নতুন নীতিমালায় জোর সমর্থন পেতে চলেছে আমদানি-বিকল্প শিল্প
বিভিন্ন পণ্য ও কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় কমাতে আমদানি-বিকল্প শিল্পের জন্য মূলধনী বিনিয়োগে ভর্তুকি দিতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২-এর একটি খসড়া সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর (স্টেকহোল্ডার) মতামতের অপেক্ষায় রয়েছে। এতে চলতি মূলধনের সুদে ভর্তুকির পাশাপাশি কর অবকাশ এবং ভ্যাট অব্যাহতিরও প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অবহিত অভ্যন্তরীণ সূত্রের মতে, পোশাক, ওষুধ এবং দ্রুত ভোগ্য পণ্যসহ (এফএমসিজি) বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল, সম্পূর্ণ প্রস্তুতকৃত পণ্য এবং খাদ্যপণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ গত বছর ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে।
তারা বলছেন, আমদানি-নির্ভরতা কমাতে স্থানীয়ভাবে এসব পণ্য উৎপাদনে শিল্প স্থাপনে- উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যেই খসড়া নীতিমালাটি তৈরি করা হয়েছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নীতি, আইন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা) শেখ ফয়েজুল আমীন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা একটি উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়ে আমদানি-নির্ভরতা থেকে দূরে সরে যেতে চাই। এ কারণে সরকার আমদানি-নির্ভর শিল্পের জন্য বিশেষ সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।"
তিনি জানান, এসব শিল্পকে দুই ধরনের সহায়তা দেয়া হতে পারে। প্রথমত বিনিয়োগের সময় মূলধনের ওপর ভিত্তি করে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ সহায়তা। দ্বিতীয়ত প্রণোদনা হিসাবে কর, ভ্যাটে ছাড়।"
"নীতিমালাটি খসড়া আকারে প্রকাশ করে স্টেকহোল্ডারদের মতামতের জন্য অপেক্ষায় রেখেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। পরে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে", যোগ করেন তিনি।
পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয় হলেও এ খাতের উদ্যোক্তারা মূলধনী যন্ত্রপাতি পেতে আমদানির ওপরই নির্ভরশীল। তার ওপর বাংলাদেশের আমদানি ব্যয়ের ১৩ শতাংশ বা প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা শুধুমাত্র তুলা আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে।
শেখ ফয়েজুল আমীন বলেন, নতুন নীতিমালার লক্ষ্য হচ্ছে এ ধরনের আমদানি নিরুৎসাহিতকরণ এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি উৎপাদনের বিকল্প শিল্প স্থাপন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, সরকার ওষুধের কাঁচামাল, অটোমোবাইল খুচরা যন্ত্রাংশ এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি উৎপাদনের জন্য নীতিগত সহায়তা বিবেচনা করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, বর্তমানে সরকার শুধু রপ্তানি পণ্যে ভর্তুকি দিচ্ছে। এছাড়াও, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ওষুধ, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, জৈবপ্রযুক্তি, জৈব-সার, কীটনাশক ইত্যাদির মতো ৩৬টি খাতে ১০০ শতাংশ কর অবকাশসহ বিভিন্ন প্রণোদনা রয়েছে। ইলেকট্রনিক্স, হোম অ্যাপ্লায়েন্স ও অটোমোবাইলসহ বেশ কয়েকটি শিল্প ভ্যাট ছাড়ও পাচ্ছে।
প্রস্তাবিত নীতিমালা চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হলে, আমদানি-বিকল্প উৎপাদন খাতগুলো প্রথমবারের মতো প্রণোদনার পাশাপাশি সরকারি ভর্তুকির আওতায় আসতে পারে।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন নীতিমালায় আমদানি-বিকল্প উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল আমদানিতে কর ও শুল্ক সুবিধা যৌক্তিক করা হবে। এটি গ্রামীণ ক্ষুদ্র শিল্প, কৃষিপণ্য, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, ইকো-পণ্য এবং দুগ্ধ শিল্পের জন্য মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হ্রাস করার কথাও বিবেচনা করবে।
হস্তশিল্প ও কুটির শিল্পের জন্য বিদ্যমান কর অব্যাহতি সুবিধা অব্যাহত থাকবে। একই সময়ে, এই সুবিধাটি পেতে এই শিল্পগুলিতে মূলধন বিনিয়োগের পরিমাণ এবং বার্ষিক টার্নওভারের সীমা নির্ধারণ করা হবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, "তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সরকারি প্রণোদনার কারণেই এটি একটি বিরাট শিল্পে রূপ নিয়েছে। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, চামড়া ও কৃষিপণ্যসহ বেশ কয়েকটি খাতেও সম্ভাবনা বিপুল। এসব খাতে সরকার সহজ পলিসি করলে এবং প্রণোদনা দিলে বাংলাদেশ রপ্তানি পণ্যের উৎপাদন হাবে পরিণত হবে।"
দেশের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এলাকায় শিল্প স্থাপনের জন্য কর অবকাশ সুবিধা এবং অবচয় সুবিধা দেওয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়।
এতে রংপুর, ময়মনসিংহ ও বরিশাল বিভাগের সব জেলাসহ ৪৫টি জেলাকে অনগ্রসর এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাবনা, বগুড়া ও যশোর ছাড়া রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের জেলাগুলোকেও নীতিমালায় অনগ্রসর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঢাকা বিভাগের অনগ্রসর এলাকার মধ্যে রয়েছে কিশোরগঞ্জ, রাজবাড়ি, গোপালগঞ্জ, শরিয়তপুর, মাদারিপুর এবং ফরিদপুর। চট্টগ্রাম বিভাগের তিন পার্বত্য জেলা এবং সিলেট বিভাগের সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং হবিগঞ্জ জেলাকে অনগ্রসর জেলা বলা হয়েছে।
শেখ ফয়েজুল আমীন বলেন, "বিনিয়োগকারীদের তাদের প্রস্তাব শিল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। উদ্যোক্তাদের প্রস্তাব ও চাহিদা বিবেচনা করে, তাদের জন্য যে প্রণোদনা যৌক্তিক- তার ব্যবস্থা করবে মন্ত্রণালয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিস্ট সংস্থাগুলোর মাধ্যমে শিল্প উদ্যোক্তাদের এ প্রণোদনা দেওয়া হবে।"
নতুন নীতিমালার খসড়ায় অ্যাক্রিডিটেশন সার্টিফিকেট ফি বা চার্জ এবং বিমা স্কিমের প্রিমিয়ামের খরচ পুনঃব্যবহারের সুযোগও রাখা হয়েছে।
২০১৬ সালে জাতীয় শিল্প নীতি প্রণয়নের ছয় বছর পর শিল্প মন্ত্রণালয় নতুন নীতিমালাটি প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে।
খসড়া নীতিটি স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে।