‘পশ্চিমা দুনিয়া রাশিয়াকে বুঝতে ভুল করেছে, চীনের ক্ষেত্রে একই ভুল করলে চরম মাশুল দিতে হবে’
পশ্চিমাদের সাথে রাশিয়ার যে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা হয়তো চীনের সাথে আরও বৃহত্তর অর্থনৈতিক যুদ্ধেরই প্রারম্ভ। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পেট্রোলিয়াম রপ্তানি নির্ভর রাশিয়া নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর উল্লেখযোগ্য আঘাত হেনেছে, কিন্তু চীন আরও মারাত্মক আঘাত হানতে পারবে। চীন ও রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদী অর্থ দাঁড়াবে—বৈশ্বিক সমৃদ্ধিকে ধ্বংস করা এবং দুই শিবিরে বিভক্ত করার নামান্তর। যার একদিকে থাকবে- পশ্চিমা দুনিয়া নির্ভর ব্যবস্থা; আরেকদিকে চীন-রাশিয়া ও তাদের সমর্থনপুষ্ট রাষ্ট্রগুলো।
ইউক্রেনে পুতিনের ন্যাক্কার আগ্রাসনকে কোনো অযুহাতে মেনে নেওয়া যায় না। কিন্ত, একইসঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বকে রাশিয়াকে সামলানোর ক্ষেত্রে তাদের কৌশলগত ভুলগুলি উপলদ্ধি করতে হবে। যে ভুলের পরিণতিতে ইউরোপে মস্কোর সাথে যৌথ নিরাপত্তার কাঠামো ধসে পড়ে এবং তারই ফলস্বরূপ পুতিন প্রশাসনের মনে ক্ষোভের বাষ্প জমতে থাকে, আজ যার পরিণাম দেখছে বিশ্ববাসী।
পশ্চিমা দুনিয়া কি অস্বীকার করতে পারে—ন্যাটোর পূবমুখী বিস্তার নিয়ে রাশিয়ার দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ-আপত্তি জানালেও তারা বধির হয়ে থেকেছে।
পূর্ব ইউরোপে পশ্চিমা সাংস্কৃতিক বলয় বিস্তার নিয়েও মস্কোর ক্ষোভ ছিল প্রকাশ্য। তারপর, রাশিয়া বিরোধী রাজনীতি প্রতিষ্ঠা ছিল ক্রেমলিনের ধৈর্যের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার শামিল।
বধির আমেরিকা ও তার পশ্চিম ইউরোপিয় মিত্ররা কিন্তু তাতে মোটেও গুরুত্ব দেয়নি। এর পেছনে কাজ করেছে তাদের রুশ নীতির তিনটি ভুল অনুমান। প্রথমত; তারা ধরেই নিয়েছিল বৈশ্বিক মুক্তবাজার অর্থনীতির অংশ হওয়ায় রাশিয়ায় পশ্চিমাকরণ ঘটবে, পুতিনের শাসকগোষ্ঠী উদার গণতন্ত্রের নিশ্চিত পথে সামান্য বিচ্যুতি মাত্র। দ্বিতীয়ত; রাশিয়ায় স্বৈরাচারী শাসনের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য তার আগের আবেদন, অবস্থান সব হারিয়ে পতনের খাদের তলদেশে পৌঁছেছে। আর সবশেষ অনুমান ছিল; পশ্চিমা কস্মোপলিটানিজম (বিশ্ব নাগরিকতাবাদ)- এর আবেদন রুশ জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক আবেদনকে মলিন করে তুলবে।
আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী অ্যারন এল. ফ্রিডবার্গ তার লেখা নতুন একটি বইয়ে যা লিখেছেন, সেসব আজকের ইউক্রেন যুদ্ধের আলোকে পড়তে গেলে শিহরিত হতে হয়। 'গেটিং চায়না রং' বা 'চীনকে ভুল বোঝার পরিণতি' শীর্ষক ওই বইয়ে লেখক যুক্তি দিচ্ছেন, রাশিয়ার মতো চীনের প্রতিও পশ্চিমা দুনিয়ার নীতি তিনটি ভুল অনুমান দ্বারা চালিত।
ফ্রিডবার্গ আমাদের জানাচ্ছেন, প্রকৃত চীনকে বুঝতে মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের গড়িমসি থাকলেও, তারা বেশ দেরি করেই এখন তা উপলদ্ধি করছেন। কিন্তু, ইউরোপিয়রা সে উপলদ্ধি সম্পর্কে আরও বেশি উদাসীন।
ইউরোপের অনেক অগ্রণী চিন্তাবিদ প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কট্টর জাতীয়তাবাদী নীতিকে সাময়িক পথচ্যুতি বা 'বন্ধু-শত্রু' (ফ্রেনেমি) ধাঁচের সম্পর্কের একটি দিকই ভাবেন। ফ্রিডবার্গ অবশ্য বিস্তৃত উদাহরণ দিয়েই দেখিয়েছেন, চীনের পররাষ্ট্রনীতি ও আচরণের এ শিকড় অনেক গভীরে।
পশ্চিমা অর্থনৈতিক চর্চা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ চীন বাছবিচার না করেই গ্রহণ করবে- এমন ধারণা থেকেই সমাজতন্ত্রী দেশটিকে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে গ্রহণ করে পশ্চিমা দুনিয়া। তাদের আশা ছিল, চীনা শাসকগোষ্ঠী বাজার অর্থনীতির প্রলোভনে মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট আদর্শ পরিত্যাগ করবে এবং পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রিত আর্থিক ব্যবস্থার নিয়মনীতি কৃতজ্ঞচিত্তে মেনে চলবে। এক পর্যায়ে চীনা জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে, যা থেকে রাজনীতিতে উদারবাদের সূচনা হবে; কারণ উঠতি মধ্যবিত্ত ও সম্পন্ন শ্রেণি চাইবে আরও বেশি গণতান্ত্রিক অধিকার।
কিন্তু, হয়েছে ঠিক উল্টোটাই। গত ২০ বছরে নিজেদের ক্ষমতা সুসংহত করতে পশ্চিমা দুনিয়ার অস্ত্রকে তাদের দিকেই তাক করেছে চীনা সমাজতান্ত্রিক দল (সিসিপি)। মুক্ত পুঁজিবাদকে রূপ দিয়েছে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদে। দলীয় সিদ্ধান্তে চালিত হচ্ছে দেশটির বৃহৎ সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও কোম্পানি। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট বিপ্লবকে কাজে লাগিয়ে চীনকে পরিণত করেছে নজরদারি রাষ্ট্রে।
স্থানীয় উদ্ভাবনের একটি ব্যবস্থাও তৈরি করেছে চীন, যা তাকে বেশকিছু প্রযুক্তিগত দিকে এগিয়ে রেখেছে। ৫জি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি যারমধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শি জিনপিং ঘনিষ্ঠরা বৈশ্বিক আধিপত্যের ইঙ্গিতও দিচ্ছেন।
বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে এখন দ্বৈত এক কৌশল নিয়েছে চীন। প্রথমত বিশ্বব্যাংকের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থার কাঠামো সংস্কারের দাবি তুলে সেখানে নিজ প্রভাব বৃদ্ধি করতে চাইছে। আরেকদিকে, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) এর মতো চীন নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশকে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। তাতে দিন দিন ভূ-রাজনৈতিকে নতুন রূপদানে চীন সরকারের সক্ষমতা দিন দিন বাড়ছে।
অথচ একইসাথে লাখ লাখ উইঘুর মুসলমানকে বন্দী রেখে উদারনৈতিক মূল্যবোধকে করছে পদদলিত। হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকেও কঠোরহস্তে দমন করা হয়েছে।
ফ্রিডবার্গ বলছেন, "১৯৮৯ সালের তিয়ানমেন স্কয়ার হত্যাযজ্ঞের চেয়ে বেশি নিপীড়নমূলক হয়েছে আজকের চীন। মতান্তরে, একে ১৯৬০ সালের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর সবচেয়ে বেশি বলাও যেতে পারে।"
প্রশ্ন রাখা যেতে পারে, মুক্তবাজার অর্থনীতির উদারনৈতিক ভিশন কোথায় হারালো? শুধু শি জিনপিংকে দোষ দিয়েই কী সঠিক উত্তর দেওয়া যায়?
আসলে চীন চিরকালই পুরোনো শাসন ব্যবস্থার ঐতিহ্য রক্ষাকারী গোষ্ঠী ও উদারনৈতিক সংস্কারপন্থীদের যুদ্ধের ময়দান ছিল। সমাজতন্ত্রের প্রতি অনুগত শি পুতিনের মতোই উদারবাদের শ্বাসরুদ্ধ করেছেন। তারা দুজনেই নিজেদের হাতে ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করেছেন, দমন করে চলেছেন বিরোধীমত।
শি জিনপিংকে গড়ে তোলা দ্বিতীয় শক্তি দেশজ সংস্কৃতি-কৃষ্টির গৌরব। একদিকে গৌরব অন্যদিকে বঞ্চণার পুঞ্জিভূত ক্ষোভ। নিঃসন্দেহে চীন বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতার একটি। চীন যখন কনফুশিয়াসের জ্ঞানকে গ্রহণ করে, ইউরোপে তখন চলছিল বর্বর শাসকদের রাজত্ব। অথচ সেই চীনকেই একসময় ইউরোপের বড় শক্তিগুলোর হাতে শোষণ- বঞ্চণার শিকার হতে হয়েছে।
চীনা জাতির সে অপমানের প্রতিশোধ স্পৃহাও হয়তো আজকের চীনা শাসকগোষ্ঠীকে তাড়া করে ফিরছে। মাও সেতুং অতিতকে মুছে ফেলার উদ্যোগ নিলেও, তার উত্তরসুরিরা চাইছেন আফিম যুদ্ধের পর শুরু হওয়া চীনের 'অপমানের শতকের' উপযুক্ত বদলা। যা পূরণ হবে হংকং ও তাইওয়ানকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে।
একইভাবে পুতিনের শাসকগোষ্ঠীও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে দেখে। তারপরের দুই দশকে রাশিয়ার অপমান তাদের বুকে শেলের মতো বিঁধেছে। পুতিন একটি প্রতীক মাত্র, রুশ জাতির আধিপত্য ও স্নায়ুযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রাণপুরুষ হয়ে উঠেছেন তিনি। আর সেজন্যই তিনি মাতৃভূমি রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনকে গায়ের জোরে জুরতে চান। এজন্য তিনি কঠিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার চাপ সহ্য করতেও প্রস্তুত। পশ্চিমা দুনিয়ার জেনে রাখা উচিৎ, তাইওয়ান দখলের ক্ষেত্রেও একইরকম ত্যাগ স্বীকার প্রস্তুত শি জিনপিং।
পশ্চিমা বিশ্বের জন্য পুতিনের রাশিয়ার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী প্রতিপক্ষ শি জিনপিংয়ের চীন। দেশটির অর্থনীতি রাশিয়ার চেয়ে ১০ গুণ বড়। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে ২৫-৩০ শতাংশ।
পুতিনের অভিজাততন্ত্রের চেয়ে বেশি চতুর ও দক্ষ শি জিনপিংয়ের সমাজতন্ত্রী দল। সেকারণেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলেও, চীন কেবল টিকেই যায়নি—একইসাথে নবশক্তিতে বিশ্বস্তরে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। চীনের শক্তি আরও বহুমুখী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। ফ্রিডম্যানের পরামর্শ আগ্রাসী নয়, বরং পশ্চিমাদের উচিৎ নিজস্ব মূল্যবোধে বিশ্বাসী অঞ্চলগুলো রক্ষা করার মাধ্যমে চীনকে মোকাবিলা করা।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ অবলম্বনে অনূদিত ও পরিমার্জিত