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি নাসির ভাইকে। তার কারখানায় আবারও কাজ শুরু হয়, শ্রমিকরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
"কিন্তু আমি প্রধানত লো-এন্ড অর্ডার নিচ্ছিলাম," বলেন নাসির ভাই। "কিন্তু আমার তো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। সেটা এমন এক সময় ছিল যখন হংকং, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড আর সিঙ্গাপুর থেকে তৈরি পোশাক ব্যবসা সরে আসছিল।
একারণে অনেক বিদেশিই চাকরি খুঁজছিলেন। আমি ব্যবসার সম্প্রসারণ শুরু করি, জনবল নিয়োগ দিয়ে আমার কারখানা চট্টগ্রাম ইপিজেডে নিয়ে আসি। সময়টা ছিল ১৯৯৪"।
এর ছয় বছর পর নাসির ভাই তার ছেলে তানভিরের সাথে নিউ ইয়র্কের ফিফথ এভিনিউতে হাঁটছিলেন।
"আমি একটি গ্যাপ স্টোরের সামনে থামি, ভেতরে গিয়ে সামনের তাকের ট্রাউজারগুলো দেখি- সবগুলোতে মেইড ইন আমেরিকা বা মেক্সিকো লেখা। আমি আমার ছেলেকে বলেছিলাম: খুব শিগগিরই একদিন আমার পণ্যও এই তাকে শোভা পাবে"।
"এখন নিউ ইউর্ক গ্যাপ স্টোরের সামনের তাকে আমার পণ্য পাবেন আপনি," বলেন তিনি।
নাসির ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার কয়েক বছর পর, তার সাথে আবারও দেখা হয় গুলশানের ব্যাংকারদের ড্রয়িং-রুমে।
"নাসির ভাই, কী করছেন আপনি?"
"ইনাম ভাই, আমি জাপানের বাজার নিয়ে কাজ করছি। এটি কঠিন জায়গা, খুব উচ্চ মান বজায় রাখতে হয়। একটা সুতো এদিক-ওদিক হলে, এতো ছোট কিছু যা হয়তো চোখেই পড়েনি, পুরো অর্ডার বাতিল হয়ে যেতে পারে"।
"এতো কঠিন হলে এখানে সময় নষ্ট করছেন কেন?" জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি।
নাসির ভাইয়ের চোখ জ্বলজ্বল করছিল। "এটাই আমার চ্যালেঞ্জ। আমি আপনাকে বলছি, আমি এটি সম্ভব করব"।
এরপর আমি তাকে প্রায়ই কল দিতাম। জাপানে তার কাজ নিয়ে জানতে চাইতাম, বিশেষ করে যখন আমি জাপানের বাজার নিয়ে কিছু লিখতে চাইতাম। প্রায়ই এমন হতো যে তিনি জাপানি কোনো হোটেলে বসে কল ধরেছেন। কিন্তু বিস্তারিত কিছু বলতেন না।
একদিন তিনি বললেন, "আমি এবার দেশে ফিরেই আপনার সাথে জাপানের বাজার নিয়ে লম্বা আলোচনা করবো। শুধু ফোনে কথা বলে বোঝাতে পারবো না"।
এরপর একদিন হঠাৎ কল দিলেন তিনি। "কোথায় আপনি?"
ঘটনাক্রমে আমি তখন চট্টগ্রামে ছিলাম, থানচি যাচ্ছিলাম।
"আমি আপনার শহরেই আছে, কিন্তু থানচি চলে যাবো নাসির ভাই,"
"কীভাবে যাচ্ছেন?"
"সম্ভবত বাসে। এখনো নিশ্চিত না"।
"এখন কোথায় আছেন?"
"বাস টার্মিনালে"।
"দাঁড়ান, যেয়েন না। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি"।
আধ ঘণ্টার মধ্যে একটি মাইক্রোবাস আসলেও আমি চলে যাই ততোক্ষণে। যখন আমি ফিরে এলাম, নাসির ভাই দেশের বাইরে ছিলেন। দেখা হয়নি আর।
এরপর, আর কখনোই আমাদের দেখা হয়নি। গত রাতে আমি অবিশ্বাস নিয়ে মোবাইল স্ক্রিনে তার মৃত্যু সংবাদ দেখছিলাম। হতবাক হয়ে যাই আমি।
আমি জাপানি বাজারের রহস্য জানতে পারলাম না নাসির ভাই। হয়তো বা শুনবো কখনো।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
মূল লেখা: Goodbye Nasir bhai, you never got to tell me about the Japanese market