রাশিয়া থেকে ৩০ হাজার টন সার কেনার অনুমোদন
রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেনে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই দেশটি থেকে সরকারিভাবে ৩০ হাজার টন মিউরিয়েট অব পটাশ বা এমওপি সার কেনার একটি প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
সোভিয়েত আমলে প্রতিষ্ঠিত রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ব জেএসসি ফরেন ইকোনমিক করপোরেশন প্রডিনটর্গ থেকে ১৫০.২১ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সার আমদানি করবে রাষ্ট্রায়ত্ব বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (বিএডিসি)।
ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধরত রাশিয়া থেকে সার আদৌ পাওয়া যাবে কি না, বা পেলে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটির সঙ্গে বিদ্যমান পদ্ধতিতে আর্থিক লেনদেন করা যাবে কি না, সে বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজেও নিশ্চিত নন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরা বরাবরই রাশিয়া থেকে সার আমদানি করি। যদি রাশিয়া সার সরবরাহ করতে না পারে, সেক্ষেত্রে আমরা বিকল্প উৎস খুঁজব।
"যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে যদি সমস্যা হয়, সেক্ষেত্রেও আমরা বিকল্প লেনদেন পদ্ধতি খুঁজে বের করব। এক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ-এর মাধ্যমে অথবা অন্য কোনও পদ্ধতিতে লেনদেনের ব্যবস্থা নিতে হবে," জানান মন্ত্রী।
রাশিয়ার সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ স্বাক্ষরের জন্য একটি ড্রাফট বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ অনুমোদন করে রেখেছে। এ চুক্তি হলে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্য দেশের পক্ষে নিজ দেশের রপ্তানিকারকদের পণ্যমূল্য পরিশোধ করবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সারের দামও বাড়ছে। এতে সরকার ভর্তুকির নতুন চাপে পড়ছে বলে উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী।
ব্লুমবার্গ বিজনেস উইকের মতে, সারের বৈশ্বিক বাণিজ্য আরও দীর্ঘসময় ব্যাহত থাকলে বিশ্বব্যাপী কৃষকদের উৎপাদন খরচ বাড়বে। ফলে বিশ্বে ইতোমধ্যেই রেকর্ড অবস্থায় পৌঁছানো খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়তে থাকবে।
সারের দাম আগে থেকেই আকাশচুম্বী। এরমধ্যে ইউরোপে গ্যাস সংকটের জন্য উৎপাদনকারীদের অনেকেই উৎপাদন কমানো সহ কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। বিশ্বের খনিজ পটাশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ আসে বেলারুশ থেকে। বেলারুশে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি পরিবহন খরচ, বর্ধিত শুল্ক ও চরম আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণেও বেড়েছে সারের দাম।
অর্থমন্ত্রী বলেন, "কী কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ছে, তা আমরা সবাই জানি। যে পরিমাণ মূল্য বাড়ে, তার কিছু অংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে বহন করে, আর কিছুটা ভোক্তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়। পুরোটা এককভাবে ভোক্তার ওপর চাপালে তারা তা বহন করতে পারবে না। আবার সরকারের পক্ষেও এককভাবে পুরো ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব নয়। সরকারের এখন অনেক বেশি ভর্তুকির প্রয়োজন।"
"বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারদরের প্রেক্ষাপটে কী পরিমাণ ভর্তুকির চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বিস্তারিতভাবে জানালে সুবিধা হতো। ভর্তুকির চাপ মোকাবেলার জন্য সুবিধাজনক অর্থায়ন পাওয়া গেলে তা আমরা অবশ্যই নেব," যোগ করেন তিনি।
বিএডিসির কর্মকর্তারা জানান, রাশিয়া থেকে সরকারিভাবে এক লাখ ২০ হাজার টন এমওপি সার আমদানির চুক্তি রয়েছে, সে চুক্তির আওতায় তৃতীয় লটে এখন ৩০ হাজার টন সার আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার বিকল্প হিসেবে কানাডা থেকে এই সার আমদানির সুযোগ রয়েছে। তবে ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করে উৎপাদন করায় কানাডার সারের মূল্য তুলনামুলকভাবে রাশিয়ার চেয়ে বেশি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব বালাই কৃষ্ণ হাজরা টিবিএসকে বলেন, "আমরা রাশিয়ার সঙ্গে এ বছর ১ লাখ ২০ হাজার টনের চুক্তি করেছি যার তৃতীয় লট কেনা হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী এই সার রাশিয়া নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আমাদের কাছে পৌছে দেবে। ফলে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে জাহাজ ভাড়া করে রাশিয়ার বন্দর থেকে সার আনার মতো কোনো ঝুঁকি আমাদের নিতে হবে না।"
"যদি রাশিয়া কোনো কারণে সার সরবরাহ করতে না পারে, সেক্ষেত্রে আমরা কানাডা থেকে আমদানি করব। কানাডার সঙ্গেও আমাদের চুক্তি রয়েছে। আমরা তাদের কাছ থেকে নিতে পারব," বলেন তিনি।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, "সার আমদানির বিষয়ে বছরের শুরুতে আমরা রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছি। চুক্তিতে সারের দাম নির্ধারণ করা আছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বা অন্য কোনো কারণে এখন আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বাড়লেও আমাদেরকে চুক্তিমূল্যে সার সরবরাহ করবে দেশগুলো।"
"সুতরাং এখনই আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারেও যুদ্ধের প্রভাবে খুব একটা দাম বাড়েনি। দুই-তিনগুণ যা দাম বেড়েছে, সেটা আগেই বৃদ্ধি পেয়েছে," বলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের অর্থ লেনদেনে বড় কোনো সমস্যা দেখছেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্টের একজন কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় রপ্তানির বড় অংশই তৃতীয় দেশের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। তাছাড়া রাশিয়ার বেশকিছু ব্যাংকের ওপর এখনও ইইউ বা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নেই। যেসব ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই, সেসব ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো লেনদেন করতে পারবে।"
কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিএডিসির কর্মকর্তারা জানান, "রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাবে সারের মূল্য ও জাহাজ ভাড়া বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে আশার কথা হলো, চলতি বোরো মওসুমে বিভিন্ন ধরনের সারের চাহিদা মেটানোর মতো মজুদ বাংলাদেশের রয়েছে।"
২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৭.৫০ লাখ টন রাসায়নিক সারের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ইউরিয়া ২৬ লক্ষ টন, টিএসপি ৭.৫ লাখ টন, এমওপি ৭.৫ টন এবং ডিএপি সারের চাহিদা ১৬.৫ লাখ টন।
বাংলাদেশের নন-ইউরিয়া সার আমদানির প্রধান উৎস যুদ্ধরত রাশিয়া। এছাড়া রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র বেলারুশ ও কানাডা থেকে প্রতি বছর ৭.৫ লাখ টন এমওপি আমদানি করে বাংলাদেশ, যার বড় অংশই আসে রাশিয়া থেকে। অল্প পরিমাণ সার আসে কানাডা থেকে।
অন্যদিকে ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট যা ডিএপি নামে পরিচিত, সারের বেশিরভাগই আমদানি হয় চীন থেকে। এছাড়া জর্ডান থেকে সার আমদানি করে বেসরকারি খাত। সৌদি আরব ও মরক্কো থেকেও আসে এ সার। ইউরিয়া সার আমদানি করা হয় চীন, কাতার, আরব আমিরাত, সৌদি আরব থেকে।
টিএসপি বা ট্রিপল সুপারফসফেট নামে পরিচিত এই সারটি বিএডিসি আমদানি করে তিউনেশিয়া ও মরক্কো থেকে। বেসরকারি খাত মরক্কো ও বুলগেরিয়া থেকে এই সার আমদানি করে।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ)-এর তথ্য বলছে, চলতি বোরো মৌসুম ও আগামী আমন মৌসুমের জন্য যে পরিমাণ সার প্রয়োজন তা দেশে মজুদ রয়েছে। পরবর্তী বছরের জন্য সরকার সারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবে এপ্রিল-মে মাসের দিকে। আগামী বছর সারে ভর্তুকি পরিস্থিতি কেমন হবে তা ওই সময়ের আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে ।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সচিব রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, "আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দ্বিগুণ-তিনগুণ দামের কারণে আমরা এমনিতেই চাপে আছি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব দীর্ঘায়িত হলে সেটা আরও সংকট তৈরি করবে।"
তিনি বলেন, "রাশিয়া, বুলগেরিয়া থেকে মূলত এমওপি সারের অধিকাংশই আমদানি করাস হয়। এসব দেশে সমস্যা হলে পরবর্তীতে কানাডার ওপর নির্ভরতা তৈরি হবে।"
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, কোভিড পরিস্থিতির প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সারের দাম গতবছরের তুলনায় বেড়ে তিনগুণ হয়েছে। প্রতিবছর এ খাতে যেখানে ৭ হাজার থেকে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়, তা এবার বেড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সারে ভর্তুকি বাবদ ৯,১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
গত অর্থবছরে প্রতি কেজি সারের আমদানি ব্যয় ছিল ইউরিয়া সারের ৩২ টাকা, টিএসপি ৩৩ টাকা, এমওপি ২৩ টাকা, ডিএপি ৩৭ টাকা, যা চলতি অর্থবছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯৬ টাকা, ৭০ টাকা, ৫৪ টাকা এবং ৯৩ টাকা করে। অথচ প্রতি কেজি সার কৃষককে দেওয়া হচ্ছে ইউরিয়া ১৬ টাকায়, টিএসপি ২২ টাকায়, এমওপি ১৫ টাকায়, ডিএপি ১৬ টাকা করে।