স্বাধীনতা পদক আমলামুক্ত করা কতখানি জরুরি!
কবি মো. আমির হামজা (ছেলে আছাদুজ্জামান এর তত্ত্বাবধানে ছাপানো কবিতার বইয়ে এই নাম আছে), এই নাম দুদফা আলোচনায় এলো। প্রথমবার হুট করে ২০২২ এর স্বাধীনতা পদক পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়ে, আর সর্ব শেষ পদক হারিয়ে।
একজন লোক পালাকার, গান লিখতেন, গান গাইতেন, এলাকায় কবিয়াল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মানুষ তার গান শুনেছেন। তার ছেলে বাবার লেখা গান-কবিতা একত্র করে পুস্তক আকারে প্রকাশ করেছেন, খুবই ভালো কথা-এ পর্যন্ত তো সব ঠিকই ছিল। কিন্তু পুত্রের বাবাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার খায়েশ কেন জাগলো? নিজের গৌরব বাড়ানো, না বাবার? কিন্তু শেষ রক্ষা কি হলো? তার এই লোভ, অনাচার স্বাধীনতা পুরস্কারকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল ভেবে দেখেছেন?
স্বাধীনতা পুরস্কার ও পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়া নিয়ে এখন প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে। এটা গুরূত্ব দিয়ে ভাবতে হবে সরকারকে। আমলা কমিটি বাদ দিয়ে যোগ্যতর একটা প্রক্রিয়া বেছে নেওয়া হোক। বিশ্বে অনেক বড় বড় পুরস্কার উদাহরণ রয়েছে। নোবেল পুরস্কার কিভাবে দেওয়া হয়? কোনো আমলার সুপারিশে না। ঘরের কাছে ভারতেও রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেকগুলো সম্মানজনক পুরস্কার আছে, সেগুলো কিভাবে নির্ধারণ করা হয়? দেশেও বেশ কিছু সংগঠন পুরস্কার দেয়, বাংলা একাডেমি দেয়। একটা গ্রহণযোগ্য উপায়ে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। খোঁজখবর করে এই আমলা কমিটি কতৃর্ক পুরস্কার দেওয়া এখনই বন্ধ হোক।
নয়তো এরকম ফি বছর ঘটতে থাকবে। এ বছর আমির হামজার ছেলে আছাদুজ্জামান পদক কমিটিকে প্রভাবিত করেছেন, পরের বছরও আরেক আমলা তার বাবা/শ্বশুরকে পুরস্কৃত করতে চাইলে ঠেকাবেন কিভাবে? আছাদুজ্জামান পদক কমিটিকে প্রভাবিত করে অপরাধ করেছেন, কিন্তু কমিটির আর যারা অর্বাচীনের মতো প্রভাবিত হয়ে রাষ্ট্রেরর সর্বোচ্চ পুরস্কারটি সাহিত্য পরিমণ্ডলে একেবারে অজ্ঞাত, লেখালেখি বা কোনো সাহিত্যকর্ম দিয়েই পাঠককূলের কাছে হাজির নেই, হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি এমন একজনকে পুরস্কৃত করে বসলেন, তারাও কি সমান অপরাধী না?
হাস্যকরভাবে হিন্দি ফিল্ম 'শোলে'র সেই বিখ্যাত ডায়ালগটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে: এখানে উল্লেখ না করে পারছি না! ' আবে তেরা কেয়া হোগারে কালিয়া? তোর কি হবেরে কালিয়ায়! কিছুই হবে না। সাতসতের না ভেবেই বলা যায়। এবারই তো প্রথম নয়! ২০২০ সালেও রইজ উদ্দীন নামে একজনকে এভাবে পুরস্কৃত করে, একই ঘটনার অবতারণা করা হয়েছিল। সেবারও পুরস্কার দিয়ে তা আবার গিলে ফেলতে হয়েছে, মানে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনাতেও আমাদের শিক্ষা হয়নি। আমলা কমিটি, কুশীলব, পুরস্কার নির্বাচন পদ্ধতি কোনো কিছুরই হেরফের হয়নি।
আমির হামজার পুত্র একটি বিষয়ে সফল হয়েছেন। তার প্রয়াত পিতার নাম দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। পত্রিকা, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সবাই তার বাবার নাম জেনে গেছেন।
আমির হামজা মারা গিয়েছেন বছর তিনেক আগে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনী চরিত্রের মতো বলতে হয় ছেলের কল্যাণে তিনি -'… প্রমাণ করিলেন যে তিনি একদা সাহিত্য করিতেন, সাহিত্যিক বা কবি ছিলেন। আমির হামজার এই কবি পরিচয় কীভাবে জানাজানি হলো ,তার একটা উপাদেয় এবং সরস উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। একজন পাঠক তার পুরস্কার পাওয়ার খবর শুনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন:
'মানুষ হিসেবে আমার ব্যর্থতা কম নয়। বহুদিন ধরে আমি পরের সাথে আছি! মধ্যযুগের কবি আমির হামজা সম্পর্কে জানি সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ জন্মানোর বহুদিন পর। ওয়াজকারী আমির হামজা সম্পর্কে জানি ওর গ্রেপ্তারের ঘটনার পর। উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা সম্পর্কে জেনেছিলাম এক নৌ দুর্ঘটনার পর! ক্রিকেটার আমির হামজাকে চিনেছিলাম আফগানিস্তান ক্রিকেট দল বাংলাদেশে আসার পর। আর সাহিত্যিক আমির হামজা সম্পর্কে জানলাম ১৫ মার্চ ২০২২ এ স্বাধীনতা পদক ঘোষণার পর…'
অদ্ভুত হলেও সত্যি হলো, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার স্বাধীনতা ও একুশে পদক দুটোই প্রদান করেন আমলা নির্ভর কমিটি। ভাবলে বিস্ময়ের সীমা থাকে না। আর অদ্ভুত এক প্রক্রিয়ায় এই পুরস্কার নির্ধারণ করা হয়। কেউ একজন কারো নাম প্রস্তাব করেন, কমিটির কেউ সেটা সমর্থন করেন। কমিটিতে থাকেন ১৩জন মন্ত্রী আর ১০ জন আমলা। এই এরাই ঠিক করে ফেলেন কাকে পুরস্কার দেবেন, কাকে বাদ দেবেন। আর সাহিত্যিক হিসেবে এরা রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের বাইরে বোধহয় আর কারোই নাম জানেন কিনা , এ নিয়েও অনেকে সন্দেহ পোষণ করেন। কাজেই সুপারিশকৃত নামরে বাইরে বাকি সব সব নাম, নামের মানুষের কীর্তি নিয়ে তারা অন্ধকারে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। অথচ তারা একটু খোঁজ খবর করলে, তাদের জন্য সেটা খুব বেশি ক্লেশকর হওয়ার কথা না। সরকারি অন্য অনেক ক্ষেত্রে এই খোজঁখবর নেওয়ার রীতি ঘোরতরভাবে চালু আছে। এখানে এসেই কেন তার আর দরকার নেই। এটাও বিস্ময় জাগানিয়া একটা প্রশ্ন।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বা বাংলাদেশ সামরিক, নৌ ও বিমান বাহিনীর চাকরিতে নিয়োগ দেবার আগে বিশদ খোঁজখবর করা হয়। এই খোঁজখবর কোন পর্যায়ে কতটা ব্যাপকতর সে আলোচনায় আর না যাই।
আসলে বহু আগেই সরকারি তরফে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ছিল। রাষ্ট্রের এ্ সর্বোচ্চ পুরস্কারটি দেওয়ার ক্ষেত্রে আরো যত্নবান হওয়া উচিত ছিল আগেই। এর সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্পিরিট জড়িয়ে আছে। গুটিকয় আমলার বৈঠকের মধ্যে দিয়ে এ পুরস্কার নির্ধারিত হতে পারে না, তারা এই পুরস্কার প্রদানের যোগ্যতাও রাখে না। দিনে দিনে তাদের ব্যর্থতা চরম এবং উৎকট হয়ে উঠছে।
শুধু রইজ উদীনের উদাহরণ টেনেই বলা যায়, ২০ সালের এই ঘটনার পর পরই সরকারের সর্বোচ্চ মহলের উচিত ছিল এই কমিটির খোলনলচে পাল্টে ফেলা। সাহিত্য পুরস্কার দেবেন কয়েকজন আমলা, যাদের সাহিত্য ও দেশের সাহিত্যজগত নিয়ে পরিস্কার কোনো ধারণা নেই। গ্রহণযোগ্য পুরস্কার খুব দুরূহ নয়। দেশের সাহিতাঙ্গন থেকে যোগ্য লোক অন্তর্ভুক্ত করা না হলে এরকম ঘটনা এড়ানো যাবে। নিদেনপক্ষে বাংলা একাডেমিকেও সংযুক্ত করা যায়, মন্দের ভালো হিসেবে।
এ বিষয়ে এখনই নজর না দিলে প্রতিবছরই এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
আমির আমজা পুরস্কৃত হয়েছেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে সাহিত্য রচনা করে পুরস্কৃত হওয়ার গৌরব অনেক। সাহিত্যমান ঠিক থাকলে এ পুরস্কার নিয়ে কোনো বিতর্ক করার কিছু ছিল না, আমির হামজার নাম সবাইকে জানতে হবে এমনও না। কিন্তু তার সাহিত্যকর্ম যদি পাঠকের কাছে মানসম্পন্ন না হয়, প্রশ্ন ওঠে তখনই। এবং একজন কবির পরিচয় তিনি খুনের মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামী, এটা বোধহয় কখনই কারো কাম্য না।
সাহিত্যে যারা পুরস্কার পান তাদের সৃষ্টিকর্মের সাথে পরিচিত হতে চান সাধারণ মানুষ, পাঠক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্যজন বলেছেন, এ বছর শাহ আবদুল করিম যেন স্বাধীনতা পুরস্কার পান সেই চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু আমলাদের তরফ থেকে তার পক্ষে কোনো সুপারিশ সমর্থন জোটেনি।
- লেখক: রম্য লেখক