চীনের গ্লাস প্রস্তুতকারক জায়ান্ট বাংলাদেশে ২০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে চায়
বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ইন্টিগ্রেটেড গ্লাস প্রস্তুতকারক এবং চীনের ষষ্ঠ বৃহৎ শিল্প গ্রুপ- শিনই গ্লাস হোল্ডিংস লিমিটেড বাংলাদেশে ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বিষয়টি জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামানের সাথে সাম্প্রতিক এক বৈঠকে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন শিনই'র ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ডেভেলপমেন্টের প্রধান চেং গাং। গ্লাস প্রস্তুতকারকটি কোনো বন্দরের কাছাকাছি বা সমুদ্র উপকূলে কারখানা স্থাপনের জন্য ৬৫ একর জমি চেয়েছে। কারখানার বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা হবে ৩৮ হাজার টন ফ্লোটিং গ্রাস।
এই বিনিয়োগের ফলে বার্ষিক আয় হবে ৯৫ মিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি তা স্থানীয় ৪০০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রদূত।
মাহবুব উজ জামান লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে থাকা সুযোগ-সুবিধার সাথে শিনই'র চাহিদামাফিক জমি ও অন্যান্য দরকারের মিল রয়েছে। বৈশ্বিক ফ্লোটিং গ্লাস বাজারে শিনই সবচেয়ে বড় সরবরাহক। তাদের মোট বাজার মূলধন ১ হাজার কোটি ডলার এবং বার্ষিক আয় ১৮০ কোটি ডলার।
বিনিয়োগের বিষয়ে গ্রুপটির জিজ্ঞাসাগুলোকে (চাহিদা) এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) কাছে পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, তিনি শিনই'র বিনিয়োগ প্রস্তাব ও চাহিদাগুলো পেয়েছেন। এবিষয়ে তিনি বেপজা এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যানদের সাথে আলোচনাও করেছেন।
তিনি বলেন, "শিনই'র চাহিদাগুলোর বিষয়ে বেপজা চেয়ারম্যান বলেছেন, মিরসরাই ইপিজেডের প্লটগুলো ছোট। তাই তারা বেশকিছু প্লট একত্র করে কোম্পানিটির জন্য দরকারি জমি বরাদ্দের চেষ্টা করবেন।"
বিডার প্রধান নির্বাহী আরও বলেন, "মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে বেজার অনেক জমি আছে। এছাড়া মাতারবাড়ীতেও বিপুল জমি আছে। কোম্পানিটির চাহিদা অনুযায়ী সেখানে তাদের জমি বরাদ্দ দেওয়া যাবে।
চীনা ফার্মটি তাদের বিনিয়োগের জন্য দরকারি নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে কিনা জানতে চেয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে একটি লিখিত অনুসন্ধানী প্রশ্নমালা জমা দিয়েছে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের যেসব অগ্রাধিকারমূলক নীতি সহায়তা রয়েছে—সে সম্পর্কেও জানতে চেয়েছে শিনই গ্লাস হোল্ডিংস।
১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত শিনই গ্রুপ চীনের স্থানীয় বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১২টি বড় উৎপাদন কেন্দ্র পরিচালনা করছে বলে জানিয়েছে দেশটিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস। গ্রুপটি মালয়েশিয়ায় এরমধ্যেই ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।
কারখানার জন্য দরকারি অবকাঠামোর বিষয়ে কোম্পানিটি বলেছে, তাদের বার্ষিক ১৫ কোটি কিউবিক মিটার প্রাকৃতিক গ্যাস প্রয়োজন হবে। আর চাই ২০-২৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার ডুয়েল পাওয়ার সার্কেল। এরমধ্যে একটি হবে নিয়মিত, অন্যটি ব্যাকআপ হিসেবে প্রয়োজন। আর বার্ষিক পানি ব্যবহারের চাহিদা ১২ লাখ টন।
গ্লাস প্রস্তুতের সিলিকা বালুকে তাদের প্রধান কাঁচামাল উল্লেখ করে কোম্পানিটি বলেছে, বছরে তাদের প্রায় ৫ লাখ টন সিলিকা বালুর প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশে এমন বালুর খনি আছে কিনা সেটাও তারা জানতে চেয়েছে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন, "গ্রুপটির জেনারেল ম্যানেজার আমাকে বলেছেন, তাদের পণ্য বিশ্বের ১৫০টি দেশের ক্রেতা ও অংশীদারদের চাহিদা পূরণ করছে।"
স্থানীয় গ্লাস প্রস্তুতকারকরাও ভালো করছেন:
এককালে সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর হলেও, বাংলাদেশ এখন গ্লাস রপ্তানি করছে। স্থানীয় অবকাঠামো নির্মাণ কাজে দরকারি ফ্লোটিং গ্লাস সরবরাহ করছে স্থানীয় প্রস্তুতকারকেরা।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২০ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ লাখ ডলার হলেও এসময়ে ৩৫ লাখ ডলারের গ্লাস ও গ্লাসওয়্যার রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে বেড়েছিল ১৪৪.৭৬ শতাংশ।
এদিকে দেশে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প বাড়ায় প্রতিবছর গড়ে ৮-১০ শতাংশ হারে বাড়ছে দেশের গ্লাস শিল্প। স্থানীয় কোম্পানিগুলোই চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ পূরণ করছে বলে জানিয়েছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
দেশে গ্লাসের বার্ষিক চাহিদা ২৫ কোটি বর্গফুট। সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ৩২ কোটি বর্গফুট।
দেশে গ্লাস শিল্পের বর্তমান আকার প্রায় ১,৫০০- ২,০০০ কোটি টাকা।
পিএইচপি ফ্যামিলি ও নাসির গ্রুপ যথাক্রমে ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বাণিজ্যিক ভবনে ব্যবহৃত ফ্লোট গ্লাস উৎপাদনে বিনিয়োগ করে। স্থানীয় বাজারে তাদেরই আধিপত্য, মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ এ দুটি কোম্পানি মেটায়, বাকি ৩০ শতাংশ অন্যরা।
পিএইচপি ফ্যামিলির ভাইস-চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোহসিন টিবিএসকে জানান, অবকাঠামো উন্নয়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে গ্লাসের চাহিদাও বাড়ছে। গত কয়েক বছরে গ্লাসের চাহিদা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে, আর সেজন্য তারা বাজারে নতুন পণ্যও আনছেন।
"এই খাত সম্ভাবনাময়, ভবিষ্যতে এ খাতের প্রবৃদ্ধি চলমান থাকবে।"
দেশের শীর্ষ গ্লাস প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো হলো: পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ, নাসির গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ, এমইবি শিট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ, এবি গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি। এরমধ্যে অপেক্ষাকৃত পুরোনো দুটি প্রতিষ্ঠান হলো- এমইবি আর উসমানিয়া।