সেই দুঃখিনী মার্চের বিউটি বোর্ডিং
গোলগাল চেহারার ভারী মানুষটি চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা পরে মোটা গদির চেয়ারে বসেছিলেন। বুঝলাম তিনিই হবেন সমর সাহা। প্রহ্লাদ সাহার ছেলে। তারক সাহার বড় ভাই। তারক সাহাকে দু একবার পথ চলতি দেখেছিলাম সূত্রাপুরে বাজার সারতে গিয়ে। কোঁকড়া চুলের মানুষটি হাসিখুশি ছিলেন। বিউটি বোর্ডিং চালাতেন। তিনিই উদ্যোগী হয়েছিলেন বোর্ডিংয়ের আড্ডা আবার ফিরিয়ে আনতে।
১৯৯৫ সাল থেকে দফায় দফায় বাংলাবাজারের ১ নম্বর শ্রীশ দাস লেন মানে বিউটি বোর্ডিংয়ে সুধী সমাবেশ হয়েছে। শিল্পী-সাহিত্যিদের দেওয়া হয়েছে সম্মাননা। স্মৃতির টানে আবার এখানে জড়ো হয়েছিলেন কবি শামসুর রাহমান, কবি সৈয়দ শামসুল হক, শিল্পী মুর্তজা বশীর, শিল্পী আমিনুল ইসলাম, আলোকচিত্রী বিজন সরকার, কবি বেলাল চৌধুরী, শিল্পী রফিকুন নবী, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং আরো অনেকে।
সেই তারক সাহা নাকি হঠাৎই স্ট্রোক করে বছর দুই হয় মারা গেছেন। শুনে মাথায় হাত। কিন্তু ভবিতব্য না মেনে উপায় কী! শেষে সমর বাবুই বিউটি বোডিংয়ের হাল ধরেছেন। তার অফিস ঘরে প্রহ্লাদ বাবুর দুটি ছবি (একটি হাতে আঁকা অন্যটি ফটোগ্রাফ) আছে।
পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় প্রহ্লাদ বাবু বিউটি বোর্ডিং প্রতিষ্ঠা করেন নিজের ভাতিজি বিউটির নামে। কবি শহীদ কাদরি থাকতে পাশের এক বাড়িতে। বলতে ভালোবাসতেন খুব তাই ডেকে ডেকে আনতেন বন্ধু ও অনুজদের। সকাল থেকে শুরু হতো আড্ডা আর চলতো রাত গভীর হওয়া পর্যন্ত। কত কত কবিতা পড়া হয়েছে, কত ভাবনা যে উঁকি দিয়ে চকিতে মিলায়েছে, কত গান যে ভেসেছে এখানে তার ইয়ত্তা নেই।
কবি শামসুর রাহমান যেমন লিখেছেন,
মনে পড়ে, একদা যেতাম
প্রত্যহ দুবেলা বাংলাবাজারের শীর্ণ গলির ভেতরে সেই
বিউটি বোর্ডিং-এ পরস্পর মুখ দেখার আশায়
আমরা ক'জন
তখন তুমুল সময়কে
দিয়েছি গড়িয়ে স্রেফ চায়ের বাটিতে,
কখনো জ্বলন্ত পুণ্য ঝোপের মতন
মাথা আর জঠরাগ্নি নিয়ে
পড়েছি কবিতা শাপভ্রষ্ট দেবতার স্বরে। কখনও জুটেছে
ফুল-চন্দনের ঘ্রাণ, কখনো-বা হুল বেশুমার।
সৈয়দ শামসুল হকের লেখার জন্য এখানে একটা টেবিল ছিল। ১৯৫৭ থেকে ৬২ পর্যন্ত তার সব লেখাই তৈরি হয়েছে বিউটি বোর্ডিংয়ে। বোর্ডিং হওয়ার আগে এখান থেকে নিয়মিত বেরুত 'সোনার বাংলা' নামক একটি পত্রিকা আর তাতেই কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল। শামসুল হক তখন থাকতেন লক্ষীবাজার; শামসুর রাহমান থাকতেন ইংলিশ রোডের ধারে; সাঁতারু ব্রজেন দাসও বেশি দূরে থাকতেন না; বিজন চৌধুরী থাকতেন মোহিনী মোহন দাস লেনে আর আড্ডাপ্রিয় কবি শহীদ কাদরি সবাইকেই তো দাওয়াত দিয়ে রেখেছিলেন। তখন শান্তি, মিনা বা কল্পনা নামে আরো বোর্ডিং ছিল, নারিন্দার ওদিকে সুইটি ক্যাফে ছিল। কিন্তু বিউটি বোডিংই বেশি জমে গিয়েছিল। এখানকার চা, চপ, কাটলেট জনপ্রিয় ছিল।
উদার প্রকৃতির আর সাহিত্য প্রিয় ছিলেন প্রহ্লাদ সাহা। বাকী খাওয়ারও সুযোগ ছিল ভালোরকমে। প্রহ্লাদ সাহার পৃষ্ঠপোষকতা আড্ডাটি জমে উঠতে সাহায্য করেছিল। আড্ডাবাজদের বাকীর খাতা ভারী হয়ে উঠলেও চাপাচাপি করতেন না। খালেদ চৌধুরী , মুশাররফ রসুল (বুড়োভাই) ছিলেন তখনকার খ্যাতিমান আড্ডাবাজ। শিল্পী-সাহিত্যিকরা তো বটেই, ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্রকর্মী, সমাজকর্মী সকলেই আসতেন এখানে। প্রথম সবাক বাংলা চলচ্চিত্র 'মুখ ও মুখোশের' চিত্রনাট্যও নাকি এখানে তৈরি হয়েছিল। ছাপ্পান্ন সালে এখান থেকেই বের হয় সাহিত্য সাময়িকী 'কবিকণ্ঠ'। সত্তর সালে যাদুশিল্পী জুয়েল আইচ বোর্ডিংয়ের ১০১ নম্বর ঘরটিতে এসে উঠেছিলেন। থেকেছেনও পুরো বছর। ভোর চারটায় উঠে তিনি বাঁশি রেওয়াজ করতেন।
আসলে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ঢাকার অনেক স্মৃতি তৈরি করেছে বিউটি বোর্ডিং। তারপর এলো একাত্তর। কবিতায় ফুসে উঠল আগুন, শিল্পীদের ক্যানভাসও বিক্ষুব্ধ। মার্চ মাস আরো তপ্ত। জয়ব্রত সরকার বলছিলেন, "বাবার (বিজন সরকার) তবু দুবেলা আড্ডা দেওয়া চাই। সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে ওই বিউটি বোর্ডিংয়ে চা খেয়ে তারপরই না ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অফিসে আর ফেরার পথেও বোর্ডিংয়ে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে ফেরা। ২৮ মার্চ যেদিন বিউটি বোর্ডিংয়ে কিলিং হলো সেদিনও বাবা আড্ডা দিতে বেরুতে চাইলেন। মা ঠেকিয়ে রাখল কিছুক্ষণ। শেষে এইসেই বলে রওনা দিলেন, চৌরঙ্গীর মোড়ে দাড়িয়েই আর্মি ভ্যান চোখে পড়ল, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ফিরলেন। মা সব শুনে বললেন, আরেকটু আগে বেরুলেই বুঝি আর ফিরতে পারতে না।"
২৪ মার্চ, ২০২২
এগারোটার কিছু পরে। বিউটি বোর্ডিংয়ের পকেট গেটটা দিয়ে ঢুকে পড়লাম। ডানদিকে একটি নারকেল গাছ আর ডালিম গাছ। সরু পথটির বাঁ ধারে বাগানমতো। সেখানে চারটি টেবিল বিছানো, মাথায় তাদের ছাতা। প্রতিটি টেবিল ঘিরে চারটি করে টেবিল। কোনো কোনো টেবিলে ততক্ষণে দু চারজন। সবাই বয়সে তরুণ। অফিসঘরটার দেয়াল হলুদ, খাবার হোটেলটির রংও তাই। পুরো বাড়িটারই আসলে রং একই। অফিস ঘরে পাখা চলছিল। শব্দ ছিল না কিছু। সমর দা কিছু একটা হিসাব মেলাচ্ছিলেন। এক বোর্ডার এসে ফেব্রুয়ারি মাসের পাওনা মেটালো। আমাকে বসতে বলে সমরদা আরো দুই তিন মিনিট ব্যস্ত থাকলেন।
তারপর বললেন, "আমি তখন (একাত্তর) ক্লাস ফোরে পড়ি। বয়স দশের বেশি হবে না। ২৮ মার্চ কারফিউ শিথিল ছিল সকাল ৮টা থেকে ১২টা। আগের রাতেই মামারা সবাই মিলে পরিকল্পনা করেছেন আমরা নদী পার হয়ে বিক্রমপুরের দিকে চলে যাবো। সকালে বাবা বললেন, স্টাফদের বেতন দেওয়া হয়নি, বোর্ডারও আছে কয়েকজন, একটু বোর্ডিং ঘুরে আসা দরকার। মা খুব রাজি ছিলেন না কিন্তু দেশের অবস্থা খারাপ, নদী পেরিয়ে গেলে আবার কবে ফেরা হবে ঠিক নেই তাই স্টাফদের খোজ নিয়ে আসা ভালো।"
"ওই পেছনেই ছিল কিছু বিহারী বসতি। তারা আগে থেকেই তক্কে তক্কে ছিল সুযোগ পেলে এক হাত দেখে নেবে কারণ জায়গাটায় প্রগতিশীলরা ভিড় করে। আমরা ভাড়া থাকতাম ২২ নম্বর নর্থব্রুক হল রোডে। বাবাকে (প্রহ্লাদ সাহা) রাস্তায় দেখে কয়েকজন এগিয়ে এসেছিল, চা-নাশতা খাওয়ার কথাও মনে পড়ে গিয়েছিল তাই ছোটখাটো একটা দল নিয়েই বাবা ঢুকেছিলেন বোর্ডিংয়ে। আর অল্প পরেই মিলিটারি ভ্যান এসে থামে সদর দরজায়। বাবাসহ মোট আঠারজনকে দাড় করায় লাইন ধরে। তারপর তাদের গাড়িতে তোলে এবং নিয়ে যায় কোনো অজানা জায়গায়। পাশের বাড়ি থেকে এক লোক পুরো ঘটনাটা দেখেছিলেন আর আমাদের জানিয়েছিলেন। এখন আমাদের আগের পরিকল্পনা মানে বিক্রমপুরের দিকে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হলো। মা (প্রতিভা সাহা) তো কোনোভাবেই বাবাকে ছাড়া যাবেন না। পরের দিন সারাদিনও ফিরলেন না বাবা। অগত্যা মামারা জোর করেই মাকে নিয়ে নদী পার হয়ে গেলেন। মায়ের তখন গর্ভাবস্থা," বলছিলেন তিনি।
সমর দা আরো বলছিলেন, "আমরা ২৭-২৮ দিন কেবল পথ চলেছি। মানুষ আমাদের চাউল মুড়ি দিয়েছে, রাতে থাকতেও দিয়েছে। একবার ডাকাত এসে সব কিছু লুটে নিয়ে গিয়েছিল। নদীতে লাশ ভাসতে দেখেছি। কী সব বিভৎস্য দিন যে গেছে। মায়ের কথা ভাবতে শিউড়ে উঠি আজো। যাহোক এক সময় আমরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা পৌঁছাই। এর মধ্যে মামারা কেউ কেউ ঢাকায় এসে বাবার খোঁজ খবর করেছেন কিন্তু কেউ বলতে পারেনি কিছু। বিউটি বোর্ডিং ষাটের দশকে একটা মিলনস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।"
"আমি শুনেছি, ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে কবরী সিনেমা করতে চট্টগ্রাম থেকে আসবেন ঢাকায়। কিন্তু থাকবেন কোথায়? তখন বিউটি বোর্ডিংয়ের কথাই মনে পড়েছিল তার অভিভাবকদের। পাটনা, লাহোর থেকেও এসে ব্যবসায়ীরা থাকত। মারোয়ারিদের জন্য আলাদা থালি। তাতে সব নিরামিষ পদ সাজানো থাকত। আমি জুয়েল আইচকে এখানে বাঁশি সাধনা করতে দেখেছি। বাবা তো সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। সবার জন্যই ছিল তার মায়া। ২৮ মার্চের ওই দিনও তিনি সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবী পরে বেড়িয়েছিলেন। তারপর তো আর তাকে দেখিনি। আমার বোন মিতা কোনোদিনই পিতার স্নেহ পায়নি। একাত্তরে বাবার বয়স চল্লিশও হয়নি।"
২৮ মার্চ ১৯৭১, স্থান বিউটি বোর্ডিং
২৫ মার্চের কালরাতের পরদিন সারাদিন ছিল কারফিউ। পরেরদিনটাও সেরকমই গেছে। ২৮ তারিখ সকালে কারফিউ শিথিল হয় কিছু সময়ের জন্য। তখন রণজিৎ পাল চৌধুরীর বাড়িতে এলো বন্ধু ধীরেন ভট্টাচার্য। বলল 'চল বিউটি বোর্ডিং'। তেমন দমবন্ধ পরিবেশে এমনই একটা কিছুর অপেক্ষায় ছিলেন রণজিৎ। পথে বেড়িয়ে তারা দেখলেন লোকজন ভীত সন্ত্রস্ত। সবাই চলেছে বুড়িগঙ্গা পার হতে। তারপর বেলা ১১টা নাগাদ যখন তারা জুবিলি স্কুলের কাছে তখন পরিচিত একজন জানতে চাইল, কোথায় যাও? উত্তরে বিউটির নাম বলার পর বন্ধুটির চোখেমুখে ভয়ের ছায়া দেখা গেল। সে-ই ইশারায় আর্মিদের গাড়ি দেখাল আর বলল, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। সেদিন ১৮ জনকে গাড়িতে তুলে নিয়েছিল পাকবাহিনী।
তাদের মধ্যে আর ফেরেননি যারা তাদের নাম প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা, ব্যবসায়ী সন্তোষ কুমার সাহা, প্রকাশক হেমন্ত কুমার সাহা, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব অহীন্দ্র চৌধুরী শংকর, বোডিংয়ের ম্যানেজার শীতল কুমার দাশ, শিক্ষক প্রভাত চন্দ্র সাহা, সমাজসেবক নির্মল রায় খোকাবাবু, চিত্রশিল্পী হারাধন বর্মণ, ব্যবসায়ী প্রেমলাল সাহা, ব্যবসায়ী কেশব দেও আগরওয়ালা, চলচ্চিত্রশিল্পী শামস ইরানী ও যোসেফ কোরায়া, পাচক অখিল চক্রবর্তী, বোর্ডিং কর্মচারী সুখ রঞ্জন দে, অতিথি ক্ষিতিষ চন্দ্র দে, এলাকাবাসী শহীদ নূর মোহাম্মদ মোল্লা এবং বোডিং কর্মচারী সাধন চন্দ্র রায়। এদের মধ্যে যোসেফ কোরায়ার পরিবার থাকত লক্ষীবাজারে। তার ছেলের নাম রুমি ছিল। ভালো গিটার বাজাত। নব্বই সালের দিকে আমেরিকা চলে গিয়েছিল রুমি, আর ফেরেনি। হারাধন বর্মণ ছিলেন মূলত প্রচ্ছদ শিল্পী। শামস ইরানী ছিলেন খলঅভিনেতা। 'আবার বনবাসে রুপবান' (১৯৬৬) এবং 'রাখাল বন্ধু' (১৯৬৮) ছবিতে অভিনয় করে তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন।
প্রতিভা সাহার স্মৃতিচারণ
পঁচিশ মার্চ রাতে ঘরে ঢুকে প্রহ্লাদ বাবু বললেন, 'শহরের অবস্থা খুব খারাপ। রাস্তায় পাক আর্মি নেমেছে। পথে আমাকে চেক করেছে। শুনে আমি তো ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম'।
২৬ মার্চ রাতেও ঘরে ফিরে বললেন, 'ঢাকায় থাকা নিরাপদ নয়। আমাদের দূরবর্তী কোথাও আশ্রয় নিতে হবে'।
সিদ্ধান্ত নিলেন আপাতত আমার ভাইয়ের বাসায় যাবেন। ২৭ মার্চ সকালে বাসা তালাবদ্ধ করে চলে যাই ভাইয়ের হৃষিকেশ দাস রোডের বাসায়। ২৮ মার্চ সকাল ৮টা থেকে কারফিউ শিথিল হলো। প্রহ্লাদবাবু স্টাফদের পাওনা মেটাতে আর বোর্ডিং তালাবদ্ধ করতে বিউটি বোর্ডিং রওনা হলেন। পথে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা। তাদের সঙ্গে নিয়েই ঢুকলেন। স্টাফ বোর্ডারদের ডেকে তাদের প্রয়োজন মিটিয়ে বিদায় দিলেন।
প্রহ্লাদবাবুকে বোর্ডিংয়ে দেখে বিহারীরা আর্মিদের খবর পাঠায়। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা চারদিকে থেকে ঘিরে ফেলে। উপস্থিত কাউকেই তারা রেহাই দেয়নি সেদিন। এ খবর বাসায় আসার পর সমর যে কোন ফাঁকে বোডিংয়ে চলে গিয়েছিল জানতে পারিনি। ও গিয়ে দেখে সব লণ্ডভণ্ড। পরে প্রতিবেশী এক ছেলে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল।
এরপর থেকে আমি তো দিশেহারা। যুদ্ধের ভয়াবহতাও বাড়ছিল। আমরা ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হই। বিক্রমপুরের অনেক গ্রামে পালিয়ে বেড়াতে থাকলাম। তারপর একসময় আগরতলা হয়ে চলে যাই পশ্চিমবঙ্গে। উঠি আমার ভাসুরের (নলিনী মোহন সাহা) বাসায়। কিন্তু আমার মন টিকছিল না। তারপর একসময় দেশ স্বাধীন হলো। ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে নিয়ে আমি দেশে ফিরি। বিউটি বোর্ডিংটা আর দেখার অবস্থায় ছিল না। দরজার পাল্লাও খুলে নিয়ে গিয়েছিল, তামা-কাসার বাসনকোসন যা ছিল কোনোটাই আর খুঁজে পাইনি।
মুক্তিযোদ্ধারা এসে পড়ে বোর্ডিংকে দখলমুক্ত করে। বঙ্গবন্ধু আমাকে ৫০০০ টাকা আর সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। আমার ভাসুর বোর্ডিংয়ের পুরোনো এক ম্যানেজারকে ঠিক করে দিয়ে গেলেন। বিমল নামের একজন বেয়ারাও এসে যোগ দিয়েছিল। বিউটিং বোর্ডিং আবার চালু করি। গুণীজনরা এলেন এক দুজন করে। তারককে স্কুলে দিলাম। এদিকে ঢাকা বড় হতে লাগল। আমাদের দিকটা হয়ে গেল পুরান ঢাকা। তারপরও ইমরুল চৌধুরীর নেতৃত্বে বিউটি বোর্ডিং সুধী সংঘ ট্রাস্ট হয়েছে। আমি আশা করবো সবার আশির্বাদে বিউটি বোর্ডিং বেচে থাকবে অনন্তকাল, ক্ষণজন্মা হবে না প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহার মতো।
বিউটি বোর্ডিংয়ে থাকা-খাওয়া
ভাত-ডালের সঙ্গে বড়া, ভর্তা, শুক্তো, চড়চড়ি, চাটনি, মুড়িঘণ্ট, মোচা-ইচড়, ফলি মাছ, বাতাসি মাছ, কাইখা মাছ, কাজলি মাছ, চেওয়া মাছ, বজরি মাছ, খল্লা মাছও পাওয়া যায় তবে বাজারে যোগান সহজলভ্য হলে।
এর মধ্যে মুরগীর মাংস ১২০ টাকা, ইলিশ মাছ ঝাল বা সরিষা ২০০ টাকা, রুই মাছ ১০০ টাকা, মেনি মাছ ৯০ টাকায় খেতে পাবেন। কাপ দই পাবেন ৩০ টাকায়।
এখানে থাকার ঘর আছে ২৫টি। খাওয়ার তুলনায় থাকা সস্তা। এক বিছানার ঘর প্রতি রাতের জন্য ভাড়া ২০০ টাকা আর দুই বিছানার ঘর ৩০০ টাকা। এক বিছানার ঘর আছে ১২টি আর দুই বিছানার ঘর ১৩টি।